শিক্ষকতা এবং গবেষণাই আমার পরিচয় - উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমদাদুল হক চৌধুরী

প্রকাশ | ০৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

তানিউল করিম জীম
উপাচার্য হিসেবে প্রশাসনিক যে দায়িত্বটা আমি পেয়েছি, সবার সহযোগিতায় অত্যন্ত ভালোভাবেই ১ বছর সম্পন্ন করলাম। আমার শুধু মনে হয়, কবে যে শেষ হবে এ দায়িত্ব। আবার আমি ফিরে যেতে চাই গবেষণা-ল্যাবে এবং ক্লাস রুমে। কারণ গবেষণা এবং শিক্ষকতাতেই আমার প্রকৃত আনন্দ আমি খুঁজে পাই। এখনো সময় থাকলে সকালে ক্লাস ও ল্যাবে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সময় দেওয়ার চেষ্টা করি। প্রতিদিন যখনই আমি সময় পাই, তখনই রিসার্চগেট এবং গুগল স্কলারে আমার সাইটেশন এবং এইচ ইনডেক্স দেখি। সাইটেশন এবং এইচ ইনডেক্স এ সংখ্যাটা আগের থেকে কিছুটা বাড়লেই মনের মধ্যে আলাদা একটি শান্তি কাজ করে। আমি হিসাব করে দেখেছি যে, মাসে গড়ে ২৫টি এবং বছরে প্রায় ২৫০টি করে সাইটেশন হয় আমার গবেষণা কাজের। কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) উপাচার্য এবং সুনামধন্য গবেষক ও প্রতিথযশা ভেটেনারিয়ান অধ্যাপক ড. এমদাদুল হক চৌধুরী। ইতোমধ্যে অধ্যাপক এমদাদুল হক ৩০ বছরের শিক্ষাদান ও গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন করেছেন। উচ্চমানের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে ১৭০টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। তিনি বিভিন্ন একাডেমিক ও পেশাদার সম্মেলন/সেমিনার/ কর্মশালায় দেশ-বিদেশে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন এবং ৮০ জন এমএস এবং ২০ জন পিএইচডি শিক্ষার্থীকে তত্ত্বাবধায়ন করেছেন। এমনকি উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরও তিনি ৩ জন এমএস এবং ৩ জন পিএইচডি শিক্ষার্থীকে তত্ত্বাবধায়ন করছেন। শিক্ষকতায় আগ্রহ তৈরি : উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমদাদুল হক চৌধুরী তার শিক্ষকতায় আগ্রহ তৈরির বিষয়ে বলেন, আমাদের একটি স্কুল ছিল এবং একজন গৃহশিক্ষক আমাদের বাসায় থাকতেন। তার হাত ধরেই আমার বর্ণমালা শেখা। ওই সময় শিক্ষককে সবাই অনেক সম্মান করত, যা বর্তমানে দেখা যায় না। সবাই যে সম্মান করত এই বিষয়টি আমাকে খুব টানত। আমি যখন প্রাইমারিতে পড়ি তখন হাই স্কুলের একজন শিক্ষকের বিদায় অনুষ্ঠানে যাই বাবার হাত ধরে। তার নাম ছিল বাবু জোগেশচন্দ্র। সেইদিন তার বিদায়ে দেখলাম শিক্ষার্থীরা কান্নায় গড়াগড়ি করছেন। তখন বুঝলাম যে এই একটি পেশা, যার মাধ্যমে মানুষের হৃদয় জয় করা যায়। তখন আমার মনে প্রথম শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা জাগল। পরে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে বাকৃবিতে ভেটেরিনারি অনুষদে ভর্তি হলাম। প্রথম বর্ষে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হলাম। তখন একটি বিষয় ছিল যে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় হলে শিক্ষক হওয়া যায়। তাই আমারও শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছে তীব্র হলো। কারণ তখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেক সম্মান করা হতো। পরে ১৯৮৮ সালে ভেটেরিনারি অনুষদে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হয়ে স্নাতক এবং ১৯৮৯ সালে প্যাথলোজি বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করলাম। পরে পশু স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সম্প্রসারণ প্রকল্পের ভেটেরিনারি সার্জন হিসেবে কাজ শুরু করি। এরপর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৯৫ সালে বাকৃবি প্যাথলোজি বিভাগের প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করি। গবেষণায় আগ্রহ তৈরি : ভেটেরিনারিতে পড়তে পড়তেই আমার গবেষণার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। শিক্ষকরা ক্লাসে এসে তাদের পিএইচডির বিষয় সম্পর্কে