বাঘ কাঁপানো মাঘের শেষে শীতের তীব্রতা খানিকটা কমে এসেছিল। প্রকৃতির রূপ বদলের অপেক্ষায় ছিল সব মানুষ। বসন্তের দখিনা হাওয়ার মাতাল সমীরণ, বাতাসে পাতা ঝরার শব্দ, সেই সাথে গাছে গাছে নতুন পাতা আর ফুলের সমারোহ, গাছের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা কোকিলের কুহু তান এসবকিছু আবেগি মনটাকে করে তুলেছিল উদাস। সেই সাথে বারবার মনে হচ্ছিল যে, বইয়ে পড়েছি ও শুনেছি যে মুজিব নগরের কথা আজ বাস্তবে পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জিত হবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল কুরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষা সফরের মাধ্যমে। ১৯৭১ সালে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করা হয়। সেই সময় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্য মন্ত্রীরা শপথ গ্রহণ করেছিলেন। দিনটি ছিল ৭ মার্চ বৃহস্পতিবার, খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করে রুমে এসে প্রবেশ করা মাত্র ক্লাসমেট আ. রহিমের ফোন 'মুহাম্মদ ভাই কয়টায় রওনা দিতে হবে?' আমি বললাম, এখনই আমার রুমে চলে আসেন। যেই কথা সেই কাজ মাত্র কুড়ি মিনিটের মধ্যে বান্দা হাজির। সকাল ৭টার সময় আ. রহিম, আবু সুফিয়ান ও আমি মেস থেকে বের হয়ে বঙ্গবন্ধু পকেট গেট দিয়ে ক্যাম্পাসে গেলাম টিএসসিসির মধ্য দিয়ে আম বাগান পেরিয়ে দেখি ডায়না চত্বরের দিক থেকে ইনামুল ভাই আসতেছে, আমরা একসাথে বাসে উঠে পড়লাম পিছনের তিনটি সিটে কিন্তু বিষয় হলো কুষ্টিয়া সাদ্দাম বাজারে গিয়ে সবাইকে বাস পরিবর্তন করতে হবে। অবশেষে সকাল ৮টার দিকে ক্যাম্পাস থেকে গাড়ি রওনা করল। বাসের খোলা জানালা দিয়ে কুষ্টিয়ার বিখ্যাত জায়গাগুলো দেখছিলাম আর যাচ্ছিলাম। বাসের মধ্যে হামদ-নাত, গজল-কৌতুক আরো অসংখ্য প্রাণজুড়ানো বিনোদনের মধ্য দিয়ে চলছিল আমাদের যাত্রা। কেউ বাসের হেলপার, কেউ বাসের হকার, আবার কেউ গায়কসহ বিভিন্ন সব অভিজ্ঞতা ও আনন্দ উপভোগের মধ্য দিয়ে চলছিল আমাদের যাত্রা। আমার পাশের সিটে বসেছিল ইমরান, খুব নম্র-ভদ্র ও রসিক টাইপের একটা ছেলে, সারা রাস্তা অনেক আনন্দের সাথে কেটেছিল। মনে পড়ে গেল রবিঠাকুরের অপরিচিতা গল্পে লাইন খানি 'গাড়ি লোহার মৃদঙ্গে তাল দিতে দিতে চলিল, আমি মনের মধ্যে গান শুনিতে লাগিলাম'। অবশেষে দীর্ঘ যাত্রার অবসান কাটিয়ে মধ্যাহ্নের সময় আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত পর্যটন কেন্দ্র 'মুজিব নগর'। বাস থেকে নেমে কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে মেইন গেট পার হয়ে দেখতে পেলাম সেই ইতিহাস খ্যাত আম্রকানন। যেখানে আমাদের ডিপার্টমেন্টের বড় ভাইয়েরা আমাদের জন্য একটা আলোচনা সভার মঞ্চ সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছেন আগে থেকে। প্রথমত আমাদের কিছু নিয়মকানুন ও সময়সূচি জানিয়ে দিলেন। এর পরে আমরা মুজিব নগরের মূল আকর্ষণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্মরণীয় স্থান মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ তথা মুজিবনগর স্মৃতি কমপেস্নক্সে গেলাম। সেখানে আমরা আমাদের সহপাঠীরা মিলে হাজারো স্মৃতিচারণ করলাম। সবাই এক ফ্রেমে বন্দি হয়ে কিছু গ্রম্নপ ফটো তোলা হলো। মুজিবনগরে স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম জয়বাংলা স্মৃতি মিনার, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরভিত্তিক বাংলাদেশের মানচিত্র, বাংলাদেশের শেষ সীমানা এবং ভারতের নদীয়া জেলা অনেক কাছ থেকে দেখলাম, মানচিত্র ওয়াচ-টাওয়ারে উঠে অনেক উঁচু থেকে চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশটা প্রত্যক্ষ করলাম চতুর্দিকে সবুজে সবুজময় চির সবুজ সত্যি সত্যিই বিমোহিত হয়ে গেলাম তখনই মনে পড়ে গেল কবি জীবনানন্দ দাশের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন 'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যায় না আর।'