'একুশে ফেব্রম্নয়ারি' শুধু একটি দিবস নয়। বরং বাঙালি জাতির আবেগ, অহংকার কিংবা পরিচয়ের এক অসামান্য প্রতীক। কারণ পুরো বিশ্ববাসী এই দিনে তো চিনে ছিল বাংলাদেশকে। প্রথমবারের মতো ভাষার জন্য বাংলার সূর্য সন্তানরা যে বুক পেতে দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন যেই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাংলার ছেলেরা নিজের বুকের রক্ত দিয়ে ভাষায় জন্য প্রাণ দিয়েছে তাদের সেই আকাঙ্ক্ষা আমরা কতটুকু পালন করতে পারছি। কিংবা আদো পালন করছি তো? মাতৃভাষা দিবসের শহীদের আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে একঝাঁক মেধাবী শিক্ষার্থীর মতামত জানাচ্ছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ নাদের হোসেন ভূঁইয়া।
অমর একুশে, দুঃখিনী বর্ণমালা এবং আমাদের দায়
শতাব্দী রায়
এমবিবিএস ৪র্থ বর্ষ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ।
'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'- ১৯৫২'র অবিসংবাদিত সেস্নাগান; ১৬ বছরের ব্যবধানে যা রূপ নিয়েছিল 'বাংলাভাষার রাষ্ট্র চাই' সেস্নাগানে। যে ভাষার মর্যাদাহানি রুখতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন প্রথম দেখেছিল চিরকালের শান্তিপ্রিয় এক জাতি- সেই ভাষার বর্ণমালা তো ছড়ায় মায়ের গায়ের মিষ্টি গন্ধ; তাহলে সে বর্ণমালা দুঃখিনী হবে কেন?
শামসুর রাহমান 'বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা' কবিতাটি লিখেছিলেন অবরুদ্ধ পরাধীন স্বদেশে কিন্তু আজ স্বাধীনতার ৫২ বছর অতিক্রান্ত হবার পরেও কি কবিতাটি ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক নয়?
আজ বর্ণমালার অঙ্গহানি কিংবা সাহিত্যের অযাচিত মেরুকরণের চেষ্টারত শাসকগোষ্ঠীর কবলে আমরা নেই সত্যি, কিন্তু তা সত্ত্বেও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রুখতে আমরা এক অর্থে ব্যর্থই হয়েছি- মুখের ভাষা থেকে লেখা, সব ক্ষেত্রেই এ ব্যর্থতা প্রকট।
এ থেকে উত্তরণের দায় আসলে আমাদের সবারই বিশ্বায়নের যুগে সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশ ঠেকানোর চেষ্টা যৌক্তিক নয়, বরং দৃষ্টি ফেরানো যেতে পারে অতীতের দিকে, যখন তিলোত্তমা বাংলা দুহাতে যেমন বিলিয়েছে, তেমনি গ্রহণ করেছে নানা দেশ-জাতি-সংস্কৃতির উপাদান, কিন্তু হারায়নি স্বকীয়তা। কালের কষ্টিপাথরে যাচাই হয়ে কিছু হয়তো টিকেছে, বাকিটা হারিয়ে গেছে মহাকালের গহ্বরে। ব্যক্তিগত মনন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা- সব ক্ষেত্রেই শিকড়ের সাথে সংযোগটা শক্তিশালী রাখতে হবে, তবেই এড়ানো যাবে বিশ্বায়নের হাওয়ায় বাস্তুহারা হওয়ার আশঙ্কা।
একুশে ফেব্রম্নয়ারি আমাদের মায়ের ভাষার জয়গান
আবদুলস্নাহ আল মাহমুদ
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মা, মাতৃভূমি, মাতৃভাষা এই তিনটি বিষয়বস্তু ছাড়া একটি মানুষ অসম্পূর্ণ। মাতৃ পরিচয় থেকেই আত্মপরিচয় আসে। আর মাতৃ পরিচয়ের মূলে রয়েছে মাতৃভাষা। সব জাতির একটি নিজস্ব মাতৃভাষা থাকে যা তাদের পরিচয় বহন করে। বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা। এই বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে পাওয়ার পেছনে রয়েছে বাংলা মায়ের সন্তানদের বুকের তাজা রক্ত। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারিতে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮, বৃহস্পতিবার) বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এতে রফিক, জব্বার, শফিউর, সালাম, বরকতসহ অনেকেই শহীদ হন। রক্তাক্ত সেই স্মৃতিময় দিনটিকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধু আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করেনি বরং অমর একুশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই ভাষা আমাদের মায়ের ভাষা। এই ভাষা লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া ভাষা। এই ভাষা রক্ষা করা এবং যথাযথভাবে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের সবার।
\হ
ঐতিহ্যের একুশ
তানজিলা হক অপরাজিতা
আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
'আবার ফুটেছে দেখো কৃষ্ণচূড়া শহরের পথে পথে'
