দিনটি ছিল আমাদের টু্যরের তৃতীয় দিন। প্রতি বছর আমাদের বিভাগের শিক্ষা সফর থাকে। আমরা যেহেতু উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষার্থী সেহেতু আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় যে কোনো ধরনের ইকো টুরিজমসমৃদ্ধ স্থানে। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ কমিটির সভাপতি ড. মাহফুজ স্যার আমাদের এবার নিয়ে গেলেন চট্টগ্রাম কক্সবাজার অঞ্চলের বিশাল সংরক্ষিত বনাঞ্চলে। তারই অংশ হিসেবে চুনতি বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য কেন্দ্র ঘুরে দেখলাম।
বনে যেতে টিকেট লাগে। টিকেট কেটে আমরা নেমে পড়লাম বনের পথে। সঙ্গী সাথী অনেক। প্রায় ৫০ জন। স্যার বললেন, বনে ঢোকার আগে সবাই সিঙ্গারা ও বিস্কুট খেয়ে নাও। শীতের আমেজ কমে গেছে। সূর্য যেন একটু বেশিই তাপ দিচ্ছে। আমরা পদব্রজে এগিয়ে চলেছি। একটু এগিয়ে গেলেই দেখতে পেলাম সাইনবোর্ড। সেখান থেকে এই অভয়ারণ্য সম্পর্কে জানলাম, চট্টগ্রাম জেলার লোহাগড়া উপজেলায় এর অবস্থান। আমরা অবশ্য সেখানেই ছিলাম। চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশেই এই বনাঞ্চল। অভয়ারণ্যটি প্রধানত ক্রান্তীয় মিশ্র-চিরহরিৎ। ৪৭৭ প্রজাতির বারো লাখেরও বেশি গাছ রয়েছে এখানে। বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, চকরিয়া ও বাঁশখালী এলাকায় ১৯ হাজার ১৭৭ একর জমি নিয়ে চুনতি সংরক্ষিত অভয়ারণ্য এলাকা। অভয়ারণ্য ঘোষণার পর এ বনে ধীরে ধীরে ফিরে আসছিল জীববৈচিত্র্য। সংরক্ষিত এ বনে বর্তমানে ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৫৩ প্রজাতির পাখি, সাত প্রজাতির সরীসৃপ এবং ১০৭ প্রজাতির গাছপালা রয়েছে। মূলত বৃক্ষ এবং বৃক্ষের ফলের ওপর নির্ভরশীল এ প্রাণীর জীবন চক্র। আরো জানলাম, এ বনে রয়েছে বেশ কয়েকটি শতবর্ষী গর্জন গাছ। এ ছাড়াও শাল, সেগুন, আকাশমণি, বট, হারগোজা, চাঁপালিশ, হরীতকী, বহেরা, বাঁশ, আসাম লতা, ছন প্রভৃতি তো রয়েছেই।
তবে সবচেয়ে আশার বিষয় হলো, এশিয়ান হাতির অন্যতম আবাসস্থল এবং হাতির প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র চুনতি অভয়ারণ্য ২০১২ সালে বন ও পরিবেশ রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখায় জাতিসংঘের 'ইকুয়েটর পুরস্কার' লাভ করে।
আমরা বনের ভেতর হাঁটছি। গভীর বন। পাহাড়ি বন। উঁচু নিচু বনে হাঁটা চলায় বেশ অসুবিধা হয়। গাছের পাতায় পাতায় লুকিয়ে থাকে লাল লাল পিপড়া। সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম অনেক গাছ কাটা। পাহাড় কেটে সমান করা হচ্ছে। বড় বড় ভেকু দিয়ে কাটা হচ্ছে পথ। আশঙ্কা সত্যি হলো।
এ অভয়ারণ্যের বুকচিরে (কোর জোন) বয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ। এতে কাটা পড়ছে বনটির শতবর্ষী ৫০টি গর্জন গাছসহ প্রায় লক্ষাধিক গাছ। বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এ রেলপথ চুনতি অভয়ারণ্যের ভেতর প্রায় ১০ কিলোমিটার যাবে। ওই রেললাইনের ২১টি স্থানে রয়েছে হাতির বসতি ও চলাচলের পথ। দেখে বেশ কষ্ট হলো। হু হু করে উঠল বুকের ভেতর। আমাদের এত সংগঠন, এত সংস্থা, এত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকা সত্ত্বেও আমাদের পরিবেশকে আমরা রক্ষা করতে পারি না। এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কী হতে পারে। একজন উদ্ভিদবিদ্যার ছাত্র হিসেবে আমার বেশ দুঃখ হয়। আমরা ফিরে আসি। ধীরে ধীরে। আর মনে মনে ভাবি, আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। রেলপথ আমাদের নিয়ে যাবে শৈবাল সাগরের নীলাম্বরী মেঘালয়ে। সেখানে দুদিন থেকেই চলে আসব নির্মল বাতাসে। কিন্তু যাদের হাজার বছরের বাস, যাদের ঘর একবার ভেঙে গেলে গড়ার কেউ নেই তাদের কথা একবারও ভাবলাম না!