বাবার অনুপ্রেরণায় মানবিক হলেন যিনি
প্রকাশ | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বোরহান উদ্দিন
ছোটবেলা থেকে শাকিল তার বাবাকে দেখেছেন মানুষের বিপদে এগিয়ে যেতে। সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করতে। বাবার এমন মানবিক কাজ দেখে প্রতিনিয়ত হৃদয়ে কড়া নাড়ে। সংসারে অভাব অনটনের ভেতর বাবাকে নিঃস্বার্থভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখেছেন। তখন থেকেই শাকিল স্বপ্ন দেখত কখনো সুযোগ পেলে তিনিও তার বাবার মতো ভালো কিছু করবেন, মানুষের বিপদে পাশে থাকবেন, তাদের সাহায্য করবেন।
শাকিল যখন ১৮ বছর বয়সে পা রাখল, ঠিক তখনই তার সুযোগ এলো নিঃস্বার্থভাবে রক্তদানের মাধ্যমে মানুষের সেবা করার।
রক্তের জন্য কান্না করতে ছিল মধ্য বয়স্ক একজন নারী। আশেপাশে অনেক মানুষ থাকলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। মধ্য বয়স্ক নারী কান্নারত অবস্থায় বলছিল ডাক্তার বলেছে এখনই রক্ত দিতে না পারলে তার মুমূর্ষু মাকে (ক্যানসার আক্রান্ত) বাঁচানো সম্ভব হবে না। বিষয়টি গভীরভাবে দাগ কাটে পাশেই থাকা এক যুবকের। দিনটিতে ছিল তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা (২০১৭)। কোনো কিছু না ভেবেই মুমূর্ষু রোগীকে রক্ত দিতে ছুটে যায় হাসপাতালে। রক্ত দেওয়ার পর হাসপাতাল থেকে তড়িঘড়ি করে রওনা হয় পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। কিন্তু সঠিক সময়ে উপস্থিত হতে না পারায় পরীক্ষা দেওয়া তার সম্ভব হয়নি- বলছিলাম সাতক্ষীরা জেলার দরগাহপুর গ্রামের মো. আব্দুল কাদেরের ছোট ছেলে শাকিলের (২৬) কথা।
গল্পটি ছিল ২০১৭ সালের, জীবনের ১মবারের মতো রক্তদানের অনুভূতি অর্জন করেন শাকিল? এরপর থেকে শুরু হয় মানবিক কাজ নিয়ে তার পথচলা। মানবিক কাজের জন্য সংগ্রাম মোটেও সহজ ছিল না। রক্তদানের পর দীর্ঘদিন অসুস্থতার বোঝা শরীরকে টানতে হয়। তবুও তিনি দমে যাননি।
এরপর ২০১৮ সালে শাকিল সাতক্ষীরা থেকে চলে আসেন ঢাকায়, ভর্তি হয় রাজধানী ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত সরকারি বাঙলা কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগে (২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ)। ক্যাম্পাসের আশপাশে অবস্থিত প্রায় ডজনখানেক হাসপাতাল থেকে রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা রক্তদাতা খোঁজার জন্য বাঙলা কলেজের ক্যাম্পাসে আসত। এসব ঘটনা শাকিলের নজরে প্রতিনিয়ত পড়তে থাকল। মুমূর্ষু রোগীদের জন্য কী করা যায়? তখন শাকিলের স্মার্ট ফোন ছিল না। শাকিল চিন্তাভাবনা করলেন রক্তের জন্য রোগীর স্বজনরা ক্যাম্পাসে এলে নিঃস্বার্থভাবে ?রক্ত জোগাড় করে দিয়ে পাশে দাঁড়াবেন। বাবার সহযোগিতায় কম দামি একটা স্মার্ট ফোন কিনে নিজ উদ্যোগে অনলাইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করলেন রক্তের সংগঠন। নামকরণ করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের নাম অনুসারে '৭ কলেজ বস্নাড অর্গানাইজেশন'। যেখানে নিঃস্বার্থভাবে শ্রম দিচ্ছেন ৭ কলেজের স্বপ্নবাজ শিক্ষার্থীরা। এরপর থেকে ক্যাম্পাসে প্রতিদিন রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা আসলে তাদের বিনামূল্যে রক্তের ব্যবস্থা করে দিত শাকিল ও তাদের টিম।
