ঈদে প্রিয়জনের জন্য প্রবাসী শিক্ষার্থীদের হাহাকার
ঈদ মানে আনন্দ। তবে পরিবার-পরিজন এমনকি দেশ থেকে শত মাইল দূরে থাকা প্রবাসীদের ঈদ উদযাপন ভিন্ন রকম। প্রবাসে অনেকেই আছেন যাদের জন্য ঈদের দিনটাও কষ্টকর। একের পর এক ঈদ আসে-যায়, প্রবাসীদের ঈদ রয়ে যায় নিঃসঙ্গতায় ভরা। শত কর্মব্যস্ততার মধ্যে ঈদের ছুটিতে লম্বা ঘুম অধিকাংশ প্রবাসীর ঈদের দিনে মূল কর্মসূচি। কয়েকজন প্রবাসী তরুণের এবারের ঈদ উদযাপনের কথা জানাচ্ছে তানজিদ শুভ্র
প্রকাশ | ২২ জুন ২০২৪, ০০:০০
অনলাইন ডেস্ক
কষ্ট লুকিয়ে বলতে হয় 'আমি ভালো আছি'
মো. ইব্রাহীম
কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া।
নিজস্ব সংস্কৃতি, বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারে ছেড়ে বাইরে থাকাটা যে কতটা কষ্টের তা শুধু প্রবাসীরা জানে। দেশের মায়া-মমতা ত্যাগ করতে পারলেই কেবল সে একমাত্র প্রবাসে সুখে থাকতে পারে। সেটা কখনো সম্ভব হয় না। বাড়ছে বয়স, একাকীত্ব বাড়ছে, পালস্না দিয়ে বাড়ছে দায়িত্ব, টেনশনও বাড়ছে, শুধু ভালো থাকাটা কমে যাচ্ছে! প্রবাসীদের মনের কষ্ট বোঝার মতো কেউ নেই। সবাই ভাবে আমরা কতই না সুখে আছি। কতটা কষ্ট করে প্রবাসীরা টাকা আয় করে তা দেশের মানুষ জানলে তারা কখনোই প্রবাসীদের নিয়ে উপহাস করত না।
প্রবাসীর ঈদের দিন বলতে কিছুই নাই! যেখানে দেশের মানুষ ঈদের দিনে সকালে ঘুম থেকে উঠে মায়ের হাতে বানানো সেমাই খেয়ে ঈদগাহতে নামাজ পড়তে যায় আর এদিকে আমরা ঈদের দিন ঘুম থেকে উঠে বুক ভরা কষ্ট নিয়ে কিছু না খেয়েই মসজিদে নামাজ আদায় করতে যাই। নামাজ আদায় করে বাসায় এসে হালকা কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া আর ৩-৪ ঘণ্টা ঘুম থেকে উঠে ডিউটি তে যাওয়া মানুষ জানে তাদের বেদনার কথা। এভাবেই কাটিয়ে দিতে হয় আমাদের ঈদের দিন। তীব্র ইচ্ছে করে মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে মা, আমি এই প্রবাসে ভালো নেই! তবুও অশ্রম্নসিক্ত হয়ে এ দেশের স্বজনদের বলতে হয়, আমি ভালো আছি। সব থেকে বড় কথা হলো, আমরা প্রত্যেকটা প্রবাসী মিথ্যাবাদী। বুকভরা কষ্ট নিয়ে, মুখে সুন্দর হাসি নিয়ে সবাইকে বলতে হয় 'আমি ভালো আছি।'
ঘুমিয়ে পার করে দিলাম ঈদের দিন
সাকিন আহমেদ
রিয়াদ, সৌদিআরব।
দুরন্তপনায় কাটানো শৈশব থেকে তারুণ্য সবই কেটেছে পরিবারের সঙ্গে। ঈদ আসত পুরোপুরি উৎসব আমেজ নিয়ে। বন্ধুদের সঙ্গে হাসি, আড্ডা আর ঘুরে বেড়ানো ছিল ঈদের দিনের রুটিন।
প্রবাস জীবনে সব যেন পালটে গেল। খুব বাজে একটা অভিজ্ঞতা হলো এই প্রবাসে এসে। কোনোদিন পরিবার ছেড়ে ঈদ উদযাপন করি নাই। দীর্ঘ ২১ বছরের নিয়ম ভেঙে তীব্র শূন্যতা নিয়ে দিনটা পার করেছি। এই কষ্টটা লিখে প্রকাশ করার মতো না।
এই দূর প্রবাসে ঈদের খুশি বা আনন্দ বলে কিছু নেই, নেই নতুন জামা পরার ইচ্ছা। পুরনো স্মৃতি মনে করে চরম মন খারাপ নিয়ে বাধ্য হয়ে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়া। আর এসে ঘুমিয়ে দিনটা পার করে দিলাম। এই বুঝি প্রবাসে ঈদ!
