দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যখন প্রত্যয় স্কিম নিয়ে কর্মবিরতি চলছে, ঠিক এমন সময়ে এলো নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন। ১৫ জুলাই নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) ১৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, তথা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান, গবেষণা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের ধারা অটুট রেখেছে। তাই জাতীয় পর্যায়ে নতুন জ্ঞান তৈরি এবং গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি নোবিপ্রবির খ্যাতি বর্তমানে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও ছড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রালগ্নের এদিনটি হলো বর্তমানের সাফল্যকে বেগবানের আর ভবিষ্যতের পথচলাকে নির্ধারণের দিন। বর্তমান সময়ে দিবস পালন প্রাতিষ্ঠানিক আকার পেয়েছে। তাই দিবস উদযাপনে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির বন্ধনে এক হয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে দিনটি পালন করবে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নোবিপ্রবিকে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় এগিয়ে নিতে প্রতিষ্ঠানটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. দিদার-উল-আলম নানামুখী প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এর কিছু অর্জিত হয়েছে, কিছু নির্মাণধীন রয়েছে এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প আছে প্রক্রিয়াধীন। বিশ্ববিদ্যালয়কে অবকাঠামোগতভাবে উন্নত, একাডেমিকভাবে আধুনিক ও গবেষণাবান্ধব করার প্রয়াসে উপাচার্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন, যা বাস্তবায়নে রয়েছে সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ।
একাডেমিক অর্জন : ২০০১ সালের আজকের দিনে প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা কর্তৃক উপকূলীয় জেলা নোয়াখালীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আইন পাস হয়। এরপর ২০০৬ সালে একশ একর জায়গায় ৪ নতুন বিভাগ, ১৩ শিক্ষক ও ১৮০ জন শিক্ষার্থীকে সাথি করে বিশ্ববিদ্যালয়টি যাত্রা শুরু করে। সময়ের পালাবদলে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিধারী শিক্ষক রয়েছেন ৯১ জন। পিএইচডি গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন ১১৭ জন। ৬টি অনুষদ এবং ২টি ইনস্টিটিউটের অধীন ৩১ বিভাগে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় আট হাজার। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদে পিএইচডি চালু করা হয়েছে। মাস্টার্স চালু করা হয়েছে ২৮ বিভাগে এবং দুটি ইনস্টিটিউটে চালু হয়েছে ডিপেস্নামা ও প্রফেশনাল মাস্টার্স। বিভাগগুলোতে ওবিই ক্যারিকুলাম প্রণয়ন এবং দপ্তরগুলোয় ডি-নথি কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইকিউএসির মাধ্যমে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দক্ষতা আনয়নে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। স্কপাস ইনডেক্সড জার্নালে এ পর্যন্ত নোবিপ্রবি শিক্ষকদের ১,৭৩৮টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-প্রকাশনা যাতে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপ্তি পায় সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সেলকে যুগোপযোগী করেছেন সেলের পরিচালক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ প্রফেসর ড. নেওয়াজ মোহাম্মদ বাহাদুর। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গবেষণা খাতে প্রায় ৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। গবেষণায় পারস্পরিক সহায়তার জন্য ইউকে, জাপান, চেক রিপাবলিক, থাইল্যান্ড, তুরস্কের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নোবিপ্রবির ২১টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর আওতায় নোবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা জাপান ও তুরষ্কের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। অধিকন্তু এ উচ্চশিক্ষা বিনিময় কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নোবিপ্রবি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের টিম যুক্তরাজ্য ও তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যান এবং ওই দেশের টিম নোবিপ্রবিতে আসেন, যা দেশের অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে প্রশংসিত হয়েছে। উলেস্নখ্য, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রায়োগিক জ্ঞান এবং গবেষণাকে সমৃদ্ধ করতে নোবিপ্রবি গ্রন্থাগারে প্রায় ২৫ হাজার ৬৯৫ বই, ৭৮৪ জার্নাল, ৯০৬ ম্যাগাজিন, ১৩ হাজার ২৯৩ ইলেকট্রনিক বই, ২ লাখ ৫০ হাজার কৃষিভিত্তিক আর্টিকেল, সাড়ে ৩ হাজার প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিষয়ক ইলেকট্রনিক জার্নাল সন্নিবেশ করা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের সমকালের শিক্ষাদানের পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ ও শারীরিক সক্ষমতা অর্জনকে প্রাধান্য দিতে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড শক্তিশালী করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিএনসিসি, এনএসটিউডিএস, এনএসটিইউমুনা, ক্রীড়া ক্লাব, ক্যারিয়ার ক্লাব, প্রোগ্রামিং ক্লাব, ফার্মা মিরর, বিজ্ঞান ক্লাব ও এনভায়রনমেন্ট ক্লাব কোয়েন। এছাড়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নতুন উদ্ভাবনী কাজে আগ্রহী করে তুলতে এখানকার বিভাগগুলোতে প্রতি মাসে নিয়মিত 'পিএইচডি টক' এর আয়েজন করা হয়েছে।
ভৌত অর্জন : একাডেমিক উন্নয়ন ত্বরান্বিতের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে ক্যাম্পাসে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় একাডেমিক ও ল্যাব ভবনে শিক্ষার্থীদের জন্য শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারে যন্ত্রপাতি বৃদ্ধি ও রিসার্চ ল্যাব সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া ৫০০ কেভিএ সাবস্টেশন নির্মাণ, খেলার মাঠের বাউন্ডারি ওয়াল, ক্রিকেট পিচ তৈরি, অ্যানিমেল হাউজ নির্মাণ, করোনা ভাইরাস পরীক্ষাগার স্থাপন, ১০ তলা প্রভোস্ট কোয়াটার্স, শিক্ষক-কর্মকর্তা টাওয়ার ও স্টাফ কোয়াটার্স নির্মাণ, আনাসার শেড ও চাইল্ড কেয়ার সেন্টার নির্মাণ, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট পস্ন্যান্ট স্থাপনসহ অফিসার সমিতি ও শিক্ষক সমিতির ক্যান্টিন নির্মাণকাজ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা ও আধুনিক জ্ঞানচর্চার সম্প্রসারণে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি হিসেবে ১৫০ একর জমির ওপর প্রস্তাবিত 'শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক সমুদ্র ও সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা গবেষণা ইনস্টিটিউট' এবং 'ইনস্টিটিউট ফর ওশানোগ্রাফি অ্যান্ড মেরিন রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট' শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। অধিকন্তু সরকারের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বস্নু ইকোনমি সেলের কার্যপরিধি অনুসারে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন মেয়াদে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়েছে। যার মাধ্যমে নোয়াখালীর মেঘনা উপকূলবর্তী জু পস্নাঙ্কটনের মাইক্রোপস্নাস্টিক দূষণ নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করা হবে। এছাড়া এ কর্মপরিকল্পনার আওতায় রয়েছে বিলুপ্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ মৎস্য নিয়ে গবেষণা প্রকল্প চালু করা এবং হাতিয়া ও নিঝুপ দ্বীপে ভারী খনিজসম্পদের ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা। এছাড়া রয়েছে তৃতীয় একাডেমিক ও কেন্দ্রীয় গবেষণাগার নির্মাণ, ১০তলা একাডেমিক ভবন নির্মাণ কাজের অবশিষ্টাংশ সমাপ্তকরণ, নোবিপ্রবি মাস্টার পস্ন্যান প্রকল্প এবং নিরাপদ বিদু্যৎ সরবরাহ ও অগ্ি্ননিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং অবকাঠামো উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প। নিকট-ভবিষ্যতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সম্ভাব্য প্রধান অর্জনগুলোর মাঝে রয়েছে ৫তলা বিএনসিসি ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ, কেন্দ্রীয় পরিবহণ শেড নির্মাণ, একাডেমিক ১-এর দক্ষিণ পাশ থেকে মেডিকেল সেন্টার পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ, কেন্দ্রীয় ভলিবল, টেনিস ও বাস্কেটবল কোর্ট নির্মাণ এবং ৫০০ কেভিএ জেনারেটর ক্রয়।
সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ: দেশের ২৭তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি ক্ষেত্রে পঞ্চম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে নোবিপ্রবিকে অবকাঠামোগতভাবে উন্নত, একাডেমিকভাবে আধুনিকায়ন করে গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টির ভৌগোলিক অবস্থান জেলা শহর থেকে দূরবর্তী হওয়ায় এখানে নাগরিক সুবিধার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। নোয়াখালীর সঙ্গে রাজধানী ঢাকার বিমান যোগাযোগ নেই। ফলে উচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের এখানে নিয়োগ দেওয়া কিংবা একাডেমিক সভা, কর্মশালা ও সেমিনারে তাদের নিয়ে আসা দুরূহ হয়ে পড়ে। অধিকন্তু শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে আর্থিক বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এদিকে একশ একরের ওপর প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে দিন দিন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু তদানুযায়ী একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন ও হলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বন্ধ থাকা তৃতীয় একাডেমিক ও ল্যাব ভবনের নির্মাণকাজ পুনরায় চালু করা এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদু্যৎ পরিষেবা নিশ্চিত করা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে স্থান স্বল্পতা, তাই এমন সময়ে নতুন ভূমি অধিগ্রহণ জরুরি। এছাড়া যানবাহনের অপ্রতুলতা বর্তমানে আরেকটি বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেকোনো প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনায় চ্যালেঞ্জ বা ঝুঁকি মোকাবিলা করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তা আরও বেশি কঠিন, কারণ এখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মতো গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণি জড়িত। কাজেই নোবিপ্রবিতে শিক্ষার্থীদের পাঠক্রম যাতে কোনোভাবে বিঘ্ন না ঘটে এবং শিক্ষকদের জ্ঞান বিতরণ ও গবেষণায় যাতে কোনো ছেদ না পড়ে সেদিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আরও প্রত্যাশার জায়গা হলো এ ধরনের একাডেমিক ও অবকাঠামোগত দিকসহ সর্বাঙ্গীন বিষয়ে সমূহ চ্যালেঞ্জ বা সংকট নিরসনে নোবিপ্রবি প্রশাসন সর্বদা আন্তরিক, ফলে এ বিশ্ববিদ্যালয় উত্তরোত্তর সম্মৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে।