পরীক্ষাভীতি নেই তো পড়ালেখাও নেই

প্রকাশ | ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

সাবিরা বেগম ডলি
শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ। আর এই সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার মূল ভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষা স্তর। প্রাথমিক শিক্ষার একটা লক্ষ্য আছে, তা হলো-'শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, নান্দনিক, আধ্যাত্মিক, ও আবেগিক বিকাশ সাধন এবং তাদের দেশাত্মবোধক, বিজ্ঞানমনষ্কতা, সৃজনশীল ও উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে উদ্বুব্ধ করা।' শিশুদের শেখার শুরু হয় পরিবার থেকেই। মা-বাবা, ভাই-বোন সবার কাছেই তারা কিছু না কিছু শেখে। কিন্তু বয়স ৫ হলেই তাদের একটা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন হয়, তাই বিদ্যালয়ে যাওয়া। কারণ, পারিবারিক শিক্ষায় কোনো পরীক্ষা নেই, নেই কোনো প্রতিযোগিতা। আগে নিয়মিত বছরে তিনটা পরীক্ষা হতো। বার্ষিক পাঠ পরিকল্পনা অনুযায়ী মে মাসে প্রথম সাময়িক, আগস্টে দ্বিতীয় সাময়িক, নভেম্বরে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী এবং ডিসেম্বরে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো। ছিল চারটি বিষয়ের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা। শিশুরা নির্দিষ্ট একটা পরীক্ষার ফি জমা দিত, যা শিক্ষা অফিস কর্তৃক নির্ধারিত ছিল। প্রশ্নপত্র, খাতা সেই টাকায় নেওয়া হতো। ব্যাংকের মাধ্যমে প্রশ্নপত্রের জন্য নির্ধারিত টাকা জমা দিয়ে সেই রসিদ অনুযায়ী প্রশ্ন নেওয়া হতো। কতই না হৈ হৈ রবে পরীক্ষা নেওয়া হতো। শিশুরা পরীক্ষার জন্য আলাদা প্রস্তুতি নিত। কী ব্যস্ত একটা সময় পার করত শিশু, শিক্ষক এবং অভিভাবকরা। সমাপনী আর বৃত্তি পরীক্ষা বিরাট আয়োজনের মধ্য দিয়ে নেওয়া হতো। কিন্তু কোভিড-১৯ এর পর থেকে পরীক্ষা পদ্ধতি উঠে গেল। শিশুরা ভুলে গেল প্রতিযোগিতা। ভুলে গেল নিয়ম অনুযায়ী পড়াশোনা করা। উঠে গেল পাস-ফেল। লেখাপড়া হয়ে উঠল কাগজ-কলমে। শুধুমাত্র এটা ওটা ছক পূরণ, ফরম পূরণ করে অফিসে জমা দেওয়া এ পর্যন্তই। লেখাপড়া হয়ে উঠল যেন 'বজ্র আঁটুনি, ফষ্কা গেরো।' যার ফলস্বরূপ শিক্ষার্থীরা এক দিন স্কুলে আসে তো তিন দিনই অনুপস্থিত থাকে। হোমভিজিট আর মোবাইল ফোনে খোঁজ নেওয়ার পরও অভিভাবকরা বিষয়টিকে গভীরভাবে নিচ্ছেন না। অবোধ শিশুরা বুঝতে পেরেছে যে, স্কুলে না গেলে বা পড়া না হয়ে থাকলেও সমস্যা নেই। কেউ ধমকও দিবে না, আর ফেলও করাবে না। আর এভাবেই লেখাপড়ার মেরুদন্ড গেল ভেঙে। আফসোস! তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম শ্রেণির শতভাগ শিক্ষার্থী বাংলা-ইংরেজি সাবলীলভাবে পড়তে পারে না। এটা যে গোটা দেশ তথা জাতির জন্য কতটা লজ্জার, তা বলতেই মাথা অবনত হয়ে আসে। অধিকাংশ শিশু মেধাশূন্য হয়ে বেড়ে উঠছে। পড়াটাকে কোনোভাবেই আন্তরিকতার সঙ্গে নিতে পারছে না। তাইতো তারা পারছে না কোনো ছড়া /কবিতা মুখস্থ বলতে, পারছে না কোনো কবির নাম বলতে। পরীক্ষাভীতি নেই তো পড়ালেখাও নেই। বছর শেষে তো পরবর্তী শ্রেণিতে প্রমোশন পেয়েই যাচ্ছে। অভিভাবকদের অভিযোগ, 'পরীক্ষা নেওয়া হয় না কেন?' পরীক্ষা না থাকায় তাদের সন্তানরা পড়তে বসতে চায় না। শিক্ষকরা প্রতিনিয়ত ধারাবাহিক মূল্যায়ন, শিখন অগ্রগতি যাচাই, ক্লাস টেস্ট নিয়েও শিক্ষার্থীদের পাঠের অগ্রগতি খুব একটা ভালো হচ্ছে না। নির্দিষ্ট একটা অধ্যায় বা একটা পাঠের ওপর মূল্যায়ন করা হয়। এতে দুটি সমস্যা প্রতীয়মান হয়। এক. হয় তারা মুখস্থ পাঠটুকু উগরে দেয় অথবা দুই. নয় ভালো শিক্ষার্থীর পাশে বসে দেখে দেখে লিখে দেয়। ফলে ২০ নম্বরের মধ্যে ১০-১২ পেয়ে থাকে। ফলাফল শূন্য। কিন্তু যখন প্রথম সাময়িক পরীক্ষা নেওয়া হয় তখন একটা পাঠ্যবইয়ের তিনভাগের একভাগের ওপর মূল্যায়ন করা হয়। তখন শিক্ষার্থীরা পুরো সিলেবাসটুকুই রিভিশন করে পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য এবং তারা বইয়ের সব পাঠগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেয়ে থাকে। আমি একজন শিক্ষক, তাই আমি চাই, আবার আগের মতো করে পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হোক। শিশুরা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পরবর্তী শ্রেণিতে উন্নীত হোক। আবার শিশুরা হাতে বোর্ড কলম/পেন্সিল নিয়ে অভিভাবকের হাত ধরে নির্দিষ্ট সময় পরীক্ষা কেন্দ্রে আসুক। পরীক্ষাভীতি নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মেধা যাচাইয়ের মাধ্যমে উত্তরোত্তর বিকশিত হোক আমাদের শিশুরা। প্রধান শিক্ষক মধ্য গোপালরায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কালীগঞ্জ, লালমনিরহাট।