বলতেন, তখন তাদের গবেষণা নিয়েও বলতেন। আবার এসব বিষয়ে গবেষণা দরকার এমনও বলতেন। তখন গবেষণা করে সেসব বিষয়ে জানার আগ্রহ তৈরি হতো। পরে স্নাতক শেষ করে ভাবলাম শিক্ষক হব। কিন্তু তখন শিক্ষক হওয়া সহজ ছিল না, কারণ নিয়োগ কম হতো। ভাবলাম শিক্ষক হতে না পারলে অন্তত গবেষক হব। তাই ওই সময়ে আমার অনুষদের সবচেয়ে ভালো গবেষক ছিলেন প্যাথলোজি বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম। আমি তার তত্ত্বাবধানে স্নাতকোত্তরে গবেষণা শুরু করলাম। তিনি ওই সময় সম্ভবত দেশে প্রথম প্রাণি টিসু্য কালচার নিয়ে কাজ করেন। ওই সময় এত গবেষণা সরঞ্জাম ছিল না। তিনি স্যাভলনের বোতল জীবাণুমুক্ত করে সেটি টিসু্য কালচারের কাজে ব্যবহার করতেন। তার এই গবেষণার সঙ্গেই আমার গবেষণার হাতে খড়ি হয়। অধ্যাপক মানিক লাল দেওয়ান স্যারের পরামর্শে টিসু্যর কালচারের মাধ্যমে ছাগলের লালার প্রভাব জানার বিষয়ে একটি গবেষণা করি। কারণ একটি প্রচলিত কথা ছিল যে ছাগল গাছ খেলে ওই গাছ আর হয় না। তাই ছাগলের লালা নিয়েই গবেষণা করা হয়। এটিই ছিল আমার প্রথম গবেষণা। এভাবেই গবেষণার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। উচ্চশিক্ষা : অধ্যাপক ড. এমদাদুল হক চৌধুরী একজন খ্যাতনামা শিক্ষক, যিনি ২০০৮ সাল থেকে বাকৃবির প্যাথলোজি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করে চলেছেন। তিনি ১৯৮৮ সালে বাকৃবি থেকে ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন (ডিভিএম) ডিগ্রি লাভ করেন। ডিভিএম ডিগ্রিতে তিনি প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্যাথলোজিতে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন এবং প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ১৯৯৯ সালে বাকৃবির প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তিনি সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন। তার এমএসসি এবং পিএইচডি উভয়ই ভেটেরিনারি প্যাথলোজি এবং ইমিউনোপ্যাথলজিতে ছিল। ২০০২ সালে তিনি জাপানের জাতীয় পশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, সুকুবা থেকে খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ে পোস্টডক্টরাল সম্পন্ন করেন। দায়িত্ব পালন : অধ্যাপক এমদাদুল হক ২০২৩ সালের ১২ জুলাই বাকৃবির উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি পূর্বে প্যাথলজি বিভাগের প্রধান, প্রভোস্ট ও প্রভোস্ট কাউন্সিলের আহ্বায়ক, নিরাপত্তা কাউন্সিলের পরিচালক, ইন্টারডিসিপিস্ননারি ইনস্টিটিউট অব ফুড সেফটির পরিচালক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়াও তিনি ১ বছরের জন্য বাকৃবির উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু), ঈশাখাঁ আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরকৃবি), হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হকৃবি) সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। সদস্য : আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান ভেটেরিনারি প্যাথলোজি, খাদ্যনিরাপত্তা এবং জৈবপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ হিসেবে অধ্যাপক চৌধুরী বাংলাদেশ সরকারের নীতিগত স্তরের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। তিনি বিভিন্ন জাতীয় কমিটির বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। যেমন- জাতীয় খাদ্যনিরাপত্তা কমিটি, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, এমওএফএল, বিএফএসএর জীববিজ্ঞান ঝুঁকি এবং বায়োসিকিউরিটি কমিটি। অধ্যাপক চৌধুরী বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ ও পোল্ট্রি ভ্যাকসিন খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি প্রাণি উৎপাদন খাতের আধুনিকায়নের জন্য ওয়ার্ল্ড ভেটেরিনারি পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের বাংলাদেশ শাখার সভাপতি হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি জাতীয় কনসালট্যান্ট হিসেবে এফএও, আইসিডিডিআরবি, আইইউসিএন, পরিবেশ অধিদপ্তর (ডিওই) এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআইডিএস) সঙ্গে কাজ করেছেন এবং বিভিন্ন জাতীয় ও বিদেশি সহায়তাপ্রাপ্ত প্রকল্পে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ ভেটেরিনারি জার্নাল, দ্য বাংলাদেশ ভেটেরিনারিয়ান এবং বাংলাদেশ লাইভস্টক জার্নাল, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় জার্নালের সম্পাদক/সম্পাদকীয় বোর্ডের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ডবিস্নউভিপিএ-বিবি ই-বুলেটিনের প্রধান সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস (বিএএস) এবং বাংলাদেশ কলেজ অব ভেটেরিনারি সার্জনসের (বিসিভিএস) ফেলো হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। পুরস্কার প্রাপ্তি : গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ ভেটেরিনারি এডুকেশন এবং রিসার্চ সোসাইটি কর্তৃক ১৯৯৯ সালে শ্রেষ্ঠ তরুণ উপস্থাপনা পুরস্কার এবং কেয়ারস (সেন্টার ফর অ্যাকশন রিসার্চ) দ্বারা ২০১৩ সালে শ্রেষ্ঠ পোস্টার পুরস্কার পান। এছাড়াও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি থেকে ২০১৪ সালে শ্রেষ্ঠ প্রকাশনা পুরস্কার এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ ৫টি এইচ-ইনডেক্সড গবেষক হিসেবে ২০১৯ এবং ২০২২ সালে বাকৃবি গেস্নাবাল রিসার্চ ইমপ্যাক্ট অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। অধ্যাপক চৌধুরী এফএও/আইএইএ-এর অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় যৌথ বিভাগ দ্বারা ছাগল ভাইরাস রোগের আণবিক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ১০০% দক্ষতা অর্জন করেন। গবেষণা : অধ্যাপক চৌধুরী তার গবেষণায় অসাধারণ বৈজ্ঞানিক অবদান রেখেছেন। তিনি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার অনুদানে ২০টির বেশি গবেষণা প্রকল্প সম্পন্ন করেছেন সংক্রামক রোগ, আণবিক প্যাথলোজির ক্ষেত্রে উচ্চ প্রভাব গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করতে। মৌলিক গবেষণার পাশাপাশি, অধ্যাপক চৌধুরী সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহকর্মীদের সঙ্গে শক্তিশালী গবেষণা সহযোগিতা গড়ে তুলেছেন প্রধানত সংক্রামক রোগ এবং খাদ্যনিরাপত্তার উপর মনোযোগ দিয়ে। তার বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ ও পোল্ট্রির বিভিন্ন সংক্রামক রোগ শনাক্তকরণ ও চরিত্রায়ণ বাকৃবির মৌলিক ও প্রয়োগ গবেষণার অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তার অনেক গবেষণার ফলাফল শীর্ষর্ যাংকিং আইএফ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় 'দারগোড়ায় ভেটেরিনারি সেবা' প্রদান মডেল তৈরি করেছেন এবং নিরাপদ প্রাণিজ প্রোটিন উৎপাদনে প্রান্তিক কৃষকদের সঙ্গে কাজ করছেন, যা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (ডিএলএস) দ্বারা মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক হিসেবে সারা দেশে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ছাই থেকে জৈব জীবাণুনাশক তৈরি করেছেন এবং গবাদি পশুর রোগ নির্ণয়ের জন্য অনেক পদ্ধতি তৈরি করেছেন। বর্তমানে গুগল স্কলারে তার সাইটেশন সংখ্যা ২ হাজার ৫২৩টি এবং এইচ ইনডেক্স ২৬। অন্যদিকে রিসার্চগেটে তার সাইটেশন সংখ্যা ২ হাজার ৫০টি এবং এইচ ইনডেক্স ২৫। উপাচার্য এমদাদুল হক বলেন, আমি স্বপ্ন দেখি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি একদিন উদ্যোক্তা বিশ্ববিদ্যালয় হবে। এখানকার শিক্ষার্থীদের কাছে সবাই চাকরির জন্য দৌড়াবে, তারা চাকরির জন্য দৌড়াবে না। আমার আরেকটি স্বপ্ন হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে একটি আধুনিক কৃষি গ্রাম গড়ে তুলব। তার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। প্রাণিসেবা এবং গবেষণাই আমার আত্মতৃপ্তি, আমি সেসব কাজই করে যেতে চাই।