একদল স্বপ্নবাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী, ক'দিন পরেই বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে কর্মক্ষেত্রে যোগ দেবেন এ তরুণরা। তাদের পুথিগত শিক্ষা থাকলেও বাস্তব অভিজ্ঞতা শূন্যের কোঠায়। তাই একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের কর্ম উপযোগী করতে, সরাসরি সংশ্লিষ্ট ইন্ডাস্ট্রির পরিবেশের সঙ্গে পরিচিতি ঘটাতে ও বাস্তবক জ্ঞান আহরণের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের ব্যবসা প্রশাসন বিভাগের হিউম্যান রিসোর্স ক্লাবের পক্ষ থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল টু্যরের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সদাহাস্য সহযোগী অধ্যাপক জাহিদ হাসান ভূইয়া স্যার কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট ক্লাসে ইন্ডাস্ট্রিয়াল টু্যরের আলাপ তুলতেই আমরা হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের শিক্ষার্থীরা অধীর আগ্রহ ও উৎসাহ বোধ করি। স্যার খুবই দক্ষ ও চৌকস মানুষ, আমাদেরকে টু্যর বাস্তবায়নে অল্প কিছু কাজ বুঝিয়ে দেন, বাকি সবকিছুর সমন্বয় স্যার নিজেই করেছেন।
আমাদের গন্তব্য নির্ধারণ করা হয় ডেনিম পণ্য রপ্তানির তৈরি পোশাক খাতের সুপারস্টার হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামভিত্তিক বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ রফতানিকারক শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্স গ্রম্নপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক অনুমতি ও প্যাসিফিক জিন্সের সঙ্গে চূড়ান্ত আলাপ করে তাদের চট্টগ্রাম ইপিজেড ইউনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের দু'টি বাস নিয়ে সত্তর জন শিক্ষার্থী ও ডজনখানেক ফ্যাকাল্টি অংশ গ্রহণ করার প্রাথমিক তালিকা ও সার্বিক পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়।
ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের গল্প বইয়ের পৃষ্ঠায় পড়েছি কেস স্টাডি হিসেবে। পত্রিকায় ও টেলিভিশনে বাইরের চাকচিক্য দেখেছি, কিন্তু বিশাল কর্মযজ্ঞের অন্দরমহল দেখতে যাব রাত পোহাতেই এমন চিন্তায় দারুণ সুখ অনুভব হয়। অপেক্ষার প্রহর কেন যেন দীর্ঘ মনে হয়, স্যারদের সঙ্গে নিয়ে আমাদের ক্যারিয়ার অভিমুখী চিন্তায় ইন্ডাস্ট্রিতে একবেলার এ টু্যর। সকাল সাত ঘটিকায় প্রস্তুতি নিয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়ি। বহদ্দারহাট টার্মিনালে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল টু্যরের ব্যানারে সজ্জিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস। ব্যবসা প্রশাসন বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডক্টর আকতারুজ্জামান স্যারের নেতৃত্ব আমাদের এ ইন্ডাস্ট্রিয়াল টু্যর। স্যার তার ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে চকবাজার পয়েন্টে এসে আমাদের বহরে যোগ দিয়েছেন, চেয়ারম্যান স্যার ও অন্য ফ্যাকাল্টিদের সঙ্গে আমরা যাত্রা শুরুতে গ্রম্নপ ফটোসেশান সেরে নেই।
মেইল শিক্ষার্থীদের বাসে এমবিএ কো-অর্ডিনেটর জোনায়েদ কবির স্যার ও ডক্টর রহিম স্যার এবং ফিমেল বাসে ডক্টর আহসানুল হক মামুন স্যার ও এইচআর ক্লাবের প্রেসিডেন্ট মো. মাহমুদুল ইসলাম স্যার সার্বিক দিকনির্দেশনা ও নেতৃত্ব দেন। আমাদের ছাত্র বাসে এইচ আর ক্লাবের জিএস আমি খালেদ সাইফুলস্নাহ, বন্ধু সিনিয়র এজিএস ইশরাক হাসান ও জুনিয়র তাশদীদ ইসলাম দায়িত্ব পালন করি। ছাত্রী বাসে এইচ আর ক্লাবের ফিমেল চ্যাপ্টারের জিএস রেহেনুমা নাহার ও সিনিয়র এজিএস ফাবলিহা আফাফ ও এজিএস জান্নাতুল নেছা জেমি দায়িত্ব পালন করে। বাসে বহদ্দারহাট, চকবাজার, ওয়াসা, লালখান, টাইগার পাস পয়েন্ট থেকে একে একে সবাই যুক্ত হন? বাসে সবার জন্য সকালের স্ন্যাক্স ও পানি দেওয়া হয়।
বাসের জানালা থেকে কন্টেইনারবাহী ট্রাকের সারি দেখে আঁচ করি আমরা ইপিজেড এলাকায় পৌঁছে গেছি। বিশেষায়িত এলাকা হওয়ায় সিকিউরিটি গার্ড আমাদের আটকে দেয়, নেমে কথা বলে অনুমতিপত্র দেখিয়ে আমরা প্রবেশ করি। গাড়ি এসে প্যাসিফিক জিন্সের একটি ইউনিটের সামনে পার্কিং করলে আমরা নেমে পড়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে আমাদেরকে কিছু দিক নির্দেশনা দেওয়া হয় ইন্ডাস্ট্রির অভ্যন্তরে প্রবেশের সময়ে।
