একজন সরকারি চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীর জন্য বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) ক্যাডার হওয়া যেন সোনার হরিণ। লাখ লাখ তরুণের স্বপ্নের ঠিকানা এটি। কঠোর অধ্যবসায় আর পরিশ্রমের পর সেই স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন রংপুরের ছেলে মুহা. জোনায়েদ হাবিব। ৩১তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে যখন প্রহর গুনছিলেন যোগদানের, তখনই হাতছোঁয়া দূরত্বে এসে হয় স্বপ্নের সমাধি। পুলিশ ভেরিভিকেশনের মারপ্যাঁচে বাদ পড়ে যান প্রজ্ঞাপন থেকে, আটকে যায় নিয়োগ। এরপর কেটে গেছে প্রায় এক যুগ। অবশেষে সব বৈষম্য আর প্রতিহিংসার অবসান হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের পর কর্মস্থলে যোগদান করলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) প্রাক্তন এই শিক্ষার্থী।
গত ১ সেপ্টেম্বর কুড়িগ্রাম জেলার সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হিসেবে শুরু করেন নতুন কর্মজীবন। এর মধ্যে ৩৮তম বিসিএসে নন ক্যাডার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হলেও যোগদান করেননি। দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত ছিলেন ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন পদে।
জোনায়েদ হাবিব বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষে। ২০১০ সালে কৃষি অনুষদ থেকে স্নাতক ও উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ থেকে ২০১২ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তার ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। সেই লক্ষ্যে শুরু করেন যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে সরকারি কর্ম কমিশন ৩১তম বিসিএস পরীক্ষার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। একই বছরের মে মাসে প্রিলি ও সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন হাবিব। কিন্তু এরপরের অভিজ্ঞতাগুলো মোটেই সুখকর ছিল না তার জন্য। মুখে দাড়ি থাকার জন্য মৌখিক পরীক্ষায় অপ্রাসঙ্গিকভাবে রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় তাকে। এরপরও সেটি উতরে যান তিনি এবং ২০১২ সালের জুলাই মাসে কৃষি ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। কিন্তু কয়েক মাস পর প্রকাশিত প্রজ্ঞাপন থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে বাদ পড়ে যান হাবিব। মূলত রাজনৈতিক মতাদর্শের মিল না থাকা ও তৎকালীন সরকারের আজ্ঞাবহ না হওয়ার জন্যই নিয়োগবঞ্চিত হতে হয় তার মতো আরও অনেক শিক্ষার্থীকে। প্রচন্ড মানসিক যন্ত্রণার মধ্যেও সেসময় ধৈর্য ধারণ করেছিলেন হাবিব। যার ফলশ্রম্নতিতে শেখ হাসিনার পতনের পরপরই পেয়ে যান ১২ বছর আটকে থাকা নিয়োগের আদেশ, ঘুচে যায় তার মতো কয়েকশ' যুবকের প্রতি করা অবিচারের।
সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েও প্রজ্ঞাপন না পাওয়ার বিষয়টিকে জোনায়েদ হাবিব দেখছেন আওয়ামী সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাব হিসেবে। তার বাবার ইচ্ছা ছিল সন্তানকে বিসিএস ক্যাডার হিসেবে দেখার, কিন্তু সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি তার। গত বছর তিনি পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। আর এতে হাবিবের বুকে জমে চাপা কষ্ট আর অভিমান। সঙ্গে ব্যাচমেটদের থেকে ১২ বছর পিছিয়ে যাওয়ার আক্ষেপ তো আছেই। তাইতো এত বছর পর নিয়োগের আদেশ পেয়েও দ্বিধায় ভুগছিলেন হাবিব। তবে সব দ্বিধা সংশয় ভুলে অবশেষে যোগদান করলেন তিনি।
দীর্ঘ সময় বঞ্চনার তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে জোনায়েদ হাবিব বলেন, শুধু সরকারের পক্ষের লোক না বলেই এক যুগ ধরে অনৈতিকভাবে আমার নিয়োগ আটকে রাখা হয়েছিল। এত বছর পর যখন প্রজ্ঞাপন পেলাম তখনও খুব কষ্ট লেগেছিল আব্বার কথা ভেবে। বেঁচে থাকলে সবচেয়ে বেশি খুশি তিনিই হতেন। আমার সঙ্গে যা ঘটেছে, সেটি অবশ্যই অমানবিক। আমি যদি সঠিক সময় নিয়োগ পেতাম, তাহলে আজ অনেকদূর এগিয়ে যেতাম। আমার বিসিএস ক্যারিয়ার আজ অনিশ্চিত। আমি আমার ব্যাচমেটদের থেকে ১২ বছর পিছিয়ে গেছি। এই শূন্যতা পূরণ করতে পারব কিনা, জানি না।
নতুন বাংলাদেশে, সাম্যের বাংলাদেশে আর যেন কোন বৈষম্য না হয়, কাউকে যেন তার মতো সরকারের আক্রোশের শিকার হয়ে বিসিএস গেজেট বঞ্চিত করা না হয়, এমনটাই প্রত্যাশা করেন জোনায়েদ হাবিব। তিনি বলেন, একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব ধরনের মত ও পথের লোক থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। একজন শিক্ষার্থী প্রিলি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা পাস করার পরও তাকে নিয়োগ না দেওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। চব্বিশের ছাত্র-জনতার বিপস্নবের মূল চেতনা ছিল বৈষম্যহীন দেশ গঠন। সেই উদ্যমের আলোকে বলতে চাই, কোনো শিক্ষার্থী, সে যে মতেরই হোক না কেন, তার বিসিএস নিয়োগের প্রজ্ঞাপন যেন আটকানো না হয়, কেননা, এটার কষ্ট ভুক্তভোগী হিসেবে আমি বুঝি।