শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

প্রত্যাশার শিক্ষাঙ্গন :কেমন হওয়া উচিত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়?

অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬টি বসন্ত চলে গেছে। প্রাচীনকালে বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্ঞান বিতরণের স্থান হিসেবে না, বরং সৃজনশীল জ্ঞানের স্রোত তৈরি করার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করত। কিন্ত একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে যেন হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু প্রত্যাশা হারাইনি। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রত্যাশা করে একদিন প্রতিষ্ঠানটি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। স্বপ্ন দেখে প্রকৃত মানুষ বেড়ে উঠবে এই প্রতিষ্ঠান থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আনন্দঘন মুহূর্তে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভাবনাগুলো তুলে ধরেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মমিনুর রহমান
  ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
প্রত্যাশার শিক্ষাঙ্গন :কেমন হওয়া উচিত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়?

জ্ঞান সৃজনই হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ

শফিক আশরাফ

অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ।

শিক্ষা সভ্যতার ইতিহাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকদিনের পুরনো। আমাদের ছিল নালন্দা, তক্ষশীলা, বিক্রমশীলার মতো মহাবিহার, যা এই সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসেপ্টকে ধারণ করত। গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। আমাদের সেসময়ের উচ্চশিক্ষা ছিল অনুকরণীয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, এই একবিংশ শতকে এসে আমাদের অতীত ঐতিহ্যকে হারিয়ে ইউরোপকে অনুকরণের প্রাণপণ চেষ্টা করছি।

কলেজের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় পার্থক্য হলো, কলেজে জ্ঞান চর্চা হয় আর বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় জ্ঞান সৃজন ও চর্চা। জ্ঞান সৃজনের জন্য দরকার গবেষণা, অবকাঠামো ও দক্ষ গবেষক। আমরা গবেষণা নির্ভর বিশ্ববিদ্যালয় চাই। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে, বিশ্ববিদ্যালয়কে আমলাদের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত করে, শিক্ষক নিয়োগে গবেষণাকে প্রাধান্য দিয়ে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখি যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী রাজনীতি থাকবে না। সেখানকার সৃজিত জ্ঞান নিয়ে দেশ আপন পায়ে দাঁড়াবে।

আদর্শ শিক্ষাঙ্গনের স্বপ্ন

শেখ মাজেদুল হক

সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ।

আমাদের প্রিয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আমাদের স্বপ্ন দেখায় একটি আদর্শ শিক্ষাঙ্গনের, যা শুধু জ্ঞান বিতরণেই নয়, ভবিষ্যতের নেতৃত্ব তৈরিতে পথপ্রদর্শক হবে। আমরা চাই এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে বিশ্বমানের শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন এবং নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে। আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার, গবেষণার সমৃদ্ধ সুযোগ এবং শিক্ষার্থীদের জন্য এক অনুপ্রেরণামূলক পরিবেশ থাকবে। প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যা কেবল দেশে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আমাদের পরিচিতি ও গৌরব বহন করবে। যুগ যুগ ধরে আলো ছড়াবে মানুষ গড়ার এ বিদ্যাপীঠ। শুভ কামনা রইল বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আজ এবং আগামী দিনের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ হোক আনন্দময়

নিয়ামুন নাহার নিমা

সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ।

আমরা জানি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের জায়গা। এখানে জ্ঞানচর্চা করা হয়। সেই জ্ঞান অর্জন করে শিক্ষার্থীরা নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করেন এবং পরিচয় নির্মাণ করেন। তারা ছড়িয়ে পড়েন চাকরি কিংবা অন্যান্য পেশার নানান শাখা-প্রশাখায়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার একটা বড় দিক ভুলে যাই যে, দেশের প্রতি আমাদের এক বিরাট দায়বদ্ধতা আছে, কর্তব্য আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকটা ইট এদেশের প্রতিটা মানুষের শ্রমের বিনিময়ে গাঁথা। আমরা যেন ভুলেও না ভাবি বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের ব্যক্তিগত এজেন্ডা বাস্তবায়নের জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের একটা বড় কাজ হলো স্বাধীন চিন্তা, সৃজনশীলতা এবং সমালোচনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমাজকে ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এই কাজগুলোকে অনুপ্রেরণা দেবেন এবং সহজ করবেন যেন এখানকার সব শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক পড়াশোনাকে নিতান্তই নিরানন্দমূলক কোনো কাজ না মনে করেন। সেজন্য প্রয়োজন হলে সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারও প্রয়োজন। আমি দেখি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ নানান বাস্তব কারণে খুব মলিন। সমস্যা কাটিয়ে ওঠে আমি চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের পদচারণা হোক আনন্দময়।

শিক্ষকের হাত ধরে ব্যক্তিত্বের সূর্যোদয়

হুরানি মদিনা লিসা

শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ।

শিক্ষা আলো, নিরক্ষতা অন্ধকার। শিক্ষা মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়, মানুষের অন্তরের প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলে। শাণিত করে সুপ্ত দক্ষতাকে। শিক্ষক সেই প্রতিভা বা দক্ষতাকে শাণিত করতে চালক এবং প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। শিক্ষা বিনিময় মূল্য দিয়ে পরিমাপযোগ্য নয়। এর স্বার্থকতা নিহিত রয়েছে জ্ঞানপিপাসু ছাত্রত্ব দিয়ে। একজন আদর্শবান শিক্ষক মৌলিক গুণাবলির সমন্বয়ে ব্যক্তিত্ববান মানুষ তৈরির একমাত্র কারিগর। শিক্ষক বিশ্বাসের জায়গা, ভরসার আশ্রয়স্থল, সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিত্ব এবং কাছের বন্ধু। একজন শিক্ষক শুধু একাডেমিক নয়, তিনি সামাজিক দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। শিক্ষকরা উদ্দীপনার উৎস হিসেবে কাজ করে, এর প্রভাবে একজন শিক্ষার্থী সারাজীবন অনুরণিত হতে পারে। শিক্ষককে শ্রদ্ধা ও শ্রদ্ধাভরে কথা বলা, তার কথা গুরুত্ব সহকারে শোনা, বিধি-নিষেধ মেনে চলা এবং সর্বোপরি শিক্ষাজীবনে সাফল্য অর্জন করা ইত্যাদির মধ্যেই শিক্ষকের মর্যাদা নিহিত রয়েছে। আমাদের ভালো ব্যক্তিসত্তা হয়ে ওঠার মধ্যেই শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষিত। শিক্ষার্থী হিসেবে শিক্ষকের সম্মান সমুন্নত রাখা আমাদের নৈতিক ও মৌলিক কর্তব্য।

গবেষণা খাতকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে

মো. রাসেল হোসেন

শিক্ষার্থী, জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে বিভিন্ন সংকট। চাহিদার তুলনায় জোগান স্বল্প। গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও সুযোগ সৃষ্টি হওয়া উচিত। গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত ল্যাব সুবিধা এবং অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আমাদের এখনো খুব কম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হলেন সিনিয়র স্কলার। আর মাস্টার্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা হলেন জুনিয়র স্কলার। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে সুসংবদ্ধ জ্ঞান পাওয়ার জন্য গবেষণার বিকল্প নেই। আমি আশা করি যে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গবেষণা খাতে বিনিয়োগ বাড়াবেন এবং শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উৎসাহিত করবেন। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকল্পে অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ানোর জন্যও উদ্যোগ নেওয়া দরকার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার পর চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক শিক্ষার্থী সমস্যায় পড়েন। তাই আমি আশা করি যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সাপোর্টের ওপর গুরুত্ব দেবে।

অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন চাই

আনিকা তাসনিম

জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন সময়ের দাবি। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি উত্তরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হলেও অবকাঠামোগত উন্নয়ন অনেকাংশে পিছিয়ে রয়েছে। পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার, ছাত্রাবাস এবং অন্যান্য সুবিধার অভাব শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষালাভে বাধা সৃষ্টি করছে। শিক্ষকদের জন্যও পর্যাপ্ত আবাসিক ও গবেষণা সুবিধা নেই। তাই অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং গবেষণা কার্যক্রমকে সমৃদ্ধ করা জরুরি। শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ের জন্য একটি সমৃদ্ধ পরিবেশ তৈরি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক শিক্ষা কার্যক্রম আরও উন্নত হবে এবং দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে