ছেলেটার সঙ্গে পেরে ওঠাই যায় না! বাবারে বাবা, কী ছেলের কথা! আর তার সঙ্গে সঙ্গী হয়েছে পুচকে সোনাপি। ওর ছোট বোন। হঠাৎ হঠাৎ কি যে সব প্রশ্ন করে, মাথায় চক্কর মেরে দেয়! রাগ করলেও মুশকিল। বড্ড অভিমান! নতুবা বলবে, ও! তুমি মাননা বলেই রাগ কর।
সেদিন বাইরে থেকে এসেই প্রশ্ন, মা আমায় বুঝিয়ে দাও তো কথাটা- একটা ঘোষণা এসেছে, এক সপ্তাহের মধ্যে সব সাইনবোর্ড বাংলায় লিখতে হবে। হাসিতে আর কিছু-ই বলতে পারছে না ! এমনিতে কাজের তাড়া তার ওপর আচমকা জিজ্ঞাসাদি! মা তরকারি কাটা থেমে রাগটা চেপে শুনতে চাইলো আবারও! সুবর্ণ বলল, একটা ঘোষণায় শুনলাম, এক সপ্তাহের মধ্যে সব সাইনবোর্ড বাংলায় লিখতে হবে। মা একটু ভেবে বলল, ঠিকই তো আছে এতে আবার খোঁটা ধরার কি হলো!
সুবর্ণর শব্দ করে হাসি- হি হি হি... থেমে বলল, তুমিও বলছ ঠিক! বাবা তো রাস্তায় ধমক দিয়ে বলল, কি সব তোর আজগুবি ভাবনা, ঠিকই তো আছে!
সোনাপি কৌতূহল ভরে উপভোগ করছিল এতক্ষণ। সে মিনমিনে গলায় বলল, জানো না দাদা, কথায় কথায় দাদু বলত, ব্রিটিশের করানো অভ্যাসের মায়া কি ছাড়তে পারে!
বাবা মা উভয়েই কথা বন্ধ করে রইল। সুবর্ণ বলল, অভিমানের দরকার নেই, মেনে নাও! বাংলায় লিখতে বলে যদি সাইনবোর্ড শব্দটাই ঘোষণায় থেকে যায় তো ইংরেজির জায়গায় ইংরেজি রেখে বাংলায় বলতে বলা হলো না!
মা নিজের অজানা বা ভুলটা রাগ দিয়ে ঢাকতে চায়! বলল, লেখাপড়ার চিন্তা নেই সারাদিন এটা ওটা! যাও, বই নিয়ে বসো।
সুবর্ণ মুখ গোমড়া করলেও ভেতরে তার কৌতূহল উঁকিবুকি করছে!
বাবা অবশ্য কিছু বলল না। মায়ের কাছে চা চাইলো শুধু।
সুবর্ণ কিছুটা বেগতিক অবস্থা দেখে বই নিয়ে বসল। সোনাপিও তাই করল।
বাবা চা'য়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, তোমাদের স্কুলের পিকনিক কবে যেন!
এবার সোনাপির জিজ্ঞাসা- বাবা,
তুমিও!
কেন, যাবে না বুঝি!
সোনাপির কথা, যাবে তো। কিন্তু তুমিও পিকনিক!
মা'য়ের ধমক- এই যে পড়া ছেড়ে মাস্টারি!
বাবা মাকে থেমে দিল চায়ের প্রশংসা করে। সোনাপিকে বলল, তোমার কথা বুঝেছি। কিন্তু- বলে বলল, বনভোজনে কবে যাবে!
সুবর্ণ যোগ করল- স্কুল না বলে বিদ্যালয় বলিও!
বাবার মুখে মিষ্টি হাসি।
মা ভাত উঠিয়ে দিতে দিতে বলল, অত মাস্টারি করো, রেজাল্ট বের হোক, দেখব তখন কোন ক্লাস হয়!
সোনাপির হাসি। মায়ের রাগ বাড়ল। বলল, হাসিও না!
সুবর্ণ বলল, মা, তোমার রেজাল্ট-
বাবার মুখে মুচকি হাসি।
মা যেন আরও ফিকিয়ে উঠলো। কাজ নেই তো, সারাদিন টকশো! সোনাপির দিকে চোখ রাঙিয়ে বলল, এই মেয়ে, স্কুলের পড়া কম্পিলিট হয়েছে তো!
সুবর্ণ সোনাপি'র মুখ থেকে ফিকরে হাসি বের হতে চায়। কিন্তু মায়ের ভয়ে অনেক কষ্টে চেপে রাখে।
সুবর্ণর এক মামা ঝলমলে পোশাকে বাড়িতে ঢুকল। ওর বাবার শ্যালক হিসেবে ইয়ার্কির সুরে বলল, কি ব্যাপার বড় কুটুম্ব, অনেক দিন পর অফিসারের পা!
মা রাগিয়ে উঠে বলল, কি বুদ্ধিজীবীরা, তোমার বাবার বেলায় কেন মুড অফ!
সোনাপি সুবর্ণ একে অপরের মুখের দিকে তাকালো!
ওদের মামা ওদের বাবাকে তাদের সম্পর্কের ইয়ার্কিতেই বলল, মনে পড়ল হাইফাই গণের কথা, তাই অফিস থেকে একটু ফ্রি হয়ে এলাম!
সোনাপি সুবর্ণ এক সঙ্গেই বলে উঠল, মামা তুমিও!
মামা হতচকিত হয়ে ভ্রূ উঠালো। বলল, আমি কী করলাম!
বাবা মামাকে থামাল। বলল, বড় কুটুম্ব, আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, আবার আছে! এরা মায়ের ভাষাকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে কোনো ভণিতা করতে চায় না। এরা বলতে চায়, আমার মায়ের ভাষা বাংলায় শব্দের কি ঘাটতি আছে যে, বলতে পাওয়া যাবে না! এই যে, যেমন- তুমি বললে অফিস, ফ্রি; ওর মা বলল রেজাল্ট, কম্পিলিট, মুড অফ; আমি বললাম- অফিসার- এসব বিদেশি ভাষা ব্যবহার না করে বাংলা ভাষায় এসব শব্দ সর্বাগ্রে ও সচরাচর ব্যবহার করা যায় না!
মামা উৎসাহী হয়ে বলল, এ তো খুব সঠিক গো।
যা রক্ষায় রক্ত দিয়েছি তাকে অবজ্ঞা করি মূল্য কম ভেবে! সুবর্ণর বাবাকে যেন বিচার দেবে এমন ভাবে বলল, আরে যদি ঘাটতি থেকে থাকে, সেরে নেওয়ার ব্যবস্থা করলেই হলো! থামলেন। হতাশার সুরে বললেন, আসলে 'বাংরেজি' নামক একটা রোগে ধরেছে আমাদের! বাংলাই শিখিনা ভালো করে, স্মার্ট হতে ইংরেজির পেছনে ছুটি! থেমে বলল, মরীচিকা!
বাবা বলল, বড় কুটুম্ব, আনোনি সঙ্গে, ওই যে কি এফএম না কি সেবার শোনাচ্ছিলে! বড় কুটুম্বের মুখে হাসি। বলল, ভাষার মাসে.... ও আমি শোনা বন্ধ করে দিয়েছি! সুুবর্ণর বাবা কৌতূহলে বলল, তাহলে অন্য মাসগুলো ভাষার মাস নয়! ভাবালে গো! মামা একটু ভ্যাবাচেকা খেল। বলল, না, তা নয়, মানে- শুনতে ভালোই লাগে, কিন্তু সুবর্ণর বাবা বলল, কিন্তু হচ্ছে, ব্রিটিশে গড়ে ওঠা জং যে! তার ভেতরে বাংলার যে স্বাদ ঢেকে আছে তা বুঝতে পাইনে!
সুবর্ণ বলল, আমরা কিন্তু মায়ের হাতের রান্নার যে স্বাদ পাই তা অন্য কিছুর সঙ্গে তুলনা পাই না!
সোনাপি বলল, মা তার মায়ের কাছে শিখেছে যেমনভাবে, যদি তেমনভাবে চালিয়ে যায় তাহলে তো কথাই নেই!
মায়ের মুখে হাসি।