'৭ কলেজ বস্নাড অর্গানাইজেশন' গত ৬ বছর ধরে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মানবসেবায় নিয়োজিত রয়েছে। রক্তের গ্রম্নপ নির্ণয়, রক্তদানের আহ্বান, সচেতনতার বার্তা, মুমূর্ষু রোগীকে রক্তদাতা জোগাড়সহ বিভিন্ন জনকল্যাণমুখী কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটি। গরিব, অসহায় ও অভুক্তদের জন্য ২০২০ সাল থেকে 'রুটি দিবস' বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে তারা। অন্তত একটা দিন যাতে গরিব ও অসহায়রা অভুক্ত না থাকে, পেটভরে খেতে পারে।
স্বেচ্ছাসেবী অঙ্গনে শাকিল এখন অনেকটাই পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন। নিজের মেধা, শ্রম ও বুদ্ধি দিয়ে দেশের ৬৪ জেলার ভলান্টিয়ারদের মাঝে নিজেকে পরিচিত করে তুলতে পেরেছেন। কোভিড-১৯ এর সময়ে নিজ এলাকায় অক্সিজেন সেবা ও অসহায়দের খাবার বিতরণের মতো মহান কাজেও শাকিল ছিলেন সক্রিয়।
বেকারত্বের মাঝেও নিজের কথা চিন্তা না করে প্রতিনিয়ত পথশিশুদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন। এসব ছিন্নমূল শিশুদের বিশ্বাস ও ভালোবাসা জয় করে তাদের বন্ধুতে পরিণত হয়েছেন। পথশিশুদের প্রতি এমন ভালোবাসা কীভাবে জন্ম নিল, সে বিষয়ে জানতে চাইলে শাকিল বলেন, ২০২০ সালের শেষের দিকে করোনা মহামারির মাঝে একদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এমন সময় হঠাৎ কয়েকজন শিশু আমার কাছে খাবার চাইল। ওদেরকে অভুক্ত অবস্থায় দেখে নিজের ভেতরে কেমন জানি একটা খারাপ লাগা কাজ করল। এরপর তাদের শাহবাগের এক হোটেলে নিয়ে পেটভরে খাওয়ানোর পর তারা আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার খুব ভালো লাগল মনে আত্মতৃপ্তি পেলাম। এই আত্মতৃপ্তির নেশায় আমিও প্রতিনিয়ত তাদের সাথে মিশতে থাকলাম। হঠাৎ ভাবলাম এদেরকে যদি পড়ানো হয় তাহলে কেমন হয়! অন্তত কিছুটা পড়াশোনা শিখতে পারলে কোথাও না কোথাও কাজ করতে পারবে। ফুল বিক্রি, পানি বিক্রি অথবা হোটেলে কাজ করতে হলেও হিসাব জানা দরকার। তারপর শুরু করলাম তাদের খোলা আকাশের নিচে পড়ানো। এভাবে তাদের সাথে আমার বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়।
বর্তমানে শাকিল সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের তিনটা স্কুলের (প্রত্যয় শিশু কেন্দ্র মজার ইশকুল ও জুম বাংলাদেশ স্কুল) মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত ও পথশিশুদের পাঠদানের মাধ্যমে শিশুদের সাথে ব্যস্ত সময় পার করছেন। ঢাকা শহরের দুই শতাধিক শিশুর কাছে শাকিল স্যার হিসেবে পরিচিতি হয়ে উঠেছেন। বিভিন্ন জেলায় ভলান্টিয়ার প্রোগ্রাম ও ফেসবুক ভিডিও বার্তার মাধ্যমে মানুষকে রক্তদানসহ বিভিন্ন মানবিক কাজে এগিয়ে আসার আহ্বানও জানান। বর্তমানে সব ধরনের মানবিক কাজের সাথে জড়িত শাকিল। যেকোনো ট্র্যাজেডি বা উত্তরবঙ্গের বন্যা, দক্ষিণ বঙ্গের ঘূর্ণিঝড়ের মাঝেও বেশ কয়েকবার বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ২০২২ সালে কোরবানির ঈদও পরিবার ছাড়া অপরিচিত বানভাসি কুড়িগ্রামে করেছে।