বাকৃবিতে বিজয়োলস্নাসের কাঙ্ক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ

প্রকাশ | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

মুসাদ্দিকুল ইসলাম তানভীর
২৯ আগস্ট তারিখটা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ইতিহাসে স্মরণীয় একটি মুহূর্ত হয়ে থাকবে। মাত্র দশ দিন আগেই বিশ্ববিদ্যালয় পা দিয়েছে ৬৪ বছরে, জন্ম দিনে সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় নতুন বাংলাদেশে নতুন করে ক্যাম্পাসকে গড়ে তোলার প্রত্যয়ের বাস্তব প্রতিফলন হলো এদিন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে শিক্ষার্থীদের দাবি করা ১১ দফার সবগুলো মেনে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনার পরই যৌক্তিক সব দাবি মেনে নেয়ার অঙ্গীকার করেন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক খন্দকার মো. মোস্তাফিজুর রহমান। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষার্থীদের আস্থার প্রতিদান দিতেও সক্ষম হয় বাকৃবি। উৎসুক শিক্ষার্থীরা এসময় শুরু করেন বিজয়োলস্নাস। ৫ আগস্টের পর এমন আরেকটি মাহেন্দ্রক্ষণ এলো বাকৃবি শিক্ষার্থীদের, যা রচনা করল আরেকটি বৈষম্য মোচনের দৃষ্টান্ত। যার শুরুটা আগের দিন রাত থেকে। শিক্ষার্থীদের বহু দিনের না পাওয়ার আক্ষেপ আর ছাত্রলীগের একচেটিয়া রাজনীতির অপব্যবহারের চাপা ক্ষোভ পেছনে ফেলে নতুন দিনের সুন্দর পরিচ্ছন্ন ক্যাম্পাস বিনির্মাণের প্রত্যাশায় বুক বেঁধেছিল বাকৃবি শিক্ষার্থীরা। তবে কবে ক্লাস-পরীক্ষা চালু হবে, হলের সিট কিভাবে বণ্টন হবে, ছাত্ররাজনীতির পক্ষ-বিপক্ষসহ একাধিক বিষয়ে অনিশ্চয়তা তখনো কাটেনি। এরই মাঝে ২৮ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভা, যা নিয়ে কৌতূহল আর উত্তেজনার পারদ বাড়তে থাকে ক্যাম্পাসে অবস্থানরত প্রতিটি শিক্ষার্থীর মনে। সিন্ডিকেট সভা শেষে আলোচনার সিদ্ধান্তগুলো রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ড. মো. হেলাল উদ্দীন স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত হয়, যেখানে ক্লাস শুরুর তারিখ ঘোষণা হলেও ক্যাম্পাসে রাজনীতি বন্ধের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত উলিস্নখিত হয়নি। তাই তো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরপরই ক্ষোভে ফেটে পড়ে শিক্ষার্থীরা। রাত ৯টার দিকে আবাসিক প্রতিটি হল থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করে। এরপর তারা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে আব্দুল জব্বারের মোড়ে একত্রিত হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। অতঃপর উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয় সহস্রাধিক শিক্ষার্থী। এসময় স্স্নোগানে স্স্নোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো ক্যাম্পাস। আড়াই ঘণ্টা আন্দোলনের পর মধ্যরাতে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় প্রশাসন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাকৃবিতে সকল প্রকার রাজনীতি বন্ধের ঘোষণা দিয়ে সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। কিন্তু এখানেই থেমে যায়নি শিক্ষার্থীরা। তারা উত্থাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারের ১১ দফা। যার মাধ্যমে ঘটবে স্থায়ী মুক্তি, প্রতিফলন হবে শিক্ষার্থীবান্ধব ক্যাম্পাস বিনির্মাণের প্রতিশ্রম্নতির। দাবিগুলো হলো- পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল প্রকার শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম চালু করতে হবে; বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ও পিএইচডি ডরমেটরি আগামী ৩১ আগস্ট থেকে খুলে দিতে হবে; বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সব ধরনের দলীয় ও ছায়া সংগঠন ভিক্তিক রাজনীতি স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে; বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর সকল সিদ্ধান্ত সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে গ্রহণ করতে হবে; সকল অনুষদে শিক্ষা এবং গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে ডিন কাউন্সিল কর্তৃক সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে এবং অতিদ্রম্নত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (বাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন দিতে হবে; বিগত স্বৈরাচার সরকারের যারা দোসর ছিল তাদেরকে গণতদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে দ্রম্নত বিচারের আওতায় আনতে হবে; আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে কোন প্রকার হয়রানিমূলক আচরণ করা যাবে না; প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্র্ণ পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে এবং তাদের কোন দলীয় পরিচয় থাকা যাবে না; বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে নারী নিরাপত্তা ও নিপীড়ন বিরোধী সেল গঠন করতে হবে এবং কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে; বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল র?্যাগিং, গেস্টরুম, চাঁদাবাজি, সিট-বাণিজ্য নিষিদ্ধ করতে হবে; বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে সেশনজট মুক্ত করতে দ্রম্নততার সাথে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। রাত ৩টার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা হলে ফিরে আসে পরবর্তী দিনের কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে। ১১ দফা দাবি আদায়ে পরের দিন বৃহস্পতিবার বেলা এগারোটা থেকে প্রশাসনিক ভবনের সামনে আবারও শুরু হয় আন্দোলন। এরপর বিকাল ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষকদের সাথে আলোচনায় বসেন শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি দল। সেখানেই আসে কাঙ্ক্ষিত বিজয়ের ক্ষণ। সবগুলো দফা মেনে নেয়ার ও বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তে সফলতা পায় বাকৃবি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের প্রতিটি দাবি যৌক্তিক এবং প্রশাসন তাদের দাবির সাথে একমত। কালবিলম্ব না করে দ্রম্নততার সাথে এটি প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত হবে। শিক্ষার্থীরা তাদের যেকোনো সমস্যায় সরাসরি আমার কাছে চলে আসতে পারবে। কারণ ক্যাম্পাসে তাদের অগ্রাধিকার সর্বপ্রথম। হাজারো রক্তস্রোত পেরিয়ে ছাত্রদের হাত ধরে যে বিজয় অর্জিত হয়েছিল, দেশের সকল ক্ষেত্রে বৈষম্য মোচনের মাধ্যমে সেটি পাবে পূর্ণতা। ছাত্রদের তথা তরুণদের হাত ধরেই গড়ে উঠবে নতুন ক্যাম্পাস, নতুন দেশ, নতুন ইতিহাস। যেখানে থাকবে না ছাত্র রাজনীতির কোন অপছায়া, থাকবে না নির্যাতন আর বঞ্চনার গল্প, শিক্ষা গবেষণায় সর্বোচ্চ মননিবেশ করে শিক্ষার্থীরা এগিয়ে যাবে তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে।