তিন 'প' তে অনন্য সিলেট
প্রকাশ | ৩১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
মোহাম্মদ মারুফ মজুমদার
'চিত্ত হিয়ায় বাজিছে আজি নিত্য কলতান' বৃষ্টিস্নাত বাংলাদেশের লন্ডনখ্যাত সিলেট তথা তিনশত ষাট আউলিয়ার শান্তির শহরে টানা দুই দিনের মুগ্ধ জাগানিয়া পর্যটন স্থানের সৌন্দর্যমন্ডিত রস সিঞ্চন করার নির্ভেজাল আবেগ শব্দে বর্ণনা করা নির্ঘাত দায়!
কি নেই সিলেটে? স্রষ্টার অপরিসীম মহিমায় সিলেটকে তার আপন সৌন্দর্যে সিক্ত হওয়ার সবকটি গুণ দিয়ে গুণান্বিত করে রেখেছেন। প্রকৃতির নীরব সৌন্দর্য, সুনসান দিগ্বিদিক, তরুলতায় ঘেরা সিলেট তথা শান্তির শহরের যথার্থতা বুঝতে বাকি থাকবে না আগত আমাদের মতো ভ্রমণপিয়াসী পর্যটকদের। শুরুতে ক্রমানুসারে সাদা পাথর, রাতারগুল ও জাফলংয়ের সালংকারকৃত বর্ণনা করি।
সাদা পাথর
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পাথর কোয়ারি অঞ্চল হচ্ছে ভোলাগঞ্জ। সাদা পাথর হচ্ছে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ভারতের মেঘালয়ের কোলে ভোলাগঞ্জে অবস্থিত। বলে রাখি, ভোলাগঞ্জ জিরো পয়েন্ট বা সাদা পাথর হলো ধলাই নদীর উৎসমুখের পাথরবেষ্টিত জায়গা। বাংলাদেশে প্রবেশের পর এই ধলাই নদী দুটি ভাগে ভাগ হয়ে মাঝে ভোলাগঞ্জকে ঘিরে পরে আবার মিলিত হয়েছে। ফলে সমগ্র এলাকাটি অনেকটা বদ্বীপের মতো দেখতে। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণার স্রোত মিশেছে ধলাই নদীতে। স্বচ্ছ-সফেদ পানিতে গা এলিয়ে স্রোতে ভেসে আপনি এখানে উপভোগ করতে পারবেন সবুজ পাহাড় আর সাদা মেঘের আনাগোনা। এই নদীর স্রোতে ভেসে আসা পাথর উত্তোলনের কাজে মগ্ন স্থানীয়দের ব্যস্ততা দেখে কেটে যাবে অনেকটা সময় এবং ছোট নৌকায় করে পাথর সংগ্রহ করা এখানে বহু মানুষের জীবিকা। এ ছাড়া ভোলাগঞ্জ সীমান্তের ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন দিয়ে বাংলাদেশে চুনাপাথর আমদানি করা হয়। এখানে শত শত ট্রাকে চুনাপাথরবাহী ট্রাক নজরে পড়বে। লক্ষণীয়, সাদা পাথরের কাছেই রয়েছে উৎমাছড়া, তুরুংছড়া নামের চমৎকার দুটি জায়গা। কিন্তু বর্ষাকাল ছাড়া এখানে তেমন পানি থাকে না বিধায় যাওয়ার জন্য এই মৌসুমটাই উত্তম।
রাতারগুল
চারদিকজুড়ে সুনসান-নীরব-নিস্তব্ধতা, খেয়া নৌকার বৈঠার সঙ্গে টইটম্বুর থৈ-থৈ পানির প্রেমময়ী মিতালীর সংঘর্ষে মাখা শব্দ কানে ঘুন ঘুন করে। বিমোহিত না হয়ে জো নেই-বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির 'ফ্রেশওয়াটার সোয়াম্প ফরস্টে' বা জলাবন, রাতারগুল দেখলে। তরুলতায় ঘেরা সবুজ প্রকৃতি তার সবটুকু মায়া দিয়ে পূর্ণ করেছে এই রাতারগুল। অনেকে বাংলার আমাজন বলতেও দ্বিধা করেন না।
প্রসঙ্গত বলি, সিলেটের সীমান্তর্বতী উপজেলা গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর ইউনিয়নে অবস্থিত এই বনের দূরত্ব সিলেট শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার।
এই বনটির আয়তন ৩,৩২৫.৬১ একর এবং এর মধ্যে ৫০৪ একর অঞ্চলকে ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণীদের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
রাতারগুল বছরে দুই রকম দৃশ্যের উপস্থিত লক্ষ্য করা যায়। শুকনো মৌসুমে এবং বর্ষার সময়। বর্ষার সময় এই বনের গাছগাছালির বেশিরভাগ অংশই পানির নিচে থাকে। সে সময় এই বন ২০-৩০ ফুট পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে। ঘোরা যায় ছোট ডিঙি নৌকায় করে বনটি। মাঝে মাঝে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা নিস্তব্ধ এই বনের প্রকৃতিকে করে তোলে আরও রঙিন। এই রাতারগুলের অনিন্দ্যসুন্দর এই রূপটাই পর্যটকদের টেনে নিয়ে আসে দূর-দূরান্ত থেকে।
