রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

রেল কারখানা ও মসজিদের শহর সৈয়দপুর

মোঃ ফজলুল হক
  ১১ মে ২০২৪, ০০:০০
রেল কারখানা ও মসজিদের শহর সৈয়দপুর

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে ক্লাশ পরীক্ষা বাতিল হওয়া বা পিছিয়ে যাওয়া ক্ষেত্রবিশেষে ঈদের মতো আনন্দ দেয়। এত এত কাজের মধ্য একটা দিন ফাঁকা পাওয়া আমাদের কাছে অনেক কিছু! একদিন আগে যখনই শুনলাম পরীক্ষা পিছিয়েছে তো আর দেরি কেন? হয়ে গেল পরিকল্পনা, পরের দিন সকালেই রওনা। রংপুর থেকে ট্রেনে করে পার্বতীপুর। যথারীতি দু-একজনের দেরি করা নিয়ে মেজাজ খারাপ দিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু! ট্রেনের টিকিট নিয়ে ঢুকলাম একই বগিতে। কিন্তু বসতে হলো তিন জায়গায়। গালগল্পে পৌঁছে গেলাম রেলওয়ে পথের চৌরাস্তা, উত্তরবঙ্গের রেলওয়ে প্রবেশদ্বার, কথিত আছে প্রতি ঘণ্টায় কোনো না কোনো ট্রেন সেখানে অবস্থান করেই, সেই বিখ্যাত রেলওয়ে স্টেশন পার্বতীপুরে।

খোঁজ নিলাম সৈয়দপুরের ট্রেন আছে অনেক দেরিতে। সিদ্ধান্ত হলো ইজিবাইকেই রওনা দিব?। যদিও সর্বোচ্চ আট জনের সিট তবুও গাদাগাদি করে দশজন চড়লাম। ইচ্ছে করেই বাসে যাওয়াকে এড়িয়ে গেছি। কারণ বাসে গেলে আমরা আমাদের মতো গলা ছেড়ে গান গাইতে পারতাম না। ইজিবাইক চলতে শুরু করলেই সবাই গেয়ে উঠলাম, 'এমন যদি হতো আমি পাখির মতো', 'একদিন মাটির ভিতরে হবে ঘর রে মন আমার!', 'মা গো ভাবনা কেন?' ইত্যাদি গান। দশটার দিকে সৈয়দপুর নেমে একেকজন গরমে সিদ্ধ হওয়ার অবস্থা! কথা হলো তরমুজ খাব! তো আর দেরি কীসের? জায়গায় তরমুজ কিনে থাবা বসালাম সবাই!

পৌর-বাজার ঘুরে ঢুকলাম রেলওয়ে স্টেশনে। পস্ন্যাটফর্মের সুশীতল বাতাস গা জিরিয়ে দিচ্ছিল, বসেই থাকব ভাবলাম। পরে ওয়েটিং রুমে চলে গেলাম। বলে রাখা ভালো, পরীক্ষা পিছানোয় ভ্রমণের সিদ্ধান্ত পাকা হলেই জানতে পারি একটা ক্লাশ পরে গেছে। আমরা ক্লাশ বাদ দিয়েই রওনা হয়েছি। কিন্তু ওয়েটিং রুমে থাকাকালীন শুনি ক্লাশ বাতিল হলো। আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে এক চিৎকার! জায়গা একটা পুলিশ কনস্টেবল এসে রাগের সুরেই আমাদের বুঝাতে শুরু করল। অবশ্য আমরাই পরিবেশ নষ্ট করছিলাম। তবে পুলিশ অফিসারের ওপর রাগ করতে পারিনি, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ ক্যানসেল হওয়াটা কতটা আনন্দের তা তিনি জানার সুযোগ পাননি।

স্টেশনেই দু'ঘণ্টা বসে থেকে, ঘোরাঘুরি করে বের হলাম বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রেলওয়ে কারখানা দেখতে, যেটা সৈয়দপুরেই অবস্থিত। কিন্তু মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতি হয়ে যাওয়ার ১৩ নাম্বার গেট থেকে এক রকম তাড়া খেয়ে ফিরতে হলো। অনেকটা পথ ঘুরে আসলাম মূল প্রবেশদ্বারে। একজন আনসার স্টাফের কাছে বিস্তারিত শুনে বুঝলাম আবেদন ছাড়া এত মানুষের প্রবেশাধিকার দেওয়া যাবে না। কিন্তু কাগজ তো নাই, ঘুরতে গিয়েছি খাতা-কলম তো নেইনি, পাছে আবার বন্ধুরা বিদ্যাসাগর বলে পঁচাবে। আমরা বাইরেই বসে পরলাম। কাগজ-কলম এনে আবেদন লিখলাম, অপেক্ষা করলাম দুই ঘণ্টারও বেশি। বিরতি শেষে সবাই আসলেও প্রবেশাধিকার যিনি দিবেন তিনি আসছেন না। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। ভিতরে গিয়ে কথা বলেও নিরাশ হলাম। দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকজন ভরপুর সরকারি দফতরগুলোতে! দু'ঘণ্টা নষ্ট করে লেখা আবেদন টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললাম। সেখান থেকে ফিরে আসলাম।

তারপর রওনা দিলাম সোজা সৈয়দপুর বিমানবন্দর। ওখানে ঘোরাঘুরি শেষে দেখার বাদ ছিল শুটকির আড়ত আর চিনির মসজিদ দেখা। বিখ্যাত তাজির উদ্দিন হোটেলে দুপুরে ভারি খাওয়া দাওয়া করে রওনা দিলাম শুটকির আড়তে। ঘুরলাম, কিনলাম অতপর ঘোরাঘুরির পালা শেষ। সময় দেখলাম, ঘড়ি বলছে আমরা পার্বতীপুর আসলে রংপুরের ফিরতি ট্রেন পাব। ইজিবাইকে করে রওনা দিলাম। স্টেশনে এসে অনেকটা সময় পেলাম। পুরো স্টেশন আবারো একটা চক্কর দিয়ে রংপুরে রওনা দিলাম। আমাদের সেই ট্রেনের উৎপত্তি স্টেশন ছিল পার্বতীপুর, স্বভাবতই ভিড় নাই। এক সাথে সবাই গলা ছেড়ে গান গাওয়া শুরু করলাম। পুরো বগি ফাঁকা, এমনেই নাচনি বুড়ি তাতে পেলাম ঢোলের বারি! লাগাও গান! লোকসংগীত, ভাওয়াইয়া আর শাহ আবদুল করিমের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের গান সব মিলিয়ে আড্ডা জমে ঘি!

সারাদিন ঘুরে শেষ মূহূর্তেও এমন আনন্দ করার সুযোগ পাব কেউ ভাবতে পারিনি। 'পরের জায়গা পরের জমি ঘর বানায়া আমি রই', 'তোমার বাড়ির রঙের মেলায় দেখেছিলাম বায়স্কোপ', 'জাত গেল জাত গেল বলে' ইত্যাদি গানে মুখরিত ছিল রংপুর পর্যন্ত আমরা পুরোটা সময়। দু-একজন ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল। এক বন্ধু তো চোখে মুখে রুমাল দিয়ে ঘুমানোর বৃথা চেষ্টা করল।

রেলওয়ে ক্ষেত্রে রাজত্ব করা অঞ্চল, বাংলাদেশের বড় রেলওয়ে কারখানা, তিস্তা সেচ প্রকল্পের এলাকা নীলফামারী, কৃত্রিম পদ্ধতিতে সৃষ্ট সর্বোচ্চ বনায়ন এলাকা ও লিচুর রাজধানী দিনাজপুর, উত্তরবঙ্গের বাণিজ্যিক এলাকা নীলফামারী (ইপিজেড) ঘোরাঘুরি আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার ঝুলিতে ভালোই সংগ্রহ হয়েছে আশা করি। আঞ্চলিক ঐতিহ্যে ভাষার বৈপরীত্য সৈয়দপুরকে আলাদা রূপ দিয়েছে। সব মিলিয়ে দিনটা উপভোগ্য ছিল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে