দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ নবনিযুক্ত চবি ভিসি প্রফেসর ড. মো. আবু তাহের অল্পসংখ্যক তরুণদের সাথে চার দেয়ালের মাঝে নিবিড় আলাপ করছেন। আয়োজনের পরিসর বাহ্যিকভাবে ছোট কলেবর মনে হলেও এর পেছনে প্রস্তুতি ছিল দীর্ঘ তিন মাসের। সংযুক্ত রয়েছে দেশের প্রতিটি বিভাগের তরুণদের স্বপ্ন, সরাসরি চলিস্নশ জেলার তরুণদের চোখ রয়েছে ভার্চুয়ালি এ আয়োজনের দিকে। আবার আয়োজনের সভাপতি যুক্ত হয়েছেন সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে। সব মিলিয়ে অন্যরকম এক আয়োজন বলতে দ্বিধা নেই।
তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই যুগে এসে আমরা এখন বৈশ্বিক নাগরিক। কিন্তু প্রতিটি মানুষের মানবিক মর্যাদা বিভিন্ন দেশভেদে ভিন্ন ভিন্ন, ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় গণতান্ত্রিক বিকাশ আর উন্নয়নের রয়েছে বিস্তর ফারাক। একই সময়ে কিছু দেশ ও জাতি এমন পিছিয়ে পড়া আর বৈষম্য সৃষ্টির পেছনে রাজনৈতিক নেতৃত্বে শূন্যতা অন্যতম কারণ। পৃথিবীকে বৈষম্যহীন, বাসযোগ্য ও টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে যোগ্য ও দক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রয়োজন। এ উপলব্ধিকে সামনে রেখে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের সমন্বিত প্রয়াসে অলাভজনক বেসরকারি সংস্থা কেয়ার ফর এসেস্টস, রিসোর্সেস অ্যান্ড অবলিগেশনস (করো) এর সৃষ্টি।
সাম্প্রতিক সময়ে মেধাবী চৌকস তরুণদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক মনোভাব, বিদেশে পাড়ি জমানো ও দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ এড়িয়ে যাওয়ার মনোভাব নিঃসন্দেহে আগামী দিনে যোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য সংকট তৈরি করবে। তরুণদের বহির্বিশ্বে ছুটে চলা উচ্চশিক্ষায় আবার কেউ উন্নত জীবন যাপনের অভিলাষে। দেশপ্রেম আর দায়বদ্ধতার চেতনা হারিয়ে অনেকেই স্থায়ীভাবে থেকে যায় পশ্চিমা দেশগুলোর নাগরিকত্ব নিয়ে। কিন্তু স্রোতের বিপরীতে চলা এক অদম্য মনোবলের অধিকারী এ এন এম নুরুদ্দীন। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে দ্বিতীয় মাস্টার্স করছেন পলিটিক্যাল ম্যানেজমেন্টে। সেখানে থেকে আন্তর্জাতিক এনজিও গঠনের উদ্যোগ নিয়ে প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নেন। নিজ জন্মস্থানের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে তরুণদের আত্ম উন্নয়নে তার নিরলস প্রচেষ্টার ফলাফল এ আয়োজন। তাই সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভার্চুয়ালের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করছেন।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা আন্দোলন ও পরবর্তী গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার সব আন্দোলন সংগ্রামে তরুণদের ভূমিকা ছিল অসামান্য। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ তরুণ প্রায় ২৮ শতাংশ, সংখ্যায় প্রায় পাঁচ কোটি। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সময় চলছে আমাদের। এ সময়ে তরুণদের নেতৃত্বের বিকাশ দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তরুণদের প্রফেশনাল পর্যায়ে আত্ম উন্নয়ন এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিকাশে অংশগ্রহণমূলক প্রশিক্ষণ সময়ের দাবি। তাই ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির জন্য ইতিহাসের অনুপ্রেরণা, রাষ্ট্রের কাঠামো ও পরিচালন প্রক্রিয়া, নাগরিক ও মানবিক অধিকার, গবেষণা ও সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া, সফট স্কিল ও উপস্থাপন দক্ষতা এই পাঁচ স্তরের সমন্বয়ে বিস্তীর্ণ প্রশিক্ষণের ইনিশিয়েটিভ নিয়েছে বেসরকারি সংস্থা কেয়ার ফর এসেস্টস, রিসোর্সেস অ্যান্ড অবলিগেশনস (করো)। একাডেমির জ্ঞান ও বাস্তবিক অবস্থানের ওপর গবেষণা করে প্রায়োগিক কৌশল নির্ধারণ করে এগিয়ে চলছে এ ইনিশিয়েটিভের কাজ।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ৫৩ বছর উদযাপন উপলক্ষে তরুণদের দেশপ্রেম ও দায়বদ্ধতার চেতনাকে জাগ্রত করতে ভার্চুয়ালি দেশব্যাপী 'স্বাধীনতার ৫৩ বছর-প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি' শীর্ষক অনলাইন ইভেন্টের আয়োজন করা হয়। দেশের সবগুলো বিভাগ থেকে, চলিস্নশটি জেলা থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের তরুণরা তাদের আত্মোপলব্ধি ও মতামত লেখার মাধ্যমে ও ভিডিও কনটেন্টের মাধ্যমে তুলে ধরে। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব করতে গিয়ে নিশ্চয়ই দেশের জন্য তার করণীয় বিষয় ধারণা হয়েছে। নিজেদের প্রত্যাশাকে পূরণ করতে অংশগ্রহণকারী তরুণদের আত্মউন্নয়ন ও নিজেদের মেধা মননের উৎকর্ষ সাধনে অনুপ্রাণিত করতে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে করো, বিজয়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ক্রেস্ট, গিফট ও সার্টিফিকেট।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরিতে 'পিপল ম্যাটার, উই ম্যাটার, আওয়ার ওপিনিয়ন ম্যাটারস, ডেমোক্রেসি ম্যাটারস' শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করা হয়। একই সাথে সমসাময়িক বিভিন্ন পর্যায়ের তরুণদের আমন্ত্রণ করা হয় এবং একাডেমিয়ানদের একই মঞ্চে উপস্থিত করা হয় অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, চিন্তা ও মতবিনিময়ের জন্য। প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত সম্মানিত উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের। তার বক্তব্যের মধ্যে ফুটে ওঠে শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা, শিক্ষকদের অদক্ষতা, তরুণদের মধ্যে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও নেতৃত্বের গুণাবলির অভাব এবং বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার ঘাটতি। বক্তব্যের শুরুতে কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘ সময়ে তার কাজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। এছাড়াও কীভাবে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে পরিণত হতে পারে, কীভাবে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়নের প্রতিটি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে বিশ্বের বুকে নিজের নাম উজ্জ্বল করতে পারে সেই বিষয়ে আলোকপাত করেন। এছাড়াও করো'র প্রতি আশাবাদ ব্যক্ত করে করোকে একটি সুন্দর কারিকুলাম তৈরির মাধ্যমে নিজেদের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুবকদের সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বর্তমান তরুণদেরও একইভাবে সংগঠিত হতে হবে। তাদের নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। এমনকি লোকাল চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি ইন্টারন্যাশনাল চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে।
বিশেষ অতিথি ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এম নাজের হোসাইন করো'র এই সুন্দর, সময়োপযোগী এবং স্বপ্নচারী উদ্যোগের প্রশংসা করার পাশাপাশি বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসু্য নিয়ে তরুণদের আলোচনার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, 'আমরা গেস্নাবাল বিষয় নিয়ে যতটা কথা বলি, লোকাল বিষয় নিয়ে ততটা কথা বলি না। আমাদের লোকাল বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করা দরকার এবং এসব বিষয়ে ফোকাস করা উচিত। আমাদের তরুণদের পড়াশোনার প্রতি ব্যাপক অনীহা রয়েছে এবং তাদের মধ্যে ব্যবহারিক জ্ঞানের ব্যাপক অভাব রয়েছে। আপনি যদি সমাজকে পরিবর্তন করতে চান, সেক্ষেত্রে বাধা আসবেই। আপনাকেই সেই বাধাগুলো মোকাবিলা করতে হবে। তো এসব বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে শিক্ষকদের পরামর্শ নিয়ে সুগঠিত কারিকুলামের মাধ্যমে করো'র যাত্রা শুরু হলে আশা করি এটি সমাজে একটা পরিবর্তন নিয়ে আসবেই। একাডেমিয়ান ও তারুণ্যের সমন্বিত নেতৃত্বে নতুন কিছু হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
গবেষণার মাধ্যমে স্কিল গ্যাপ চিহ্নিত করে ইন্টারেক্টিভ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নেতৃত্ব তৈরি, ইয়ুথ ও ভলান্টিয়ারদের করো'র অর্গানাইজেশনাল প্রফেশনাল কাজে অংশগ্রহণ করিয়ে ক্ষমতায়ন, বিভিন্ন পর্যায়ের ইভেন্টের মাধ্যমে সিভিল এনগেজমেন্ট এ তিন পর্যায়ে কাজ শুরু করেছে কেয়ার ফর এসেস্টস, রিসোর্সেস অ্যান্ড অবলিগেশনস (করো)। অনুষ্ঠান শেষে করো'র অফিসিয়াল ওয়েবসাইট (পধৎড়হড়হঢ়ৎড়ভরঃ.ড়ৎম) উদ্বোধন হয় অধ্যাপক ড. মো আবু তাহেরের হাতে কেক কাটার মধ্য দিয়ে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে তাল মিলিয়ে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় (ঈঅজঙ) করো'র কার্যক্রম বিস্তৃত করতে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ওয়েবসাইট উন্মুক্ত হলো।