আশ্বিনের আকাশ বেশ ছলনাময়ী। কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি। শরতের প্রকৃতিও যেন গিরগিটির মতো রঙ পাল্টায়। আজ সকালটা ছিল উজ্জ্বল, বেশ রৌদ্রজ্বল। এমন সুন্দর সকালে ঘুম থেকে উঠতেই মন ভালো হয়ে গেল। কারণ, আজ আমাদের ফিল্ডওয়ার্কে যেতে হবে পাবনার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আর ভ্রমণের জন্য বৃষ্টির দিন কতটা অসুবিধাজনক হতে পারে, তা তো সবারই জানা। সে জন্য আজকের রোদেলা দিনটি বাড়তি আনন্দ এনে দিল।
তবে সকালটা এতটাও মসৃণ ছিল না। ডিপার্টমেন্টাল নোটিশ গ্রম্নপে চোখ পড়তেই দেখি, ফিল্ডওয়ার্কে যাওয়ার আগে তিনটি ক্লাস করতে হবে। একটু মন খারাপ হলেও তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে ক্লাসের দিকে রওনা দিলাম।
ক্লাস শেষে বেলা ১১টা নাগাদ সবাই পাবনা টার্মিনালে অবস্থান করছে। আমরা চার বন্ধু-আমি, আকাশ, সাব্বির ও সুইট পিছিয়ে পড়েছিলাম। ক্যাম্পাস থেকে তাড়াতাড়ি একটা অটোরিকশা নিয়ে টার্মিনালের দিকে রওনা দিলাম। সেখানে পৌঁছে বন্ধু সাব্বিরের আমন্ত্রণে সকালের নাস্তা সেরে দেখি, জিসান আর আব্দুর রহমানও আমাদের সঙ্গে যাবে। ওরা দুইজনেই আড্ডা জমাতে বেশ পটু, যেকোনো সভা-সমাবেশে,আড্ডায় পথচলায়, এদের কথার ঝুলি যেন বোঝাই থাকে। ওদের সঙ্গ পেলে আড্ডা আরও জমজমাট হয়, তাই ওদের দেখে আনন্দের মাত্রাটা আরও বেড়ে গেল।
আমরা মোট ১৭ জনের দল হয়ে গেলাম। গন্তব্য পাবনার চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা ইউনিয়নের চর-নবীন গ্রামে। পাবনা শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে এই গ্রামটি। শুনেছি, মানুষরা নিচু জায়গা ভরাট করে চর বানিয়েছে, তাই এর নাম চর-নবীন। সেই জায়গা দেখার আগ্রহে মনটা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। যেহেতু জায়গাটা বেশ অজপাড়াগাঁ, তাই সঠিক বাস সিডিউল না পেয়ে গ্যাসচালিত সিএনজি নিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু হলো। প্রতিটি অটোতে পাঁচজনের বসার ব্যবস্থা থাকায় বাকি দুই বন্ধু হাম্মাদ ও সোহেলকে বাইকে আসতে হলো। এমন ছোটখাটো বাধা সত্ত্বেও আমাদের ভ্রমণাকাঙ্ক্ষা বিন্দুমাত্র কমল না।
সিএনজি চলতে থাকল, আর আমরা পথের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। হাসি-তামাশার আসর জমে উঠল। আমাদের দল ছিল বেশ প্রাণবন্ত; বিশেষত জিসান ও আব্দুর রহমানের মতো বাক্পটু বন্ধুরা থাকলে আড্ডার পরিবেশ সবসময়ই মজার হয়। তাদের গল্পের ঝুলিতে এমন সব কাহিনী থাকে, যা ভ্রমণকে আরও স্মরণীয় করে তোলে। তবে আরেকজন বন্ধু সাব্বির ও আছে বেশ সুবক্তা, সে ছিল আরেকটা গাড়িতে।