জাফলং
সারিবদ্ধ চা বাগান, চারদিকে সবুজের সমারোহ, উঁচু-নিচু পাহাড়-টিলা, গহিন অরণ্য, মায়াবী ঝরনাধারা, খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়, পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা পিয়াইন নদের স্বচ্ছ পানির ধারা, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ, উঁচু পাহাড়ে সাদা মেঘের খেলা সিলেটের গোয়াইনঘাটে অবস্থিত জাফলংকে করেছে অনন্য।
গোধূলির আকাশ ঘন আবহে কতক কৈশোরের উদ্যামতা লক্ষ্য করা যায় সিলেট, জাফলংয়ের পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ নির্মল পানি, পাহাড়ের সঙ্গে লেগে থাকা বিশাল পাথরখন্ড, নদীর পানিতে পড়ে থাকা পাথরের স্তূপ; যা পর্যটকের মনে ভাব-আবেগের এক তরঙ্গজোয়ার সৃষ্টি করে।
পথের গল্পে বলি। এই ভ্রমণে সফরসঙ্গী সাতজন (নাজিব, জীবন, মারুফ, মারজান, মিশেল, আকিব, মোবারক)। চট্টগ্রাম থেকে সিলেট যাওয়ার মোক্ষম সময় রাতে, ট্রেনে করে। চৌদ্দটি টিকিট (১৬-১৮ আগস্ট) কেটেছি আসা-যাওয়া মিলে উদয়ন এক্সপ্রেসে। ব্যস! যথারীতি সবাই নিজেদের তল্পিতল্পা গুছিয়ে চট্টগ্রাম স্টেশনে রাত ৯টা বাজে পৌঁছাই। ট্রেন ছাড়ে সাড়ে ৯টায়। চলার পথিমধ্যে কিছু সময় নিজেদের মধ্যে খোশমেজাজে ঝটিকা খোশগল্প করে যে-যার মতো করে তন্দ্রাঘোরে নিমজ্জিত হয়ে যাই; যদিও পরিতৃপ্ত ছিলা না বইকি।
মাত্র দুই দিনে সিলেটের সাদা পাথর-ভোলাগঞ্জে পাথর ভাঙ্গা-ঢাকা গাঙ্গু সুনামগঞ্জ-সুরমা নদী- মুজিব হাইটেক পার্ক-ওসমানী বিমানবন্দর-ক্যাডেট কলেজ-মালনীছড়া চা বাগান-শহরের শাহী ঈদগাহ-শাবিপ্রবি-সুবিখ্যাত পানসী রেস্তোরাঁয় ভূরিভোজন, দরগাহ পরিদর্শন, রাতারগুল-তামাবিল-আগুন পাহাড়-সারীনদী-জাফলং; যেখানে রয়েছে জিয়াইন নদী, মায়াবী ঝরনা, ডাউকি শহর, জিরো পয়েন্ট। একেক জায়গার রূপ শব্দে বর্ণনা নেহায়ত উপন্যাস তুল্য হওয়ার দ্বারপ্রান্তে চলে যাওয়ার আশঙ্কা প্রচ্ছন্ন! সিলেট যেন তিন 'প'তে অনন্য; পাথর, পানি ও পাহাড় এবং চা বাগান।
টানা ৯-১০ ঘণ্টার ট্রেন ভ্রমণ শেষে প্রভাতে সিলেট রেলস্টেশন নেমে পড়ি। সুনিপুণ কারুকাজে সজ্জিত শ্বেতকায় ইমারতের এই স্টেশনটি। কিছু দূর হেঁটে দুটি সিএনজি রিজার্ভ করে আম্বরখান মোড়ে যাই; যেখান থেকে সবদিকে অনায়াসে যাওয়া সহজ হবে। সিএনজি থেকে নেমে হোটেল হিমেলে দুটি রুম ভাড়া করি। ফ্রেশ হয়ে খানিকক্ষণ বাদে সকালের নাস্তা শেষে রওনা হই সাদা পাথর দেখার নিমিত্তে। হামেশাই টিভিতে, বস্নগে সাদা-শুভ্র পাথর দেখলেও কাছ থেকে, স্পর্শ করে, দেখার স্বাদ অবর্ণনীয়। দেরি না করে, সিএনজি ভাড়া করলাম। ভ্রমণের শুভ সূচনা। তরুলতায় আচ্ছাদিত সুবিশাল পাহাড়গুলো সৌন্দর্য যেন ফ্রেমবন্দিতুল্য। সেকি উলস্নাস সবার! সবারই প্রথম ভ্রমণ।
প্রথম যেকোনো কিছুই রোমাঞ্চকর। নির্ধারিত পোশাক পরিধান করে যে-যার মতো পাথর দেখা, স্পর্শ করা, বসা। ঝরনার সফেদ জলরাশির সঙ্গে দুর্নিবার মিতালি, সাতার কাটা, ছবি তোলা-সব মিলিয়ে প্রকৃতি শীতল আবহের স্বাদে, জলরাশিতে টইটম্বুর ছিল সাদা পাথর, রাতারগুল ও জাফলং। ভ্রমণ শেষে টক টক ট্রেনের শব্দে রাতে রওনা দিয়ে ঘরে ফেরা পাখির মতো প্রভাতেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে যাই। সঙ্গে করে নিয়ে আসি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। এমন দিন বারংবার আসুক জীবনে।