আগত শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানাতে ও ইন্ডাস্ট্রির প্রফেশনালদের থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমাদের অবগত করতে এক ওয়ার্কশপের আয়োজন করে প্যাসিফিক জিন্সের ছয়তলায় অডিটোরিয়ামে। প্রধান অতিথি হিসেবে প্যাসিফিক জিন্স গ্রম্নপের পরিচালক লুথমেলা ফরিদ নিজেই উপস্থিত হন। তার বক্তব্যে এমন শিক্ষা-উদ্যোগে সহযোগিতার ঘোষণা দেন এবং ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে একাডেমিক কোলাবোরেশান করে গবেষণা কাজে গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন। এজিএম এইচআর প্রশাসন মেজর মো. শরীফুজ্জামান তার বক্তব্যে ছাত্রদেরকে আগামীর এইচআর দক্ষ জনশক্তি হিসেবে প্রস্তুত থাকতে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতিমূলক দিক তুলে ধরেন ও তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। জিএম হেড অব এইচআর প্রশাসন মেজর স্বাধীন তাইয়েব তার বক্তব্যে প্রোফেশনাল গ্রম্নমিং-এর প্রয়োজনীয়তা উলেস্নখ করে ছাত্রদেরকে তাদের সামগ্রিক পেশাদারি উন্নত করতে কীভাবে কাজ করবে সেই পরামর্শ দেন।
সহযোগী অধ্যাপক জাহিদ হাসান ভূইয়া স্যার সঞ্চালকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়ে একে একে প্রফেসর ডক্টর নেজামুল হক, প্রফেসর ডক্টর আব্দুলস্নাহিল মামুন স্যারসহ আমাদের সঙ্গে আগত সব ফ্যাকাল্টির পরিচয় করিয়ে দেন। আইআইইউসি ব্যবসা প্রশাসন বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডক্টর আকতারুজ্জামান স্যার সমাপনী বক্তব্যে এমন সুযোগ সৃষ্টি করায় প্যাসিফিক জিন্সকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে প্রথম পর্বের সমাপনী করেন। কর্তৃপক্ষ আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের জন্য স্ন্যাক্সের ব্যবস্থা করেছিলেন?
ইন্ডাস্ট্রি পরিদর্শন করানোর জন্য আগত শিক্ষার্থীদের পাঁচটি দলে বিভক্ত করা হয়? ছয় তলা থেকে পরিদর্শন শুরু হয়, একেক ট্রেডে একেক ধরনের কাজ। হাজার হাজার পোশাক শ্রমিকের বিশাল কর্মযজ্ঞ। বিভিন্ন পর্যায়ের কলাকৌশল, প্রযুক্তির ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট সার্বিক বিষয়গুলো দেখানো হয়। এ সময় উৎসুক শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেন টিমের সঙ্গে থাকা কর্মকর্তারা। ছয়তলা থেকে ঘুরতে ঘুরতে একেক ফ্লোরের কর্মযজ্ঞ পরিদর্শন করে করে নিচতলা পর্যন্ত আসি আমরা। বাইরের সুনসান নীরবতার ভবনের অভ্যন্তরে এত বিশাল কর্মযজ্ঞ তা পরিদর্শন না করলে কল্পনা করাও অসম্ভব। এ পোশাকগুলো সুদূর ইউরোপ-আমেরিকায় রপ্তানি হয় সরাসরি।
১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী প্রয়াত মো. নাছির উদ্দিন। বাবার অবর্তমানে ব্যবসার হাল ধরে দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে নিচ্ছেন তার সন্তানরা। বর্তমানে ৩৫ হাজার কর্মী নিয়ে তাদের প্রস্তুত করা পণ্য রফতানি হচ্ছে বিশ্বের প্রায় অর্ধশতাধিক দেশে। ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পোশাক রফতানির লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে টেকসই পরিকল্পনাসহ নানা দিক নিয়ে হেড অব সাসটেইনেবিলিটি আনোয়ার হোসেন আমাদের অবগত করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এইচ আর ক্লাবের আয়োজিত কর্মশালায়। তখন থেকে সুপ্ত ইচ্ছে ছিল এ বিশাল কর্মযজ্ঞ সরাসরি দেখার, তা আজ আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়েছে।
আনুষ্ঠানিক ফটোসেশান শেষে এবার বিদায়ের পালা। সবাই একে একে বাসে ওঠে পড়ি। সবার উপস্থিতি নিশ্চিত করে বাস এগিয়ে চলছে জিইসি অভিমুখে। হোটেল জামানে আয়োজন করা হয়েছে আমাদের জন্য বিশেষ লাঞ্চ। স্যাররা আমাদের সবার খাবারের ব্যবস্থাপনা করে সার্বিক খোঁজখবর নিয়ে সবশেষে বসেছেন নিজেদের লাঞ্চের টেবিলে। শ্রেণিকক্ষের বাইরে স্যারদের এমন আন্তরিকতা, অভিভাবকসুলভ আচরণ, বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার আমাদেরকে বিমোহিত করেছে। স্মৃতির পাতায় অমলিন হয়ে থাকুক আমাদের একবেলার ইন্ডাস্ট্রিয়াল টু্যর।