টেবুনিয়া বাজার থেকে উত্তরে আমরা চাটমোহরের দিকে যাচ্ছিলাম। রাস্তার দুই ধারের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কখন জানি অনেকটা সময় কেটে গেল। মিনিট পঞ্চাশেক পর পৌঁছলাম চাটমোহর। এখানকার বিখ্যাত মিষ্টির কথা নাটক, সিনেমা থেকে শুরু করে সব মানুষের মুখে শুনে এসেছি এতদিন। তাই এখানকার মিষ্টি গলধকরণ করার স্বাদ জাগলেও সময়ের অভাবে সেদিকে আর মন দেওয়া হলো না। আমাদের লক্ষ্য ছিল- ছাইকোলার সেই মায়ায় ঘেরা চর-নবীন।
ছাইকোলা বাজারে পৌঁছে সবাই মিলে নৌকা নিয়ে চর-নবীনে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। এর কয়েক মাইল আগেই পথে বামন বাজার নামে একটা জায়গার নাম দেখে বেশ কৌতূহল হলো। পরে জানলাম, এই অঞ্চলের আবু বকর সিদ্দিক নামে এক বামন (উচ্চতায় ৩ ফুট) ব্যক্তি যাত্রাপালায় অভিনয় করতেন। একসময় যখন তার বয়স চলিস্নশোর্ধ হয়ে যায় তখন তিনি আর আগের মতো মানুষকে বিনোদন দিতে পারতেন না, সেই থেকে যাত্রাপালায় অভিনয়ের পেশাটা তার হাতছাড়া হয়ে যায়। নিরুপায় আবু বকর তার নিজ গ্রামে এসে রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকান দিয়ে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। একসময় তার চায়ের দোকানকে কেন্দ্র করে মানুষের লোকসমাগম বাড়তে থাকে, এটি দেখে আরও অনেকে একই জায়গায় বিভিন্ন রকমের দোকানপাট গড়ে তোলেন। এভাবেই কালক্রমে একটা বাজারে পরিণত হয় এবং বাজারের নাম হয়ে যায় বামন বাজার। তার জীবনের এই গল্প শুনে মনে হলো, প্রত্যন্ত অঞ্চলের এমন সাধারণ মানুষরাও তাদের জীবন সংগ্রামের মাধ্যমে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে।
আমরা ছাইকোলা বাজারঘেঁষা আত্রাই নদীর ব্রিজে এসে থামলাম। বাকি দুই বন্ধু বাইকে করে পৌঁছানোর অপেক্ষায় ছিলাম। সবাই আসার পর ১৭ জনই গ্রামটির দিকে রওনা দিলাম। চর-নবীন গ্রামটির চারদিকে পানি আর মাঝখানে ভাসমান মাছের ঠোঁটের মতো দাঁড়িয়ে আছে কতগুলো বাড়ি। আমরা সেই বাড়ির দিকে হেঁটে হেঁটে এগোতে থাকলাম। পথিমধ্যে ষাটোর্ধ এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম। অনেক অজানা জানতে চাইলাম। এখানকার প্রকৃতি, মানুষ, চাষাবাদ, নদী-নালা সব কিছু নিয়ে মানুষটিকে প্রশ্ন করতে দেরি বৈকি; উত্তর এর আগেই জানা। গায়ের লৌহাবরণ আর কপালের ভাঁজ দেখেই বোঝা যায়, বৃদ্ধ মানুষটির এই জীবনে কতটা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তবে আজ এখানে। চরের এই জীবনাচরণে হয়ত তাকে কতই না জীবনযুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়েছে, তার পরিবারকে টিকিয়ে রাখতে হয়েছে। সবশেষে মহান এই যোদ্ধার সঙ্গে সবাই দলগতভাবে ক্যামেরাবন্দি হয়ে তাকে বিদায় জানালাম।
