শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

শিক্ষার্থীদের ভাবনায় ছাত্র রাজনীতি

সম্প্রতি বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি থাকবে কি, থাকবে না এ যেন টক অব দ্য কান্ট্রি। বায়ান্ন'র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তর'র মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের প্রত্যক্ষ ও মুখ্য ভূমিকার ইতিহাস রয়েছে। এ ছাড়াও দেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ইসু্যতে ছাত্র সংগঠনগুলোর সরব ভূমিকা দেখা যায়। সময়ের বিবর্তনে ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের আদর্শিক জায়গা থেকে সরে গিয়ে মাদক, চাঁদাবাজি, খুনাখুনি, যৌন হয়রানি, ইভটিজিং, জোরপূর্বক রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে নিয়ে যাওয়া,র্ যাগিং, দাঙ্গা ও টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডই যেন ছাত্র রাজনীতির বর্তমান চিত্র বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ছাত্র রাজনীতির এই অধপতন থেকে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিলে শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হবে, সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতামত তুলে ধরছেন শেখ সাদী ভূঁইয়া।
  ০৪ মে ২০২৪, ০০:০০
শিক্ষার্থীদের ভাবনায় ছাত্র রাজনীতি

'ছাত্রদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করতে হলে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি

পরিহার করতে হবে'

নোমান বিন হারুন

শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বিশেষ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীরা রাজনীতির গতিধারায় যুক্ত হয়েছে। ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, ছাত্রসমাজের ১১ দফা, ৬৯-এর গণঅভু্যত্থান কিংবা স্বাধীনতা সংগ্রাম সবক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। তবে সময়ের ব্যবধানে মূল রাজনৈতিক দলগুলো সঠিক ভূমিকা পালন না করায় ছাত্র রাজনীতি তার গতিপথ হারিয়েছে। আদর্শিক চর্চার জায়গায় সেখানে স্থান করে নিয়েছে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও সহিংসতা।

এখানে ছাত্র রাজনীতিতে আদর্শের সুস্পষ্ট ঘাটতি লক্ষ্যণীয়। এটা সাময়িক সময়ের জন্য শিক্ষার্থীদের লাভবান করলেও দীর্ঘমেয়াদে বয়ে আনে হতাশা ও গস্নানি। নিকট অতীতে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহিংসতার ঘটনা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাজনীতিবিমুখতার এটাই প্রধান কারণ।

ছাত্রদের মধ্যে রাজনীতির আবেদন বাড়াতে হলে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি পরিহার করতে হবে। নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন ও যোগ্যদের বাছাই করা, নেতৃত্বের পর্যায়ে গতিশীলতা নিয়ে আসা, নিজ দলের অন্তকোন্দল দূর করা গেলে শিক্ষার্থীরা রাজনীতির প্রতি উৎসাহী হবে বলে আশা রাখি।

রাজনীতি মানেই যদি ভয়, মদ-গাঁজা, দাঙ্গা, মারপিট ও খুনাখুনি হয়,

তবে কি দেখে নতুন প্রজন্ম রাজনীতিতে আসবে?

রিয়া মোদক

শিক্ষার্থী, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্বে ছাত্রদের রাজনীতি ও আন্দোলন করার মধ্যে দেশপ্রেম, জাতীয় স্বার্থরক্ষা এবং অধিকার সচেতনতা ছিল। দেশ ও দেশের মানুষের স্বাধিকার ও অধিকার আদায়ের তীব্র বাসনা কাজ করত ছাত্রদের মধ্যে। বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামে তাদের মধ্যে তীব্র আবেগ কাজ করত। কিন্তু এখনকার ছাত্র রাজনীতির হাতিয়ার হলো- মদ-গাঁজা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভাড়ায় শক্তি প্রদর্শন, মাদক বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, হলে সিট বাণিজ্য, ইভটিজিং, নারী নির্যাতন, কাটা রাইফেল ও রিভলবার। তাই যেন সব ধরনের মানুষের মধ্যেই রাজনীতি নিয়ে এক ধরনের অনিহা কাজ করে। সাধারণ মানুষ রাজনীতিকে এক ধরনের ভয় পায়। অভিভাবকরা চায় না, তাদের সন্তান রাজনীতি করুক। তারা মনে করেন, রাজনীতি মানেই ভয়, রাজনীতি মানেই যেন দাঙ্গা, মারপিট। রাজনীতি মানেই যদি খুনোখুনির রাজনীতি হয়, তবে কি দেখে নতুন প্রজন্ম রাজনীতিতে আসবে? রাজনীতি হতে হবে সুষ্ঠু ও ইতিবাচক। সব রকম সন্ত্রাস ও কলুষিত চিন্তা বাদ দিয়ে স্বপ্নের সোনার বাংলায় সুষ্ঠু ও সুন্দর ছাত্র রাজনীতি গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ গঠন করে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখা যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীরা সুষ্ঠু ধারার রাজনীতিচর্চা করতে শিখবে।

ছাত্র রাজনীতিতে যেভাবে বহুমুখী সংকট চলছে, এতে দেশ পরাধীন হতে বেশিদিন সময় লাগবে না

রেদ্‌ওয়ান আহমদ

শিক্ষানবিশ লেখক ও সাংবাদিক

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ছাত্র রাজনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তির জন্য দেশে দক্ষ রাজনীতিকের খুব দরকার। আর রাজনীতিক গড়েই উঠে ক্যাম্পাসগুলোতে। তবে, সেটা জাতীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তির হওয়া যাবে না। ছাত্ররা কেবল ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করবে। কিন্তু বর্তমান লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি মূলত দেশকে আরও উপনিবেশবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হুমকিস্বরূপ। এ থেকে বাঁচতে হলে ছাত্র রাজনীতি ও জাতীয় রাজনীতিকে সম্পূর্ণ পৃথক রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে ক্যাম্পাসগুলোতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ চালুর বিকল্প নেই। কেননা, ছাত্রনেতা ছাত্রদের ভোটে নির্বাচিত না হলে সেখানে কখনোই ছাত্র রাজনীতি হয়ে উঠবে না- এটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া, ছাত্রদের অধিকার নিয়ে যারা কথা বলবে, তারা যেন হয় স্মার্ট, সুবক্তা, আদর্শবান, নীতিবান এবং সচ্চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী। কেননা, তারাই আমাদের দেশকে উপনিবেশবাদ থেকে মুক্ত করবে। নয়ত দেশের ছাত্র রাজনীতিতে যেভাবে বহুমুখী সংকট চলছে, এতে দেশ পরাধীন হতে বেশিদিন সময় লাগবে না।

একদলীয় ছাত্র রাজনৈতিক ব্যবস্থার কারণেই ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র রাজনীতির ছন্দপতন হয়েছে।

জুবায়ের রহমান

শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ

কুমিলস্না বিশ্ববিদ্যালয়।

শিক্ষার্থীদের একটি প্রজন্ম বড় হয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন, হত্যা, মারামারি, আবাসিক হলে সিট ও ভাতের রাজনীতির পাশাপাশি টেন্ডারবাজি ও নিয়োগ বাণিজ্যে ছাত্র রাজনীতির প্রভাব দেখে। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে ছাত্র সংগঠনগুলোর দরকষাকষি দেখা যায় না সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে। শত অন্যায় করেও পার পেয়ে যাচ্ছে তারা। নির্বিকার প্রশাসনও। যার দরুন ছাত্র রাজনীতির প্রতি শিক্ষার্থীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ছাত্র সংসদ না থাকায় একদলীয় ছাত্র রাজনৈতিক ব্যবস্থার কারণে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র রাজনীতির ছন্দপতন হয়েছে। সেই ছন্দ ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন ছাত্র সংসদভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির চর্চার। তাহলে ভোটের জন্য হলেও কেউ ক্যাম্পাসকে কারাগার বানিয়ে রাখবে না।

ছাত্র রাজনীতি মানে কি ক্ষমতাসীন দলের লেজুড়বৃত্তি, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করা?

মো. গোলাম রব্বানী

শিক্ষার্থী, তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক কৌশল বিভাগ

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতি থাকা দরকার কিংবা দরকার নয়, সে বিষয়ে আমি মত দিতে চাই না। তবে এই রাজনীতির যেমন ভালো দিক রয়েছে, তেমনি খারাপ দিকগুলোও প্রতীয়মান। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি কতটা প্রভাব রাখবে, আদৌ এর দরকার আছে কিনা, সে বিষয়ে সেখানকার শিক্ষার্থী-শিক্ষক সংশ্লিষ্টরা ভালো বুঝবেন। তবে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে কথা বলার আগে এই শব্দের সংজ্ঞায়ন করে নিলে আসলে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। ছাত্র রাজনীতি বলতে কী বোঝায় কিংবা এর আওতা বা পরিধি কতটুকু, এর ব্যাখ্যা থাকা দরকার। ছাত্র রাজনীতি মানে কি ক্ষমতাসীন দলের লেজুড়বৃত্তি করা? বড় নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করা? বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নিয়োগে বলপ্রয়োগ করা কিংবা এই সূত্রে গোপনে অর্থের লেনদেন করা? সাধারণ ছাত্রদের ওপর নিপীড়নমূলক কর্মকান্ড চালানো এবং আবাসিক হলগুলোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা? বয়স পার হয়ে গেলেও যেকোনো উপায়ে হলে থেকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে খবরদারি করা? এগুলো নিশ্চয়ই ছাত্র রাজনীতির চেহারা হতে পারে না। ছাত্র রাজনীতি তাহলে কী? ছাত্র রাজনীতি মানে নিজেদের কর্তব্য নির্ধারণ করতে পারা এবং কর্তব্য পালনে দায়িত্বশীল থাকা, সাধারণ ছাত্রদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে সরব ও সচেষ্ট থাকা, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক উন্নয়নে কাজ করা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইসু্যতে সচেতন থাকা ও মত প্রকাশ করা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি মুক্তচিন্তা ও বাক্‌স্বাধীনতার জন্য কাজ করা। ক্ষমতাসীন দলের মদদে নোংরা ছাত্র রাজনীতিকে সমর্থন কেউই জানাবে না। ওপর মহলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে ছাত্র রাজনীতি সীমা লঙ্ঘনের সুযোগ পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এখন ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতৃত্বের অপরাধমূলক কর্মকান্ডকে নীরবে সয়ে যায়। শুধু তাই নয়, রীতিমতো সমর্থন দিয়ে যায়। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগেও ছাত্রনেতারা চাপ প্রয়োগ করেন। এমনকি, উপাচার্য নিয়োগেও তাদের সুপারিশ গুরুত্বপূর্ণ! এসব নানান দিকগুলো এখন শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিষ্কার হচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের মানসিকতায়। এসবই ছাত্র রাজনীতির বিমুখতার কারণ। এদিকে বায়ান্ন'র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা থাকবে, যেখানে ছাত্রদের ভূমিকা অপরিসীম। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো সুস্থ ধারার দল-মত ভেদাভেদ ভুলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন প্রয়োজন। যারা সব সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালোর পথে, শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায় থেকে শুরু করে পক্ষপাতহীনভাবে কাজ করবে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন এবং সেটার নিয়মতান্ত্রিক চলমান প্রক্রিয়া ছাত্র রাজনীতিকে হয়ত ভালোর পথে আনতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে