চলছে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র রমজান মাস। সিয়াম সাধনার এ মাসে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোর অধিকাংশ শিক্ষার্থীই রোজা পালন করেন। দেশের নানা প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার জন্য আসেন। এখানে এসে তাদের থাকতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল বা মেসে। ফলে পরিবার থেকে শত মাইল দূরেই থাকেন এসব শিক্ষার্থী। আর তাই চাইলেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাহরি কিংবা ইফতারের সুযোগ পান না। এটি নিয়ে অনেকেরই মন খারাপ থাকে। তবে এই শূন্যতা অনেকটাই দূর করে ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সঙ্গে ইফতারের আয়োজন। রমজানে বিশেষত ইফতারকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে একটি রবরব পরিবেশ বিরাজ করে। এ সময় সবাইকে দল বেঁধে ইফতার সামগ্রী কেনা ও ইফতার আয়োজন সম্পন্ন করতে দেখা যায়। ক্যাম্পাস জীবনে একসঙ্গে ইফতার তাদের উৎফুলস্ন করে তোলে। এতে নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরও দৃঢ় হয়। সম্মিলিত ইফতার যেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে একটি ঐতিহ্য হিসেবে পরিণত হয়েছে।
ঢাবি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই একত্রে ইফতার করে। ইফতার উপলক্ষে সন্ধ্যা নাগাদ মুখরিত হয়ে উঠে টিএসসি এলাকা। টিএসসি এলাকা ছাড়াও ক্যাম্পাসের সড়কদ্বীপ, মিলন চত্বর, হাকিম চত্বর, কার্জন হল, রোকেয়া হলের সামনে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটক, সবুজ চত্বর, মলচত্বর, বিভিন্ন হলের মাঠসহ ক্যাম্পাসের আনাচে-কানাচের সব জায়গা সরগরম হয়ে উঠে ইফতার করতে আসা শিক্ষার্থীদের পদচারণায়। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া তরুণদেরও ইফতারের প্রিয় স্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সবার উদ্দেশ্য সারা দিনের সিয়াম সাধনার পর বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আনন্দে ইফতার করা এবং ইফতারের পর একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া।
শিক্ষার্থীদের ইফতারে ছোলা, মুড়ি, খেজুর, জিলাপি, বেগুনি, পেঁয়াজু, চিকেন, পাকুড়া, বুন্দিয়া, আলুর চপের পাশাপাশি থাকে বিভিন্ন রকমের পানীয়, শরবত, জুস, কলা, আপেলসহ নানা জাতের ফল থাকে। কেউ কেউ ভালো রেস্তোরাঁ থেকে বিরিয়ানি বা পোলাও আনেন। অনেকেই আবার ইফতার তৈরি করে আনেন বাসা বা হল থেকে। সবুজ ঘাসের ওপর খবরের কাগজ বিছিয়ে ইফতারের পাশাপাশি চলে জমজমাট আড্ডা। এছাড়া টিএসসির মূল অডিটোরিয়াম, গেমস রুম, ক্যাফেটেরিয়া কিংবা সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কার্যালয়েও চলে নানা ধরনের ইফতার আয়োজন। এসবের আয়োজনে করে মূলত বিভিন্ন জেলা সংগঠন, টিএসসির সামাজিক সংগঠন ও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-কর্মকর্তারা এবং সাবেক শিক্ষার্থীরাও তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে ইফতার করতে আসেন।
জবি
সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির মেলবন্ধনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, অবকাশ ভবন, শান্ত চত্বর, মুক্তমঞ্চ, কাঁঠালতলা, রফিক ভবনের প্রতিটি তলার বারান্দা, বিবিএ ভবনের নিচতলায় পুরোটাজুড়ে, বিজ্ঞান অনুষদ প্রাঙ্গণ, পোগোজ স্কুলের খেলার মাঠ ছাড়াও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন আঙিনায় জমে ওঠে ইফতারের মহোৎসব। তন্মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণোচ্ছল পরিবেশ দেখা যায় শহীদ মিনারে। ক্যাম্পাসের জুনিয়র-সিনিয়র সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির মেলবন্ধনে প্রাণচাঞ্চল্য হয়ে উঠে ইফতার আয়োজন। ক্যাম্পাসে ছোট ছোট দলে ছড়িয়ে আড্ডা গল্পের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা ইফতারের আয়োজন করেন।
জাবি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করার প্রত্যয়ে ইফতার আয়োজন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, টিএসসি, আবাসিক হল, 'টারজান' পয়েন্ট, পরিবহণ চত্বর ইত্যাদি বহুল পরিচিত স্থানে শিক্ষার্থীরা ইফতার করেন। এছাড়া আবাসিক হলের ছাদ, মাঠ, ডাইনিং-ক্যান্টিনেও ইফতারে মিলিত হন শিক্ষার্থীরা। তবে ইফতারের জন্য শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, যা শিক্ষার্থীদের কাছে 'সেন্ট্রাল ফিল্ড' নামে পরিচিত। তবে বন্ধুমহল ছাড়াও সিনিয়র-জুনিয়র, বিভিন্ন বিভাগ ও সংগঠনও ইফতার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। প্রতিদিন বিকাল হলেই খেলার মাঠ শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট জটলায় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। আকাশে বজ্রের চোখ রাঙানি, কাকভেজা বৃষ্টির ভয় উপেক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখানে ইফতারের জন্য জমায়েত হন। বর্তমান শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অনেক সাবেক শিক্ষার্থী, এমনকি আশপাশের বহিরগতরাও এখানে ইফতার করতে আসেন। ইফতারের আগ মুহূর্তে এখানে পথশিশু, দুস্থ-অসহায় ব্যক্তিদের আগমন ঘটে, যাদের পক্ষে অর্থ দিয়ে মজাদার ইফতার সামগ্রী কেনা সম্ভব নয়। এখানে আগত অনেকেই অসমর্থ মানুষের সঙ্গে ইফতার ভাগাভাগি করে নেন।
চবি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হল, ক্যাফেটেরিয়া, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, শহীদ মিনার, স্টেশন চত্বর, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণসহ বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা দলবেঁধে ইফতারের আয়োজন করেন। অনেকেই বন্ধুদের নিয়ে ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসের ওপর পত্রিকা বিছিয়ে ইফতার করেন। এতে যেন সব ক্লান্তি নিমেষেই দূর হয়ে যায়। ইফতার করাটাকে তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন হিসেবে মনে করেন। ক্যাম্পাস জীবনের শুরু থেকেই অনেকে সব ধর্মের বন্ধুরা একত্রে ইফতার করে। এতে করে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয় বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। একে অন্যের সঙ্গে ইফতারি ভাগ করে তারা ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরও অটুট করেন। ক্যাম্পাসে যে শুধু বর্তমান শিক্ষার্থীরা ইফতার করেন তা কিন্তু নয়, দূর-দূরান্ত থেকে দল বেঁধে সাবেকরাও একসঙ্গে ইফতার করতে ছুটে আসেন।
রাবি
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আছরের আজানের পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন খেলার মাঠে খোলা আকাশের নিচে দেখা যায় ইফতার আয়োজনের দৃশ্য। বন্ধুবান্ধব ও পরিচতজনদের নিয়ে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বাহারি পদের ইফতারির আয়োজন করে থাকে শিক্ষার্থীরা। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করে এসব ইফতারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ হবিবুর রহমান হল মাঠ, শেখ রাসেল মডেল স্কুল মাঠ, শহীদ মিনার চত্বর, ইবলিশ চত্বর ও শাবাশ বাংলাদেশ মাঠ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর ছাদ, টিভিরুমসহ বিভিন্ন বিভাগের কক্ষেও ইফতার আয়োজন করে থাকে শিক্ষার্থীরা। ছোট ছোট বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ইফতার করেন শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে থাকে বিভিন্ন বিভাগ ও ব্যাচের পক্ষ থেকে আয়োজিত ইফতার, থাকে জেলাভিত্তিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সাংবাদিক সংগঠনসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত ইফতার।
কুবি
কুমিলস্না বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, শহীদ মিনার, মুক্তমঞ্চ, কাঁঠালতলা, ক্যাফেটেরিয়ার ছাদ, বিভিন্ন বিভাগের করিডর, অনুষদের হলরুম, ছাদের আঙিনা, ব্যাডমিন্টন কোর্টসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে শিক্ষার্থীদের আয়োজনে জমে উঠে ইফতারের মহোৎসব। এসব স্থানের পরিবেশ হয়ে উঠে প্রাণোচ্ছল। এ যেন সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির ভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধনের এক অপরূপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে ইফতারির আয়োজন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, আঞ্চলিক সংগঠনগুলোও ইফতারের আয়োজন করে থাকে। এতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকরাও শামিল হন।
খুবি
রমজানের শিক্ষা নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সর্বস্তরে ইসলামী সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে ইফতারের আয়োজন করে। শিক্ষার্থীরা আছরের নামাজের পর থেকেই একে একে জড়ো হতে থাকেন। এরপর অনেকে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে কোরআন তিলাওয়াত, হামদ-নাত ও ইসলামী বিভিন্ন পরিবেশনা করতে থাকেন। দোয়া ও মোনাজাত পর্বের পর মাগরিবের আজান দিলে সবাই একসঙ্গে ইফতারি করেন। রমজানের মাহাত্ম্য নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব তুলে ধরতে ও ইসলামে সাংস্কৃতিক বিকাশের লক্ষ্যে একসঙ্গে সবাই ইফতার করেন বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা।
হাবিপ্রবি
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা টিএসসিতে প্রতিদিন ইফতারের আয়োজন করে থাকে। ছেলে এবং মেয়ে শিক্ষার্থীরা আলাদা আলাদাভাবে বসে ইফতার গ্রহণ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যোবায়ের আলী বলেন, বাঙালির চিরায়ত মুসলিম সংস্কৃতি রমজান, সাহরি ও ইফতার। এই সংস্কৃতি ও ধর্মীয় রীতি। শিক্ষার্থীরা সবাই মিলে ক্যাম্পাসে ইফতার করবে এটাই ভাতৃত্ব ও সম্প্রীতির শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
বেরোবি
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, স্বাধীনতা চত্বর মাঠ, ক্যাফেটেরিয়ার সামনের মাঠ, সেন্ট্রাল লাইব্রেরির আশপাশ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পয়েন্টে চলে শিক্ষার্থীদের ইফতারির মহোৎসব। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছাড়াও মাঝেমধ্যে দর্শনার্থীরা ক্যাম্পাসে বসে ইফতারের স্বাদ নেন।
এছাড়া নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল ফিল্ডে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ডুয়েট, চুয়েটসহ বিভিন্ন পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রীতির ইফতার আয়োজন করা হয়েছে।