শুধু পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য এমন একটা পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে চলতে হচ্ছে।
প্রবাসীর ঈদে নেই আনন্দ
মিনহাজ বিন মাহবুব
দোহা, কাতার।
ঈদ মানে খুশি ঈদ মানে আনন্দ। এই আনন্দ তখনই হয় যখন পরিবারের সবার সঙ্গে ঈদ উদযাপন করা যায়। একজন প্রবাসীর ঈদ সম্পূর্ণ ভিন্ন।
প্রবাসের ঈদে কোনো আনন্দ নেই, বরং বিশেষ দিনগুলো কষ্টের হয়ে আসে। দেশে থাকাকালে সময়ের ঈদের আনন্দগুলো স্মৃতি হয়ে আসে। সকালে ঈদের নামাজের পর সবাই যে যার যার বাসায় চলে যায়। দেশে থাকা পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে কিছুটা শান্তি পাই, তবে দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটানো সম্ভব? মায়ের হাতে গরুর গোস্ত রান্না খুব মিস করি।
প্রবাসীদের ঈদ কাটে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি কথা বলা আর ঘুমিয়ে। এর বাইরে তেমন আনন্দ থাকে না। তবে ঈদে কোনো কাজ না থাকায় আনন্দের চেয়েও প্রবাসীরা কষ্টে বেশি থাকেন। প্রবাসীর কষ্টে উপার্জিত টাকায় দেশে স্বজনরা ঈদ আনন্দ করে, নতুন জামা কেনেন, পরিবারের মুখে হাসি দেখে, এইটুকুই প্রবাসীর আনন্দ।
প্রবাসে ঈদ যেন লবণ ছাড়া তরকারির মতো
মো. জুবাইল আকন্দ
সায়বারজায়া, মালয়েশিয়া।
পরিবার-প্রিয়জন ছাড়া ঈদ যেন লবণ ছাড়া তরকারির মতো। প্রবাসীদের ঈদ মানে নিজের আনন্দটাকে পরিবারের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া। প্রবাসী টাকা ইনকাম করে ঠিকই কিন্তু ঈদ এলে নিজের জন্য একটা শার্ট কিনতেও টাকার হিসাব করে। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দটা না করতে পারা যে কতটুকু কষ্ট তা প্রবাসীরাই বোঝে। পুরান কাপড়-চোপড় আর নিত্যদিনের মতো খাবার খেয়েই ঈদের দিন কাটে। প্রবাসে ঈদ প্রতিদিনের মতো। ঈদের দিনও ডিউটি করতে হয় অনেককে। প্রবাস মানে দুঃখের তরঙ্গ বেয়ে সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মনের আনন্দটাকে খাঁচায় বন্দি করে পরিবারের স্বপ্নকে লালন করা। একজন প্রবাসী কতটা ধৈর্যশীল, উদার এবং মহৎ হয় পরিবারের জন্য আমি প্রবাসী না হলে বুঝতাম না। শত কর্মব্যস্ততার মধ্যে ঈদের ছুটিতে লম্বা ঘুম অধিকাংশ প্রবাসীদের ঈদের দিনের মূল কর্মসূচি হয়ে থাকে। ঈদের নামাজ শেষে দেশে পরিবারের মানুষের কাছে ফোন করার পর বুকের ভেতরের কষ্টের তীব্রতা যেন আর বেড়ে যায়। চেনা মুখগুলোর না দেখতে পারার কষ্ট। অনেকেই ভার্চুয়ালি যুক্ত হন দেশের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আলাপচারিতায়। এই আলাপে কারও কারও চোখ ভরে আসে জল। বুক ফাটা যন্ত্রণা নিয়ে বিছানায় চোখের পানিতে বালিশ ভিজিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে প্রবাসীরা। এরপর যখন দুপুর গড়িয়ে পুবের সূর্যটা পশ্চিমে হেলতে শুরু করে। তখন বিছানা ছেড়ে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে সামান্য আনন্দের প্রত্যাশায় অজানা উদ্দেশ্যে ছুটে চলা। কোথাও কোনো পার্কে বসে কিছু মুহূর্তে কাটিয়ে দেওয়া। এভাবেই কেটে যায় প্রবাসীদের ঈদ নামে নিঃসঙ্গ বেদনার দিনটি।