এরপর আরেকটি পরিবারের সঙ্গে আমাদের কথা হলো অর্ধবয়স্ক এক পুরুষ। বয়স আনুমানিক চলিস্নশ হবে। দেখেই বোঝা যায় অতিরিক্ত কায়িকশ্রমের কারণে দেহে তার গাঢ় কালো আবরণ পড়ে গেছে। গ্রামীণ এক ধরনের বসার জায়গা মাচাংয়ে বসে আছেন তিনিসহ তার পরিবার। মাচাং সাধারণত বাঁশের তৈরি এক ধরনের খাট বা বসার জায়গা, যা মূলত গ্রামের মানুষের অবসর সময় একটু বিশ্রামের জন্য বড় গাছের নিচে বা ছায়াযুক্ত জায়গায় স্থাপন করা হয়। সারাদিনের কাজ শেষে ক্লান্তি নিয়ে কৃষকরা এই মাচাংয়ে বসে অবসাদ দূর করার চেষ্টা করেন। একটু পরই লক্ষ্য করলাম, পাশের কয়েকটি বাড়িতে কিছু কিছু মহিলা গরুর খাদ্য দিচ্ছে, কেউবা আবার গরুর গা-গোসল দিচ্ছেন, কেউ গরুর বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে আসছেন। বুঝলাম গ্রামীণ চরের এই মহিলাদেরও অনেক সংগ্রাম করে জীবন পার করতে হয়।
চর-নবীনের গৃহস্থালি অবলোকনের পর এবার আমরা যাচ্ছি নৌকা ভ্রমণে। আমরা ৮০০ টাকায় একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া করে নদী ভ্রমণে বের হলাম। পদ্মবিলে ফুটে থাকা শাপলা পাতার গড়নের মতো মাঝারি এই নৌকাটিতে আমাদের সবার ভালোভাবেই জায়গা হলো। নৌকার ছাউনির ওপর বসে সবাই মিলে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। কেউ পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকল, কেউবা নৌকার ওপর শুয়ে আকাশ দেখছিল। স্মৃতিগুলো ধরে রাখতে সবার মোবাইলে ক্যামেরাবন্দি করার ধুম লেগে গেল। প্রকৃতির সঙ্গে এই সরাসরি সংযোগ যেন আমাদের দৈনন্দিন ব্যস্ততা থেকে এক নিঃশ্বাস প্রশান্তি এনে দিল।
পথে নাম না জানা দুটি ছোট চর ঘুরে দেখলাম, যেখানে মানুষের স্থায়ী বসবাস নেই, শুধু হাঁস পালন করা হয়। এই চরগুলোর নির্জনতা আর বিশালতা এক ধরনের শূন্যতার অনুভূতি এনে দিল। হাঁসেরা দিনের বেলা পানিতে থাকে, সন্ধ্যায় খামারের মালিকরা তাদের গৃহস্থালিতে ফিরিয়ে নেয়। তাদের এই সারাদিনের সংগ্রামী জীবনযাত্রা আমাদের মতো শহুরে জীবনের সঙ্গে কতটা ভিন্ন, তা অনুধাবন করলাম।
এভাবেই প্রায় তিন ঘণ্টা নৌকায় সুন্দর সময় কাটিয়ে ঠিক সন্ধ্যা হওয়ার আগেই আমরা ছাইকোলা বাজার ঘাটে এসে পৌঁছলাম। যথারীতি শেষবারের মতো বাজারটিতে একটু ঢু মেরে দেখলাম। এরপর আবার সেই তিন চাকায় চালিত যানে ভর করে নিজেদের বাসার দিকে রওনা দিলাম। গাড়িটির চাকার প্রতিটি ঘূর্ণন যত ক্ষীপ্রগতিতে ঘুরতে থাকল, ততই মন খারাপ হতে লাগল। এই বুঝি একটি সুন্দর দিনের ইতি হলো, এভাবেই হয়ত এক দিন সবকিছুর সমাপ্তি ঘটবে! এভাবেই শেষ হয়।