শাহ মখমুদ হলের নামকরণ হযরত শাহ মাখদুম (র.) নামানুসারে

প্রকাশ | ১৭ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

মোহাম্মদ আলী
ইসলাম মহান আলস্নাহ তায়া'লার মনোনীত একমাত্র ধর্ম। ইসলাম প্রচারের জন্য আলস্নাহ তায়া'লা যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রাসুল দুনিয়ায় প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো নবী ও রাসুল আসেননি। আমাদের দেশে আউলিয়ায়ে কেরাম ইসলাম প্রচার করেছেন। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন জন ইসলাম প্রচার করেন। রাজশাহী অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের কাজ করেন হযরত শাহ মখদুম (র.)। রাজশাহী তখন মহাকালগড় নামেই পরিচিত ছিল। মহাকালগড় শাসন করতেন তৎকালীন সামন্তরাজ কাপলিক তন্ত্রের বিশ্বাসী দু'ভাই। তাদের অত্যাচারী শাসন ব্যবস্থায় জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন এবং নরবলি দেওয়ার মতো কুপ্রথার প্রচলন ছিল। তাদের এসব কুসংস্কার উচ্ছেদ করতে আগমন ঘটেছিল শাহ মখদুম নামে এক সুফি সাধক ও ইসলাম প্রচারকের। ওনার প্রকৃত নাম আব্দুল কুদ্দুস। ধর্ম ও জ্ঞান সাধনায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্য বিভিন্ন সময়ে তার নামের সাথে শাহ মখদুম বা শাহ মখদুম রূপোশ ইত্যাদি উপাধি যুক্ত হয়। মূলত মখদুম আরবি শব্দ। যার অর্থ ইসলামি শাস্ত্র বিষয়ে শিক্ষক বা আধ্যাত্মিক গুরু। আর রূপোশ ফার্সি শব্দ যার অর্থ মুখ আবরণকারী ব্যক্তি। কথিত আছে যে, তিনি কালো পাগড়ি দ্বারা মুখ ঢেকে রাখতেন সেজন্য রূপোশ উপাধি প্রদান করা হয়েছিল। ইতিহাসে তিনি শাহ মখদুম রূপোশ নামেই প্রসিদ্ধ। শাহ মখদুম (র.) ইরাকের বাগদাদ নগরীর এক বিখ্যাত সুফি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হযরত আলী (রা.) এর বংশধর এবং বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানি (রহ.)-এর নাতি। বাল্যকাল থেকেই শাহ মখদুমের মাঝে তীক্ষ্ন মেধা ও অসাধারণ প্রতিভার বিকাশ ঘটে। অতি অল্প বয়সে তিনি কুরআন, হাদিস, ফিকহ্‌, আরবি ভাষা ও ব্যাকরণ এবং সুফিতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী হয়ে উঠেন। উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য সিন্ধুতে বিখ্যাত সুফি জালাল উদ্দীন শাহ সুরের মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে ইসলামের উচ্চতর বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। সেখানে তিনি উন্নত যোগ্যতা ও ইজতেহাদি শক্তি অর্জনের মাধ্যমে কাদেরিয়া তরিকার সিদ্ধ পুরুষে পরিণত হন। সে সময় তাকে 'মখদুম' খেতাবে ভূষিত করা হয় যার ভাবার্থ ইসলামি শাস্ত্রবিষয়ে আধ্যাতিক গুরু। তিনি হযরত আব্দুল কাদির জিলানি (র.)-এর কাছ থেকে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে ইসলাম প্রচারার্থে কিছু সংখ্যক অনুচর নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। প্রথমে নোয়াখালীর শ্যামপুর নামক গ্রামে আস্তানা স্থাপন করে ইসলাম ধর্ম প্রচার কাজ অব্যাহত রাখেন। তাঁর অনুপম চরিত্র আর ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে শত শত মানুষ ইসলামের ছায়াতলে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। নোয়াখালীতে দুই বছর ইসলাম প্রচারের পর খবর পেলেন যে, গৌড়ে তার প্রাণপ্রিয় শিষ্য তুরকান শাহ ইসলাম প্রচারকার্যে মারা যান। এ সংবাদ প্রাপ্তির পর তিনি কিছু সঙ্গীসাথী নিয়ে গৌড়ের উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় এসে অবতরণ করেন। এই অঞ্চল তখন মহাকালগড় নামে পরিচিত ছিল। দেওরাজদ্বয় এই মহাকালগড় শাসন করতেন। তাদের অত্যাচারী শাসন ব্যবস্থায় জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। সেকালে মহাকালগড়ে দেওরাজরা নরবলি দিয়ে পূজা করত। এমনকি নরবলি দেওয়ার জন্য মানুষকে জোর করে ধরে আনত অথবা ক্রয় করে আনত। অনেকে স্বেচ্ছায় নরবলি দিত। কারো সন্তান না হলে মানত করত যে সন্তান জন্মলাভ করলে একটা বলি দেবে। অনেকে ঐ সময় মানত নিয়ে এসে নরবলি দিত। শাহ মখদুম (র.) এমন কুসংস্কার ও শিরকপূর্ণ প্রথাকে উচ্ছেদ করে সেখানে ইসলাম প্রচার করেছিলেন। রামপুর বোয়ালিয়ায় এক নাপিতের তিন পুত্রছিল, প্রথম দুই পুত্রকে দেওরাজ বলি দিয়ে তৃতীয় পুত্রকেও বলি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে নাপিত শাহ মখদুম (র.)