শিক্ষা যেখানে একটি জাতির মেরুদন্ড সেখানে অনেক শিশুই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর মূল কারণ পারিবারিক অসচ্ছলতা ও সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব। আলোকিত দেশ গঠনে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সমাজের অধিকার বঞ্চিত এইসব শিশুকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) একঝাঁক উদ্যমী তরুণ প্রতিষ্ঠা করেন বিনামূল্যে পাঠদান পস্ন্যাটফর্ম 'লুমিনারি'। মননশীল মানসিকতা আর মানবতার টানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আলো দিতে এগিয়ে যাচ্ছেন তারা।
'প্রতিটি শিশু মানুষ হোক আলোর ঝরনাধারায়' স্স্নোগানকে সামনে রেখে প্রায় ৯ বছর ধরে প্রশংসার সঙ্গে কাজ করে চলেছে 'লুমিনারি'। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সুবিধাবঞ্চিত ও অবহেলিত শিশুদের শিক্ষিত করে তোলার পাশাপাশি সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া। দিনে দিনে লুমিনারির কলেবর বেড়েছে কয়েকগুণ। মাত্র ৭ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশু নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে তাদের রয়েছে ১২০ জনের অধিক শিক্ষার্থী। সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার পাঠদান কার্যক্রম চালায় 'লুমিনারি'।
লুমিনারিতে গিয়ে প্রথমেই নজরে পড়ে আনন্দে ছুটে বেড়ানো, স্বতঃস্ফূর্ত অধ্যয়নরত একঝাঁক শিক্ষার্থী। বিকাল তিনটা থেকে পাঠদান শুরু হয়ে চলে সন্ধ্যা অবধি। শুধু পাঠদান নয়, নিজ অর্থায়নে এসব শিশুদের বই, খাতা, কলম, পেন্সিল এমনকি নাস্তারও ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও শিশুদের মানসিক বিকাশ সাধনে আয়োজন করে থাকেন খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কবিতা আবৃত্তি, অংকনসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতা। শুধু সুবিধা বঞ্চিতরাই নয়, অর্থের অভাবে কোচিং বা প্রাইভেট পড়তে না পারা এমন শিশুও এখানে বিনামূল্যে পাঠদান নিচ্ছে।
পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এছাড়া দেশপ্রেম, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, মুক্তিযুদ্ধ ও সাম্প্রতিক বিষয়সমূহ নিয়ে আলোচনা করা হয়। অভিভাবকদের প্রয়তা বৃদ্ধি করার জন্য প্রতি মাসে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে যায় লুমিনারি সদস্যরা। অভিভাবকদের পছন্দমতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানকে ভর্তি করাতে সহায়তা করেন তারা। এছাড়া ঈদের সময় ঈদ উপহার, শীতের সময় শীতবস্ত্র, বর্ষাকালে গাছের চারা বিতরণ করে সংগঠনটি।
লুমিনারির সভাপতি আশিকুল ইসলাম আরিফ বলেন, 'আমরা নোবিপ্রবি ক্যাম্পাসের আশপাশের গ্রামগুলোর সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়াও তাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলা, পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী করে তোলা, সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি, শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ এবং শিশুদের স্বাস্থ্যসম্মত অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের স্বেচ্ছাসেবক দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতনতা তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা ও শিশুদের পাঠদানের জন্য নির্দিষ্ট কোনো স্থান না থাকায় আমাদের প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দেশের প্রতিটি ক্যাম্পাসে লুমিনারির কার্যক্রম পরিচালিত হলে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত হবে। তাই আসুন আমরা প্রতিটি ক্যাম্পাসে একটি লুমিনারি প্রতিষ্ঠা করি।'
লুমিনারির সাধারণ সম্পাদক সুমাইয়া পান্না বলেন, লুমিনারি ২০১৫ সাল থেকে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এখানে শিশুদের নিয়মিত পাঠদানের পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলো শিখানো হয়। প্রথমে আমাদের সংগঠনটি ৭ জন শিশুদের নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল যা এখন শতাধিক। প্রতি সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিশুদের পাঠদান করানো হয়। এখানে একটা সময় ছিল আশপাশের এলাকার শিশুদের মধ্যে খুব জড়তা কাজ করত। ওরা যে কোনো প্রতিযোগিতামূলক কিছুতে অংশগ্রহণ করতে চাইত না। কিন্তু এখন ওদের মধ্যে জড়তা অনেকটাই কমে গেছে। চিত্রাঙ্কন, গান, আবৃত্তি, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, খেলাধুলাতে শুধু লুমিনারি না ওদের বিদ্যালয়েও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করছে পাশাপাশি শিক্ষাক্রমেও সুনাম অর্জন করছে। প্রতি মাসে আমাদের সদস্যদের মাধ্যমে শিশুদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলা হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কথায় আছে শিশুরা যেখানে জড়ো হয় সেখানেই আনন্দ বয়। লুমিনারিতে বাচ্চাদের শিখানো হয় কীভাবে আনন্দের মাধ্যমে পড়াশোনায় এগিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু নির্দিষ্ট কক্ষের অপ্রতুলতার জন্য বিভিন্নরকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় আমাদের সংগঠনটির। আমরা আশা করি, লুমিনারির প্রতিটি শিশু বেড়ে উঠুক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে, যেন তারা একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পায় এবং এগিয়ে যাক আমাদের প্রাণের লুমিনারি তার অনিন্দ্য ঝরনাধারায়।