রাঙা মঞ্জুরি কৃষ্ণচূড়ায় শিহরিত প্রকৃতিপ্রেমীরা

প্রকাশ | ১৩ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

আব্দুলস্নাহ আল তৌহিদ
সতেজতার পূর্ণতা নিয়ে পথে-প্রান্তরে কৃষ্ণচূড়ার লাল আভা আবির্ভূত হয়েছে সৌন্দর্যের এক নতুন রূপে। কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জুরি কর্ণে- আমি ভুবন ভুলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই মনোমুগ্ধকর গান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কৃষ্ণচূড়ার তাৎপর্য। প্রকৃতিতে কৃষ্ণচূড়া নিজেকে মেলে ধরে আপন মহিমায়। লাল আবিরে মাখা প্রেমের চিরন্তন আবেশ নিয়ে হাজির কৃষ্ণচূড়া। যে দিকে চোখ যায় সবুজের মাঝে শুধু লাল রঙের মূর্ছনা। প্রকৃতির এই অপরূপ রঙের সাজ দেখে দু'চোখ জুড়িয়ে যায় প্রকৃতিপ্রেমীদের। চোখে নেমে আসে প্রশান্তি। এ যেন প্রকৃতিজুড়ে কৃষ্ণচূড়ার মন জুড়িয়ে দেওয়া। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, গ্রীষ্মের রোদ্দুরের সবটুকু উত্তাপ গায়ে মেখে নিয়েছে রক্তিম পুষ্পরাজি; সবুজ চিরল পাতার মাঝে যেন আগুন জ্বলছে। তাপদাহে ওষ্ঠাগত পথচারীরা পুলকিত নয়নে, অবাক বিস্ময়ে উপভোগ করেন এই সৌন্দর্য। এমন কোনো মানুষ নেই যে এই রূপের কাছে আটকে যায় না, একটু চোখ তুলে তাকায় না। একবার হলেও চোখ তুলে দেখে, হৃদয়ের মাঝে এক অনাবিল তৃপ্তি পেতে চায়। কারণ ফুল মনকে আন্দোলিত করে বরাবরই। জাগরিত করে ভালোলাগার জগৎকে। আর সেই ফুল যদি হয় কৃষ্ণচূড়ার মতো এত সুন্দর তাহলে তো মন উড়বেই বসন্ত আর কৃষ্ণচূড়ায়। চির সবুজ এই বৃক্ষে বসন্তকাল থেকে ফুলের দোলা চলতে থাকে গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত। কৃষ্ণচূড়া বাংলাদেশের খুব পরিচিত একটি ফুল। শহর বন্দর নগর গ্রাম সব জায়গায় দেখা মেলে এই কৃষ্ণচূড়ার। কৃষ্ণচূড়া গাছের আরেক নাম যে গুলমোহর, তা কম লোকই জানেন। কিন্তু কৃষ্ণচূড়াকে চেনেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। এখন কৃষ্ণচূড়ার সময়, এই ফুল ফুটে প্রতিটি গাছ লালে লাল হয়ে আছে। এই লাল রঙের সমারোহের মধ্যেই কৃষ্ণচূড়ারই মহিমা। কৃষ্ণচূড়াকে সাধারণত আমরা লাল রঙেই দেখতে অভ্যস্ত। তবে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কৃষ্ণচূড়া তিনটি রঙের হয়। লাল, হলুদ ও সাদা। কম হলেও চোখে পড়ে হলদে রঙের কৃষ্ণচূড়া আর সাদা রঙের কৃষ্ণচূড়ার দেখা মেলে কালেভদ্রে। তিন রঙের কৃষ্ণচূড়ার গাছ উঁচু। অনেকটা জায়গাজুড়ে শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটায়। তিন রঙেরই ফুল ফোটে প্রায় একই সময়ে। এর বড় খ্যাতি হলো গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপদাহে যখন এই ফুল ফুটে তখন এর রূপে মুগ্ধ হয়ে পথচারীরাও থমকে তাকাতে বাধ্য হন। