শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভাবনা

যুগে যুগে দেশ-জাতির উন্নয়নে শ্রমিক শ্রেণির অবদান অনস্বীকার্য। আজকে এই সভ্য সমাজের উঁচু অট্টালিকা থেকে যা কিছু দৃশ্যমান সবকিছুতেই মেহনতি মানুষের পরিশ্রমের ফলস। বিশ্বব্যাপী শ্রমিক আন্দোলনের অর্জনকে স্মরণ করার জন্য প্রতি বছর পহেলা মে বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালিত হয়। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে বড় হাতিয়ার শ্রমিক শ্রেণি। অথচ তারাই সমাজে অবহেলিত, উপেক্ষিত। প্রতিনিয়ত শোষণ-বঞ্চনা ও নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। পরিতাপের বিষয়, এখনো শ্রমিকদের নিজেদের ন্যায্য মজুরি, উপযুক্ত কর্মপরিবেশের জন্য রক্ত দিতে হয়। শোষণহীন সমাজ গঠনে শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে কী ভাবছেন শিক্ষার্থীরা? এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মতামত তুলে ধরেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মো. সাইফুল মিয়া।
  ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভাবনা

শ্রমিক শোষণ বন্ধ হোক

হাসনা বেগম

শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে একদল শ্রমিক তাদের কারখানায় দৈনিক ১০ ঘন্টার পরিবর্তে ৮ কর্মঘণ্টা নির্ধারণের দাবি জানায়। তাদের দাবি পূরণের সময় নির্ধারিত হয় ১৮৮৬ সালের ১ মে। কিন্তু তাদের দাবি কারখানার মালিকেরা কর্ণপাত করেনি। ১৮৮৬ সালে শিকাগুর হে মার্কেটে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর গুলি বর্ষণ করা হয়। নিহত হয় ১০-১২ জন। তারপর থেকে তাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে মে দিবস পালন করা হয়। এ দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য শ্রমিকদের তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে সোচ্চার করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য বাংলাদেশেও শ্রমিকরা তাদের যোগ্য মজুরি, সম্মান, ভাতা, সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত। প্রতি বছর মে দিবস পালন করা হলেও তাদের অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না। মালিকপক্ষের কাছে প্রতিনিয়ত শোষিত হচ্ছে শ্রমিকরা। অথচ বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে শ্রমিকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে সকলের কার্যকরী ভূমিকা প্রয়োজন। সর্বোপরি, শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই মে দিবস অর্থবহ হয়ে উঠবে।

হাসি ফুটুক শ্রমজীবী মানুষের মুখে

ফারহানা আফসার মৌরী

শিক্ষার্থী, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা

বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

শ্রম ও শ্রমিকদের শ্রদ্ধার্থে মে মাসের প্রথম দিনটি উৎসর্গ করা হয়। দিনটি তাদের জন্য এক উৎসবের দিন, শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দিন। শ্রমিকের শোষণ মুক্তির অঙ্গীকারনামা হিসেবে পালিত দিনটির তাৎপর্য ও গুরুত্ববহ। তবে যতই তাৎপর্য কিংবা গুরুত্ব সহকারে দিনটি পালন করা হোক না কেনো; সমাজের চিত্র অন্য দৃশ্য উপস্থাপন করে। এখনো কোনো না কোনো স্থানে শ্রমিকেরা নির্যাতিত হচ্ছে। শিশুরা অবুঝ বলে তাদের দিয়ে অল্প খরচে বেশি টাকার কাজ করানো হচ্ছে। বয়স্কদের করা হচ্ছে না সম্মান। আর এভাবে শ্রমিক বৈষম্য আজন্ম থেকে যাচ্ছে। তাই আমাদের উচিত বছরের শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একটি দিনকে গুরুত্ব না দিয়ে সত্যিকার অর্থেই শ্রমিকদের গুরুত্ব দেওয়া। তাদের জীবনকে মূল্য দিয়ে তাদের বেঁচে থাকার অর্থ সফল করা। সকল শ্রমিকের মুখে সন্তুষ্টির হাসি ফোটাতে পারলেই স্বার্থক হবে আমাদের মে দিবস। আমাদের সকলকে মে দিবসের তাৎপর্যকে নিজেদের মধ্যে লালন করতে হবে। সাহস নিয়ে শ্রমিকদের পাশে দাড়াতে হবে।

মেহনতি মানুষের মুক্তির পরিচায়ক

সুস্মিতা চক্রবর্তী

শিক্ষার্থী, সমাজতত্ত্ব বিভাগ,

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মে দিবস বিশ্বের সকল শ্রমজীবী মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন যা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস নামেও পরিচিত। ১৮৮৬ সালের এই দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে জমায়েত হয়। তখন পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাত বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। ফলে প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ মৃতু্যবরণ করে। সেদিন তাদের আত্মদানের মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মালিক-শ্রমিক সম্পর্কে এই দিবসের গুরুত্ব ও প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এর ফলে শ্রমিকদের দৈনিক কাজের সময় নেমে আসে ৮ ঘণ্টায়। মে দিবসের সফলতার মাধ্যমে উন্নত কর্মপরিবেশ, শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক, শ্রমিকের পেশাগত নিরাপত্তা ও সুস্থতাসহ সার্বিক অধিকার নিশ্চিতের পথ সুপ্রসস্থ হয় যার ফলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথ সুগম হয়ে উঠে। সর্বোপরি মে দিবস নিপীড়িত শ্রমজীবী মানুষকে শোষণ পরাধিনতার শৃঙ্খল থেকে অনেকটাই মুক্ত করেছে এবং ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রামের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে।

