রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

পথশিশুদের বন্ধু

রাকিব রিফাত
  ১৩ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
পথশিশুদের বন্ধু

রক্তের জন্য কান্না করতেছিল মধ্য বয়স্ক একজন নারী। আশপাশে অনেক মানুষ থাকলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। মধ্য বয়স্ক নারী কান্নারত অবস্থায় বলছিল ডাক্তার বলেছে ইমার্জেন্সি রক্ত দিতে না পারলে তার মুমূর্ষু মাকে (ক্যান্সার আক্রান্ত) বাঁচানো সম্ভব হবে না। বিষয়টি গভীরভাবে দাগ কাটে পাশেই থাকা এক যুবকের। দিনটিতে ছিল তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা (২০১৭)। কোনো কিছু না ভেবেই মুমূর্ষু রোগীকে রক্ত দিতে ছুটে যায় হাসপাতালে। রক্ত দেওয়ার পর হাসপাতাল থেকে তড়িঘড়ি করে রওনা হয় পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। কিন্তু সঠিক সময়ে উপস্থিত হতে না পারায় পরীক্ষা দেওয়া তার সম্ভব হয় নি, বলছিলাম সাতক্ষীরা জেলার দরগাহপুর গ্রামের মোঃ আব্দুল কাদেরের ছোট সন্তান শাকিল (২৬)-এর কথা।

গল্পটি ছিল ২০১৭ সালের, জীবনের ১ম বারের মতো রক্তদানের অনুভূতি অর্জন করে শাকিল? এরপর থেকে শুরু হয় মানবিক কাজ নিয়ে তার পথচলা। মানবিক কাজের জন্য সংগ্রাম মোটেও সহজ ছিল না। রক্তদানের পর দীর্ঘদিন অসুস্থতার বোঝা শরীরকে টানতে হয়। তবুও তিনি দমে যায়নি।

এরপর ২০১৮ সালে শাকিল সাতক্ষীরা থেকে চলে আসে ঢাকায়, ভর্তি হয় রাজধানী ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত সরকারি বাঙলা কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে (২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ)। ক্যাম্পাসের আশপাশে অবস্থিত প্রায় ডজনখানেক হাসপাতাল থেকে রোগীর আত্মীয়স্বজনরা রক্তদাতা খোঁজার জন্য বাঙলা কলেজের ক্যাম্পাসে আসত। এসব ঘটনা শাকিলের নজরে প্রতিনিয়ত পরতে থাকল। কী করা যায়? তখন শাকিলের স্মার্ট ফোন ছিল না। শাকিল চিন্তাভাবনা করল রক্তের জন্য রোগীর স্বজনরা ক্যাম্পাসে এলে নিঃস্বার্থভাবে ?রক্ত ম্যানেজ করে দিয়ে পাশে দাঁড়াবে। বাবার সহযোগিতায় কমদামী একটা স্মার্ট ফোন কিনে নিজ উদ্যোগে অনলাইনের মাধ্যমে বস্নাডের সংগঠন তৈরি করল। নামকরণ করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের নাম অনুসারে '৭ কলেজ বস্নাড অর্গানাইজেশন'। যেখানে নিঃস্বার্থভাবে শ্রম দিচ্ছে ৭ কলেজের স্বপ্নবাজ শিক্ষার্থীরা। এরপর রক্তের প্রয়োজনে পিছনে তাকাতে হয়নি শাকিলের। ক্যাম্পাসে প্রতিদিন রোগীর স্বজনরা আসত, তাদেরকে বিনামূল্যে রক্তের ব্যবস্থা করে দিত শাকিল ও তাদের টিম। কিন্তু মানবিক কাজ করার জন্য অনেক বাধাবিপত্তি প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয়েছে শাকিলের।