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে কৃষ্ণচূড়া গাছের সমারোহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করতে চোখে পড়বে কয়েকটি কৃষ্ণচূড়া গাছ। এছাড়া সামনে আসলে রয়েছে মসজিদের পাশে মাথা তুলে আছে আরও কয়েকটি গাছ। তাছাড়া নীল দীঘির আশেপাশে ও কেন্দ্রীয় উপাসনালয়ের পাশে রয়েছে অনেক কৃষ্ণচূড়া গাছ। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডক্টর আব্দুস সালাম বলেন, কৃষ্ণচূড়ার আদি নিবাস পূর্ব আফ্রিকার মাদাগাস্কার। এই বৃক্ষ শুষ্ক ও লবণাক্ত অবস্থা সহ্য করতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশে এটি জন্মে থাকে। সৌন্দর্যবর্ধক গুণ ছাড়াও এই গাছ উষ্ণ আবহাওয়ায় ছায়া দিতে বিশেষভাবে উপযুক্ত। কৃষ্ণচূড়া উদ্ভিদ উচ্চতায় সাধারণত ১২ থেকে ১৫ মিটার হলেও শাখা-পলস্নাবে এটির ব্যাপ্তি বেশ প্রশস্ত। ফুলগুলো বড় চারটি পাপড়িযুক্ত। মুকুল ধরার কিছু দিনের মধ্যে পুরো গাছ ফুলে ফুলে ভরে যায়। কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো বড় ৭-৮টি পাপড়িযুক্ত গাঢ় লাল। ফুলের ভেতরের অংশ হালকা হলুদ ও রক্তিম হয়ে থাকে। পাপড়িগুলো প্রায় আট সেন্টিমিটারের মতো লম্বা হতে পারে। কৃষ্ণচূড়া জটিল পত্রবিশিষ্ট এবং উজ্জ্বল সবুজ। শুষ্ক অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে কৃষ্ণচূড়ার পাতা ঝরে গেলেও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এটি চিরসবুজ। বাংলাদেশে কৃষ্ণচূড়া ফুল ফোটে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কৃষ্ণচূড়ার ফুল ফোটে। উপজেলা কৃষি অফিসার মো. আবদুলস্নাহ আল মামুন বলেন, উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের দেয়া কৃষ্ণচূড়ার নাম উবষড়হরী ৎবমরধ। কিন্তু বাংলায় এসে বদলে নাম হয়েছে 'কৃষ্ণচূড়া'। যদিও জঙ্গলে এটি বিলুপ্ত প্রায়, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এটি জন্মানো সম্ভব হয়েছে। শুষ্ক অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে কৃষ্ণচূড়ার পাতা ঝরে গেলেও নাতিষীতোষ্ণ অঞ্চলে এটি চিরসবুজ। ক্যারাবিয়ান অঞ্চল, দক্ষিণ চীন, বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে এটি জন্মে থাকে। বিভিন্ন রাস্তার দু'পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগানো হলে এ সময় ফুল ফুটে লালে লাল হয়ে যায়। পরিবেশ ও প্রকৃতিবিষয়ক গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান 'বারসিক'-এর আঞ্চলিক কর্মকর্তা বিমল রায় জানান, বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি আর বহু আন্দোলনের পটভূমির সাথে কৃষ্ণচূড়া গাছের সম্পর্ক খুব নিবিড়। ছড়া-কবিতা-গানে উপমা হিসেবে নানা ভঙ্গিমায় এসেছে এই ফুলের সৌন্দর্য বর্ণনা। পরিশেষে আল মাহমুদের একটি কবিতা স্মরণ করি। কবিতাটি ফেব্রম্নয়ারির ভাষাশহীদদের নিয়ে লেখা। তিনি লিখেছেন, কৃষ্ণচূড়ার পাতার ফাঁকে ফুল ফুটেছে রক্তবরণ/ ফেব্রম্নয়ারির শহীদ ভাইয়ের মুখগুলোকে করছি স্মরণ।