কাশবনের ভেতর দিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে অপু আর দুর্গা। সাদা কাশফুলগুলো উড়ছে বাতাসে। দূরে শোনা যাচ্ছে ট্রেনের হুইসেল! ট্রেন আসছে। ওরা ট্রেন দেখবে বলে কাশফুল মাড়িয়ে পৌঁছেছিল ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে দৃষ্টি থেকে বেরিয়ে গেছে ট্রেনটি।
কাশফুলের কথা মনে পড়লে কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস 'পথের পাঁচালী' অবলম্বনে নির্মিত উপমহাদেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী' চলচ্চিত্রের এই দৃশ্যের কথা মনে পড়ে যায়।
ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি তার রূপেও পরিবর্তন আনে। উত্তাল বর্ষা শেষে শরৎ নিয়ে শান্তির প্রতীক শুভ্রতা। 'সবে মাত্র এই বর্ষা গেল শরত এলো মাত্র/এরই মধ্যে শুভ্রকাশে ভরলো তোমার গাত্র' নির্মলেন্দু গুণের 'কাশফুলের কাব্য' থেকে নেওয়া এ পঙক্তিটি যেন তারই বহিঃপ্রকাশ।
পরিষ্কার নীল আকাশ আর সাদা কাশফুল শরৎকে দিয়েছে অন্যরকম মাহত্ম্য। এ জন্যই শরৎকে বলা হয় ঋতুর রানী। শারদ বিকালে একগুচ্ছ কাশফুল স্নিগ্ধতার পরশ বুলিয়ে যায়, হাতের স্পর্শ পৌঁছে যায় হৃদয়ে। প্রযুক্তির এই যুগে প্রকৃতি শুধু উপভোগের বিষয় না। উপভোগের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে স্মৃতি ধরে রাখার প্রবণতা। তাই বিকাল হলেই দেখা যায় তরুণ-তরুণীরা বাহারি রঙের শাড়ি-পাঞ্জাবিতে সেজে কাশফুলের সঙ্গে ছবি তোলার দৃশ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষ্ণচূড়া রোড থেকে যখন চারপাশে চোখ পড়ে তখন মনে হয় কোনো শুভ্র শাড়িতে জড়িয়ে আছে ছোট-বড় টিলাগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, শহীদ মিনারের চারপাশ, কেন্দ্রীয় মসজিদের চারপাশ ও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন চত্বর কাশফুলের শুভ্রতায় ছেয়ে গেছে। ক্যাম্পাসের চারপাশের কাশফুলের সৌন্দর্য মুগ্ধ করছে শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সবাইকে। দূর-দূরান্ত থেকে তরুণ- তরুণীরা নানান সাজে এই কাশফুল দেখতে আসে। সাধারণ শিক্ষার্থী ছাড়াও বহিরাগত দর্শনার্থীদের আনাগোনাও বেড়েছে।
কুবির বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী নাঈম মিয়া বলেন, কৃষ্ণচূড়া লাল হয়ে যেমন বসন্ত আসে তেমনি সাদার শুভ্রতা নিয়ে হাজির হয় শরৎ। মাঠে মাঠে কাশফুল আর নীল আকাশে নরম তুলোর মতো সাদা মেঘ জানান দেয় শরৎকালের। এই সময় কুমিলস্না বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট্ট ছোট্ট সবুজ টিলাগুলোও কাশফুলে সাদা হয়ে ওঠে, দেখে মনে হয় যেন সাদা মেঘ মাটিতে খেলা করছে। আর সেই সাদা মেঘগুচ্ছ দেখতে প্রকৃতিপ্রেমী শিক্ষার্থী সবাই দলে দলে ভিড় জমায় সেখানে। প্রতিদিনের যান্ত্রিক জীবনে কুবির কাশফুল হয়ে ওঠে একটু প্রশান্তির উৎস!'
এছাড়াও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী উম্মে হাবিবা মৌ বলেন, 'আমাদের লালমাটির ক্যাম্পাসে প্রতিবছর শরৎকালের এই সময়ে সাদা কাশফুল সমারোহ করে ফুটে। এবারেও তার ব্যতিক্রম নয়। এই ফুল আমাদের ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।'
কাশফুল যেমন প্রকৃতির সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়, তেমনি কাশফুলের আয়ুর্বেদীয় গুণাগুণও রয়েছে। কাশফুলের উপকারের সীমা কেবল পানের বরজ, ঘরের চালা বা সবজিবাগানের বেড়া হিসেবেই নয়, বরং এটি মাটিধস রোধ করতেও চাষ করা হয়। আখের অঙ্কুরোদ্গম ছাড়াও বিশেষ ধরনের কাগজের মন্ডুও তৈরি করা হয় কাশ থেকে।
সব মিলিয়ে কাশফুল কেবল শরতের মুগ্ধতার প্রতীকই নয়, আমাদের জীবনযাত্রার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে কাশের জীবন।