'৭ কলেজ বস্নাড অর্গানাইজেশন' গত ০৬ বছর যাবৎ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মানবসেবায় নিয়োজিত রয়েছে। রক্তের গ্রম্নপ নির্ণয়, রক্তদানের আহ্বান, সচেতনতার বার্তা, মুমূর্ষু রোগীকে রক্তদাতা ম্যানেজসহ বিভিন্ন জনকল্যাণমুখী কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটি। গরিব, অসহায় ও অভুক্তদের জন্য ২০২০ সাল থেকে 'রুটি দিবস' বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। অন্তত একটা দিন যাতে গরিব ও অসহায়রা অভুক্ত না থেকে পেটভরে খেতে পারে।

স্বেচ্ছাসেবী অঙ্গনে শাকিল এখন অনেকটাই পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছে। নিজের মেধা, শ্রম ও বুদ্ধি দিয়ে দেশের ৬৪ জেলার ভলান্টিয়ারদের মাঝে নিজেকে পরিচিত করে তুলতে পেরেছে। কোভিড-১৯ এর সময়ে নিজ এলাকায় করোনা আক্রান্ত রোগীদেরকে সেবা করেছে। এছাড়া কয়েকজন যুবককে নিয়ে বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা ও অসহায়দের খাবার বিতরণের মতো মহান কাজেও শাকিল ছিল সক্রিয়।

বেকারত্বের মাঝেও নিজের কথা চিন্তা না করে প্রতিনিয়ত পথশিশুদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন। এসব ছিন্নমূল শিশুদের বিশ্বাস ও ভালোবাসা জয় করে তাদের বন্ধুতে পরিণত হয়েছেন। বর্তমানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের তিনটা স্কুল (মজার ইশকুল, জুম বাংলাদেশ স্কুল ও প্রত্যয় শিশু কেন্দ্র)-এর মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত ও পথশিশুদের পাঠদানের মাধ্যমে শিশুদের সঙ্গে ব্যস্ত সময় পার করছেন। ঢাকা শহরের দুই শতাধিক শিশুর কাছে শাকিল স্যার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বিভিন্ন জেলায় ভলান্টিয়ার প্রোগ্রাম ও ফেসবুক ভিডিও বার্তার মাধ্যমে মানুষকে রক্তদানসহ বিভিন্ন মানবিক কাজে এগিয়ে আসার আহ্বান করছে। বর্তমানে সব ধরনের মানবিক কাজের সঙ্গে জড়িত শাকিল। অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার মাঝে কুড়িগ্রাম বানবাসী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল (২০২২)। কুরবানির ঈদও পরিবার ছাড়া অপরিচিত কুড়িগ্রামে করেছে। পড়াশোনায় কম সময় দেওয়া ও হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। এটা নিয়েও বিন্দুমাত্র আফসোস নেই শাকিলের।

কারণ জানতে চাইলে শাকিল বলে, ভালো কাজের পিছনে সময় দিতে পারছি এটা নিশ্চয়ই আলস্নাহ তা'আলার এক ধরনের নেয়ামত। সুতরাং আমি সেই নেয়ামত থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চাই না। যখন আমার ক্লাসমেটরা সিজিপিএ পিছনে ছুটে চলছে আর আমি তখন অসহায় মানুষের ভালোবাসা কুড়িয়ে বেড়াচ্ছি। আমার পরিবার আমাকে পড়াশোনার পাশাপাশি মানবিকতার শিক্ষাও দিয়েছে। আর সেই মানবিকতার শিক্ষা আমার নেশায় পরিণত হয়েছে।

এছাড়া শাকিল তার শুভাকাঙ্ক্ষীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা যারা ভালো কাজের সঙ্গে জড়িত আছেন তারা কখনো ভুলেও এটার প্রতিদান আশা করবেন না। মনে রাখা উচিত, এগুলো আলস্নাহ তা'আলার এক ধরনের নেয়ামত। আমরা সৌভাগ্যবান যে ভালো কাজের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে রাখতে পেরেছি। এজন্য সবসময় শুকরিয়া করা উচিত।