শ্রমজীবী মানুষের যথার্থ সম্মান নিশ্চিত হোক

মো. দিদার আলী সরকার।

শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা

ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মে দিবস শ্রমিকদের সংগ্রামের ইতিহাস ও ভবিষ্যতের আশার প্রতীক। শ্রমিকরা তাদের পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড স্থাপন করে। কলকারখানা, কৃষি, পরিবহণ, নির্মাণ, পোশাক শিল্প-সকল ক্ষেত্রেই তাদের অবদান অনস্বীকার্য। শ্রমিকদের ত্যাগের মাধ্যমে আমরা সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করি। আমাদের পোশাক, খাদ্য, বাসস্থান সবকিছুর পেছনে রয়েছে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম। মে দিবস শ্রমিকদের ঐক্য ও সংহতির প্রতীক। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমাদের সমাজের উন্নয়নে শ্রমিকদের অবদান অপরিসীম। তাদের পরিশ্রম ও ত্যাগের বিনিময়েই আমরা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে পারি। মে দিবস শুধু একটি দিনের উৎসব নয়, বরং এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। মে দিবস শ্রমিকদের সংগ্রামের ইতিহাস স্মরণ করার এবং তাদের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করার একটি সুযোগ। আমাদের সকলের উচিত এই দিনটিকে শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার দিন হিসেবে পালন করা।

আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি শ্রমিকের অধিকার।

মু. এমরানুল হক আকিব

শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ,

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

১৮৮৬ সালের ১ মে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে প্রাণ দেওয়া শ্রমিকদের স্মৃতির জন্য প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে মে দিবস পালিত হলেও এখনো সর্বত্র বাস্তবায়ন হয়েছে শ্রমিকদের অধিকার। তাই বর্তমানেও অধিকার আদায়ের দাবিতে রাজপথে মিছিল করতে হয় শ্রমিকদের। কখনো কখনো অমানবিক নির্যাতনের সম্মুখীনও হতে হয়। মধ্যযুগের দাস-মালিক সম্পর্কের মতো বর্বর কায়দায় গৃহকর্মীর ওপর অত্যাচারের শিরোনাম হয় অভিজাত শ্রেণীর মানুষজন। সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার যুগে আজও কেনো শ্রমিকেরা অধিকার বঞ্চিত? শ্রমিকের রক্ত পানি করা পরিশ্রমের বদৌলতে বিত্তশালী বনে যাওয়া পুঁজিপতিরা শ্রমিকের শ্রমের ন্যায্যমূল্য নারাজ। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশে আজও শিশু শ্রম লক্ষণীয়। মে দিবসের পথ ধরে উন্নত বিশ্বে শ্রম অধিকার নিশ্চিত হলেও আমাদের মত দেশগুলোতে এখনো শ্রমিকের উপযুক্ত মজুরি, জীবনের নিশ্চয়তা, স্বাস্থ্য ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশ ও নারীদের নিরাপদ কর্মস্থল সৃষ্টি করতে পারেনি। এ দুরাবস্থার অবসান ঘটিয়ে মালিক-কর্মচারী সুসম্পর্ক গড়ে উঠুক। শ্রমিকের যথার্থ মূল্যায়ন হোক মে দিবস আমাদের অঙ্গীকার।

শ্রম মূল্যায়ন এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি

সোলায়মান রহমান।

শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

১৮৮৬ সালের পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে ন্যায্য মজুরি এবং দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে অনেক শ্রমিক হতাহত হন। আর এরপর থেকেই এই দিনটি পালিত হয়ে আসছে মে দিবস বা শ্রমিক দিবস হিসেবে।

মূলত সেই ঘটনার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালন করা হয়। সেদিন দৈনিক ৮ ঘণ্টার কাজের দাবিতে শ্রমিকরা হে মার্কেটে জমায়েত হয়েছিলেন তাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে। তাদের প্রতি যেনো সুবিচার করা হয়।আজ একুশ শতকে এসেও আমরা তাদের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল হতে পেরেছি তা আজো প্রশ্নবিদ্ধ। মে দিবসে শ্রমিক শ্রেণির মানবেতর জীবনের অবসান ঘটানোর অঙ্গীকার নিতে হবে আমাদের সবাইকে। সবচেয়ে যা জরুরি তা হলো, শ্রমের মর্যাদা নিশ্চিত করা। শ্রমিক শ্রেণি সামাজিকভাবে মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি এখনো। সমাজের অন্যান্য পেশার মানুষের মতো শ্রমিকদেরও একটি মর্যাদাসম্পন্ন শ্রেণি হিসেবে দেখা উচিত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে