ফিরোজ ড্রাইভারের বাড়ি ছাড়াতেই বিশাল মাঠ। তার ওপাশে আমের বাগান। ইস্কুল শেষে বাড়ি ফেরার পথেই মাঠ আর আমের বাগান ছাড়িয়ে তবেই আমাদের বাড়ির পথ। আজ বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেছে। চৌরাস্তা ছাড়িয়ে মাঠের দিকে পা বাড়াতেই চমকে গেলাম। সবুজ ঘাসের উপর ছোপ ছোপ রক্ত। ছোট বাচ্চার ডান পায়ের একটা স্যান্ডেলও পড়ে আছে। বিজু বললো- নিশ্চয় এসব ছেলে ধরার কাজ। ভয় পাসনে। আজ এর একটা বিহিত করতেই হবে। কিন্তু ভোম্বল কান্নাকাটি শুরু করে দিল। বাড়ি যাব, মা'র কাছে যাব বলে মিনতি করতে লাগল। বিজু পকেট থেকে আম কাটা চাকু বের করে ভোম্বলের সামনে ধরে বলল- ফের পঁ্যা পঁ্যা করবি তো খবর খারাপ হয়ে যাবে- বলে দিচ্ছি। ওই চাকু বা ছোরার ভয়ে ভোম্বল একবারে চুপ হয়ে গেল। আর কান্নাও নেই, মুখে কোনো কথাও নেই। আমি বুঝতে পারছিলাম না আসলে বিজুটা কী করতে চাচ্ছে। বিজু আমাদের বলল- আমাকে ফলো করছো। একদম ভয় পাবিনে। আমাদের এই মহেশপুর গ্রাম পার হলেই ভারত। শয়তানগুলো এ পথেই শিশু পাচার করে। যদি একবার ধরতে পারি তো চিরদিনের মতো শিক্ষা দিয়ে দেব। আমি বললাম এটা যে ছেলে ধরার কান্ড তা মনে করছিস কেন? অন্য কিছুও তো হতে পারে। তা ছাড়া ওরা যদি শিশুদের পাচার করার জন্যই ধরে নিয়ে যাবে- তবে এখানে রক্ত এলো কীভাবে? শুনেছি ওরা ভুলিয়ে ভালিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে যায়। কিন্তু রক্ত আসবে কেন? আমার কথায় নয়ন সায় দিল। কিন্তু বিজু একদম নাছোড় বান্দা। রক্তের দাগ দেখে দেখে এগুতে লাগলো। সন্ধ্যে হয়ে আসছে তাই ক্রমশই আলো কমতে শুরু করেছে, আগের মতো কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না। একটু দূরে গিয়ে একটা চকলেট পাওয়া গেল। বিজু বলল, দেখলি তো? এখন ব্যাপার টা স্পস্ট হয়ে গেল। এ সব পাচারকারীদের কাজ। নয়ন বলল, পাচারকারীদের সঙ্গে নিশ্চয় অনেক অস্ত্র আছে, লোকজনও থাকতে পারে। আমরা ওদের সঙ্গে পারব কীভাবে? বিজু বলল- বুদ্ধি দিয়ে। বুদ্ধি দিয়েই আমরা ওদের ধরে ফেলব। চিৎকার দিলেই সমস্ত গ্রামের লোক আমাদের কাছে এসে পড়বে। একদম ভয় পাসনে। মহৎ কাজে সাহস রাখতে হয়। হঠাৎ ভোম্বল আবার শব্দ করে কেঁদে উঠল, বিজু তাকাতেই- আবার চুপ। বেশিদূর এগুতে হ'ল না। একটু এগিয়ে গিয়েই বাচ্চাদের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। হ্যা, অনেক বাচ্চার কণ্ঠ। হরেন ঘোষের পুকুর ছাড়িয়ে ফাঁকা জায়গা। সেখানে ছোট একটা ঘর। ওখান থেকে আওয়াজ আসছে। বিজু খুব সাবধানে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়েই ফিরে এসে আমাদের জানাল- যা ভেবেছি তাই। একটা বাচ্চা কী যেন খাচ্ছে। আর একটা নীল ডাউন হয়ে বসে আছে। আর বাকিগুলো চুপ চাপ ঘরের মেঝেতে বসে কি যেন করছে। আমরা বললাম- এখন কি করবি রে বিজু? বিজু বললো- ওদের লিডারটা এখন কল তলায়। একটা মাত্র বড় মানুষ, অন্য কাউকে দেখতে পাইনি। ব্যাটাকে ধরবই। আয় তোরা। আমরা ভয়ে ভয়ে বিজুর পিছু পিছু হাঁটছি। লোকটা কল তলায় কি যেন করছে। বিজু দেরি না করে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটার উপর, সঙ্গে আমরাও। হঠাৎ বিদু্যৎ চলে এলো। এতক্ষণ আমরা লোডশেডিংয়ের কারণে বুঝতে পারিনি, বিদু্যতের আলোয় স্পস্ট দেখলাম লোকটা আর কেউ নন, আমাদের অংক স্যার। বিজুকে একটা রাম থাপ্পড় দেয়ার পর বিজু চিৎ হয়ে শুয়ে থাকল। স্যারের স্ত্রী এগিয়ে এলেন। স্যারের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করে ঘরে নিয়ে গেলেন। সমস্ত ঘটনা শুনে হেসেই খুন। তবে ঘরের ওই বাচ্চাগুলো? রক্ত? স্যান্ডেল? চকলেট ? স্যারের স্ত্রী জানালেন- আজ রাতে আমার ভাই আসবে তাই মুরগি ওই মাঠ থেকে জবাই করে আনা হয়েছে। বাড়িতে তোমার স্যার ছিলেন না, মাঠের ছেলেদের দিয়ে জবাই করিয়ে এনেছি। ও ঘরের বাচ্চাগুলো রোজ এই সময় তোমার স্যারের কাছে অংক শেখে। আর স্যান্ডেলটা বোধ হয় আমার ছোট্ট ছেলেটার। চকলেট টাও হয়তো ওর হাত থেকে পড়ে গেছে। ও আমার সঙ্গে মাঠে গিয়ে ছিল। নয়ন পকেট থেকে স্যান্ডেল আর চকলেট বের করে দিতেই স্যারের স্ত্রী আবার ফিক করে হেসে দিলেন। এতক্ষণে বিজু উঠে দাঁড়িয়েছে। ও ঘরের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ওকে দেখছে চিড়িয়াখানার বাঁদর দেখার মতো। বিজু বলল- স্যার, আপনাদের বাড়ি উত্তর পাড়াতে ছিল যে...। স্যারের স্ত্রী বললেন, আজ একমাস হলো আমরা এই নতুন বাড়িতে। একটা পিচ্চি ছেলে দৌড়ে এসে আস্তে আস্তে বিজুকে বলল- খুব ঠ্যাঙানি দিয়েছে তাই না? ভোম্বল ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে উঠল।