বর্তমানে শাকিল সরকারি বাঙলা কলেজে মাস্টার্সে পড়াশোনা করছে। অসহায় মানুষদের নিয়ে তার অনেকগুলো স্বপ্ন এখনো থেমে আছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আর এখনো বেকার থাকায় স্বপ্নগুলো পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে। পড়াশোনার শেষে আলস্নাহ তা'আলার রহমতে একটি চাকরি পেলে শাকিলের স্বপ্নগুলো ধীরে ধীরে পূরণ হবে বলে জানিয়েছে।

তার মানবিক কাজের অনুপ্রেরণা কীভাবে হলো এসব জানতে চাইলে শাকিল তার অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, ছোটবেলা থেকে আমি আমার বাবাকে দেখছি মানুষের বিপদে এগিয়ে যেতে। সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করতে। বাবার এমন মানবিক কাজ দেখে প্রতিনিয়ত হৃদয়ে কড়া নাড়ত। সংসারে অভাব-অনটনের ভেতরও বাবাকে নিঃস্বার্থভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখেছি। তখন থেকে স্বপ্ন দেখতাম কখনো সুযোগ পেলে আমিও বাবার মতো ভালো কিছু করব, মানুষের বিপদে পাশে থাকব, তাদেরকে সাহায্য করব। তাই বাবার মতো আমিও চেষ্টা করে যাচ্ছি মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। বাবার মানবিক কাজগুলো আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমার বাবা এখনো মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে, এটা আমাকে প্রতি মুহূর্তে আনন্দ দেয়। আমার বাবাকে নিয়ে এত এত গল্প রয়েছে যে বলে শেষ করা সম্ভব নয়। আমার বাবা-মাকে আলস্নাহ সবসময় সুস্থ রাখুক, সেই দোয়া করি সবসময়।

নিজ গ্রামে শাকিলকে এসব মহান কাজের জন্য সবাই ভালোবাসে ও সর্বদা পাশে থাকে। এছাড়া হাসপাতালে রোগীকে সেবা করতে গিয়ে নির্ঘুম রাত কাটানো হয় শাকিলকে প্রতিনিয়ত। ব্যস্ততার মাঝেও রক্তদান করতে ভুলেন না। ইতিমধ্যে ২৬তম রক্তদান (হোল বস্নাড+পস্নাটিলেট) সম্পন্ন করেছে চলমান মাসে। যতদিন সুস্থ থাকবেন ততদিন মুমূর্ষু রোগীকে রক্ত দিয়ে পাশে থাকবেন বলে জানিয়েছেন।

মৃতু্যর পর নিজের চোখ দুটোকে দান করার অঙ্গীকারাবদ্ধ করা শাকিলের। সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালে মরণোত্তর চক্ষুদাতা হিসেবে নিজের নাম লিখেছেন (চক্ষুদাতার কার্ড নম্বর ংরবনড়হ-৭৩৭৪)। কনকনে শীতের ভেতরও নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে মানব সেবায়। শীতবস্ত্র, গরম পোশাকের মাধ্যমে ভালোবাসা কুড়িয়েছে উত্তরবঙ্গের অসহায় শীতার্ত মানুষদের কাছে থেকে। তার মানবিক কাজের মধ্যে সব থেকে বেশি সাড়া ফেলেছে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে পারাটা। কখনো শাকিল স্যার আবার কখনো পথশিশুদের বন্ধু হিসেবে বিভিন্ন সংগঠন থেকে পুরস্কার পেয়েছেন।

শাকিল বলেন, পথশিশু বা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আলো তাদের মাঝে পৌঁছে দিয়ে মানবসম্পদে পরিণত করতে চাই। শাকিল ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে পাঠদান করায় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে।

শাকিল একজন স্বেচ্ছাসেবী, একজন রক্তদাতা, একজন মরণোত্তর চক্ষুদাতা, পথশিশুদের সেবক, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষক, কোভিট-১৯ যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে