দাবদাহে 'বিহঙ্গের জল'

প্রকাশ | ১৮ মে ২০২৪, ০০:০০

তাহমিদ হাসান
গ্রীষ্মের শুরু থেকেই কাঠফাটা রোদ্দুর। প্রাণ যায় যায় অবস্থা। সেদিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোর-চুয়াডাঙ্গা এলাকায়। মানব বসবাসের অযোগ্য নগরী ঢাকা-ই বা কম যায় কীসে! পারদ তাপ চলিস্নশের ওপারে, গুগল জানান দিচ্ছে 'অনুভূত তাপমাত্রা ৪৬/৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস'। গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ৩২ একরের ক্যাম্পাসের সবুজবীথিও প্রচন্ড দাবদাহে ঝিমিয়ে পড়েছে। কেমন মলিন, প্রাণহীন দন্ডায়মান শোপিস যেন! ঠান্ডা পানির সন্ধান করতেই একাডেমিক বিল্ডিং লাগোয়া ব্যাডমিন্টন কোর্ট পার করে ঢাল বেয়ে নেমে যাচ্ছি আমি, গণবিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সানজিদা জান্নাত পিংকি এবং ক'জন বন্ধু। ঢালের কাছে আসতেই থমকে দাঁড়ালেন পিংকি। আঁতকে ওঠে ডাক দিলেন 'এই! আপনারা এদিকে আসেন দ্রম্নত।' পেছন ঘুরেই দেখি দু'টি শালিক পাখির নিথর দেহ পড়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সাম্প্রতিক এক দু'দিনে মারা গেছে। পথচারীর পায়ে পায়ে পিষে শুধু পেখমগুলোই যে মরদেহের সম্বল। মরেও যেন শান্তি নেই! আমরা রাস্তা থেকে সরিয়ে পাশেই ঝোপে রেখে আসলাম নিস্তেজ শালিক দুটোকে। শোকাতুর হয়ে পানির বোতল নিয়ে ক্যাম্পাসে আসতেই চোখে বিঁধলো আরও একটি পাখির মরদেহ। এরপর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য জায়গায় চোখে পড়ল মৃত বাদুড়। ততক্ষণে মোটামুটি সবাই আন্দাজ করলাম ভয়াবহ গরম ও পানির শূন্যতাই এই মৃতু্যর কারণ। কেউ-ই আমরা পরিবেশবাদী নই, পাখি বিশেষজ্ঞ তো না-ই। মৃতু্যর ধারণকৃত কারণ ঢালাওভাবে প্রচার করাটাও এজন্য যুক্তিযুক্ত হয়ে উঠল না। সেদিন সন্ধ্যাতেই পিংকি নির্দেশনা দিলেন ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত উন্মুক্ত পানপাত্র স্থাপন করতেই হবে 'অ্যাট এ্যনি কস্ট'। আদেশ শিরোধার্য বলে ক'জন লেগে পড়লাম বোতল সংগ্রহে। বন্ধুবর ক'জনের সহযোগিতায় সংগ্রহ করা হলো মাটির পাত্র। বিকেলে সালেহিন ও শান্তর উদ্যোগে চলতে থাকল বোতল কাটা। সভাপতি আখলাক-ই রাসুল লেগে গেলেন ঝুলানো বোতল ব্যালেন্স করার প্রচেষ্টায়। পরদিন ফের নির্দেশনা এলো দুপুরে সবাই অফিসে উপস্থিত থাকবেন আমাদের কর্মসূচি আজই সম্পন্ন করতে হবে। উৎফুলস্ন হয়ে একে একে সবাই অফিসে হাজির। অফিসে এসেই আদিবা বলে বসল, 'আচ্ছা পাত্রে আমরা কিছু লিখব না?' শুরু হলো তা নিয়ে সমাচার। কেউ বলল, 'পাখির জন্য ভালোবাসা', কেউবা বলল, 'পাখির জন্য জীবন, কারণ পানির অপর নাম জীবন।' তবে কোনোটাই যেন পছন্দ হলো না কারো। শেষমেশ এই কর্মসূচির পরিকল্পনা যার, সেই পিংকিই বলে উঠলেন, 'বিহঙ্গের জল'। একে একে সব পাত্রে 'বিহঙ্গের জল' ট্যাগ বসাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সম্রাট। সঙ্গে আঠা নিয়ে বসে পড়ল আদিবা। যেন কিছুই না তবুও একটু তো হলো এই বাসনা যেন সবার মনে ছুঁয়ে গেল। বিকেল গড়াতেই একে একে পরীক্ষা শেষ করে জড়ো হলো সবাই। এ কর্মসূচির সামিল হলেন শিক্ষকরাও। হাতে হাতে মাটির পাত্র ঝুলাতে ঝুলাতেই হলো পরিবেশ নিয়ে বিস্তর আলোচনা। পুরো ক্যাম্পাসে গাছে গাছে ঝোলানো হলো পান পাত্র। ক্যাম্পাসের বাদামতলা থেকে শুরু করে আমতলা, বকুলতলা সব জায়গায়ই পাখির জন্য রাখা হলো পানপাত্র। শান্ত যেন সেদিন সুপারম্যানের মতো এক গাছ থেকে আরেক গাছে বিচরণের মহাদায়িত্ব পেয়ে গেল। কুকুর বিড়ালের জন্য বসানো হলো আলাদা মাটির পাত্র। কাকতালীয়ভাবে ট্রান্সপোর্ট ইয়ার্ডে পাত্র স্থাপনের কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যাম্পাসের স্থায়ী বাসিন্দাখ্যাত কুকুরগুলো দৌড়ে এলো পানি পান করতে। সবার চোখেমুখে এক ঝলক আনন্দের দেখা মিলল।