-এর নিকট গিয়ে নালিশ জানালে তিনি তাকে সন্তানসহ পদ্মা নদীর তীরে উপস্থিত থাকার জন্য নির্দেশ দেন এবং বলেন যে তিনি সেখানে যথা সময়ে উপস্থিত হবেন। নাপিত দম্পতি তাদের সন্তানসহ নদীতীরে উপস্থিত হয়ে দিবারাত্রি ধরে কাঁদতে থাকে এবং শাহ মখদুমের সন্ধান না পেয়ে নদীতে ডুবে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় এমন সময় ভয় নেই, ভয় নেই বলে কুমিরের পিঠে সাওয়ার হয়ে শাহ মখদুম নাপিত দম্পতির কাছে উপস্থিত হন এবং তার সন্তানের গলদেশে হাত বুলিয়ে ফুঁ দেন এবং গিগগিরই দেবরাজ ধ্বংস হয়ে যাবে বলে জানান। তিনি আরও বলেন যে, তার পুত্রের বলি হবে না এবং একথা প্রকাশ না করার জন্য বলে তিনি কুমিরের পিঠে চড়ে ফিরে চলে যান। পরদিন সকালে নাপিতের পুত্রের গলায় অজস্র খড়গের আঘাতেও বলি দিতে সক্ষম হলো না। এই সংবাদ দেওরাজের কানে গেলে তিনি বললেন এই নরের দোষ আছে, তাকে ছেড়ে দাও। এভাবে শাহ মখদুম (র.) দেওরাজদের প্রতিটি যুদ্ধে পরাজিত করেন। এই সময়ে দেওরাজদের সাথে শাহ মখদুম তিনবার যুদ্ধ করে প্রতিবারই মহাকালগড় বিজয় করেছিলেন। দেওরাজরা পরাজিত হয়ে রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে চলে যায় এবং অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মহাকালগড় বিজয়ের পাঁচ বছর পর ৭৩১ হিজরি ২৭ রজব শাহ মখদুম (র.) ইন্তেকাল করেন। শাহ মখদুমের ইন্তেকালের পর দৈত্য ধর্মাবলম্বী কুচক্রী মহল অনেকবার তার মাজার উৎপাটন করতে গিয়েছিল; কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। শাহ মখদুমের নামে রাজশাহী মহানগরীতে একটি থানা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্য একটি হল আছে। এমনকি রাজশাহী বিমান বন্দরের নাম শাহ মখদুমের নামে রাখা হয়েছে। প্রতিবছর ২৭ রজব তার মৃতু্যবার্ষিকী বা উরস পালিত হয়। দেশ-বিদেশের দূর-দূরান্ত জায়গা থেকে তার ভক্ত অনুসারীগণ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে আসেন। শাহ মখদুম (র.)-এর স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে আজও তার আস্তানায় ব্যবহৃত কুরআন শরিফ, পাগড়ি, বসবাস পীড়ি ও একখানি খড়ম রয়েছে। প্রতিবছর উরসের দিন এসব স্মৃতিচিহ্ন প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু বর্তমান জনসাধারণের মধ্যে এ সম্পর্কে নানা কুসংস্কার প্রচলিত আছে তারা উরসের দিন ঐসব স্মৃতি চিহ্ন ও মাজারের ওপর ফুল, সন্দেশ, বাতাসা, খৈ ইত্যাদি দিয়ে মানত করে, এমনকি ভন্ড শ্রেণির কিছু লোকজন মাজারে সিজদা করে, চুমু খায় ইত্যাদি শিরকপূর্ণ ও বেদাতি কাজকর্মে লিপ্ত হয়, অথচ তিনি তাঁর পুরো জীবন শিরক- বেদাতের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম, অলি-আউলিয়া ও নেককার বান্দাদের কবর জিয়ারত করা সওয়াবের কাজ। কিন্তু মাজারে সিজদা করা ও বিভিন্ন ধরনের বেদাতি কাজ শির্কের অন্তর্ভুক্ত। মহান আলস্নাহ তা'য়ালা বলেন, তোমরা আলস্নাহর সাথে কাউকে শরিক করো না। নিশ্চয় শিরক অনেক বড় জুলুম। (সুরা লুকমান, আয়াত : ১৩)। হযরত শাহ মাখদুম (র.) ছিলেন ইসলামের একান্ত খাদেম ও একনিষ্ঠ প্রচারক। আমাদের উচিৎ তার রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজকে আঞ্জাম দিয়ে ইসলাম প্রচারের কাজকে বেগবান করা। আলস্নাহ তার বান্দার খেদমতকে কবুল করুন। জান্নাতের মেহমান বানিয়ে সম্মানিত করুন। আমিন।