কৃষ্ণচূড়া মানেই বসন্ত, যে বসন্তে প্রাণ দিয়েছিল সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের মতো দেশপ্রেমিকেরা। যাদের ত্যাগে আজ বাংলায় এই লেখাটি লিখতে পারছি। আজ থেকে প্রায় ৭২ বছর আগে ঐতিহাসিক ৮ই ফাল্গুনে ঢাকার রাস্তায় প্রতিবাদের আগুন ঝরেছিল। তবে যে মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিল, লড়াই করল আপামর জনগোষ্ঠী, তাদের ত্যাগকে তুচ্ছ করা হয় এই মিষ্ট ভাষার বিকৃতিতে। অশুদ্ধ ব্যবহারে আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে জর্জরিত করা মাকে কষ্ট দেওয়ার সমান।
তাই মাতৃভাষার জন্য একুশের স্বীকৃতি পাওয়ার রজতজয়ন্তীর এই বছরে আমাদের লক্ষ্য হোক নিজে শুদ্ধ বাংলার ব্যবহার করা, বাংলা নিয়ে নিঃসংকোচ হওয়া, মাঠপর্যায়ে শুদ্ধতা নিশ্চিত করা। মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দেওয়ার এই অনন্য কীর্তিকে বছরব্যাপী সুষ্ঠু উদযাপনে আমরা যেন একুশের ঐতিহ্যকে হৃদয়ে ধারণ করি।
মাতৃভাষা দিবস আমাদের অহংকার
মোহাইমিনুল ইসলাম জিপাত
পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।
একুশে ফেব্রম্নয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। প্রতিবছর এই দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের আপামর জনগণ মহান ভাষা আন্দোলনের সূর্যসন্তানদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। অমর একুশের চেতনা বিশ্বব্যাপী মানুষকে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা করার আহ্বান জানায়। তবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণে আমাদের আরও বেশি পরিশ্রমী হওয়া প্রয়োজন। তথ্য প্রযুক্তি দ্বারা চালিত আজকের এই যুগে, প্রতিযোগিতামূলক এবং বিশ্বের নানা অগ্রগতির সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য বর্তমান প্রজন্মকে অবশ্যই যোগাযোগের আন্তর্জাতিক মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত বিভিন্ন ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন আমাদের নিজস্ব ভাষার উন্নয়ন ও সংরক্ষণের পাশাপাশি বহুভাষিক শিক্ষার একটি টেকসই ভবিষ্যতের আশা জাগিয়ে তোলে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বাঙালি জাতি নয়, বিশ্বের প্রতিটি জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা, অধিকার, স্বাধীনতা ও মানুষের বাঁচার দাবিকে উদ্ভাসিত করেছে একুশে ফেব্রম্নয়ারি।
মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে হবে
রকি আহমেদ
ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
\হ
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারি মাতৃভাষার জন্য সংগ্রাম করে বাংলার দামাল ছেলেরা। অকালে প্রাণ হারিয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং নাম-নাজানা আরো অনেকে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘ ঘোষণা করে অন্যান্য দিবসের মতো ২০০০ সাল থেকে বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে। ইউনেস্কো একুশে ফেব্রম্নয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়ে শুধু মাতৃভাষার জন্য আমাদের সংগ্রাম এবং আত্মদানকেই স্বীকৃতি দেয়নি, অমর একুশের শহীদদের আত্মদান থেকে উৎসারিত স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বাধীনতা অর্জনকেও মর্যাদা দিয়েছে।
আজ আমাদের ভাষা আর সংস্কৃতি দুটিই যেন অবহেলিত। এই প্রজন্মের কাছে যেন এই ভাষা অস্তিত্বহীন। তবে এই ভাষায় জন্যই কতশত অস্তিত্ব আর সহস্র প্রাণ বর্জনের মাধ্যমেই আজকেই এই অর্জিত ভাষা, আমাদের মায়ের ভাষা। ঠিক আমরাই আমাদের মায়ের ভাষাকে মর্যাদা দিতে পারি না। বাংলার মাঝে ইংরেজি শব্দ মিশ্রণ না ঘটাতে পারলেই নিজের আনমডার্ন ভেবেই বসি। মায়ের কথার যখন মর্যাদা থাকে না,তখন মা নিভৃতেই মরে যায়। তাই আসুন আমরা মায়ের ভাষায় কথা, এ ভাষার মর্যাদা দেই, সমস্বরে বলি শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দিব না, মায়ের ভাষা বাঁচিয়ে রাখি।
একুশে ফেব্রম্নয়ারি বাঙালির চেতনার উৎস
তোপাজ্জল হক মেহেদী
ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা কলেজ।
একুশে ফেব্রম্নয়ারি মানে হচ্ছে বাঙালির আবেগ, অনুভূতি ও চেতনার একটি নাম। যা আমাদের স্বাধীনভাবে মনের ভাব প্রকাশে অবদান রাখছে। বাঙালি জাতিসত্তার এক অনন্য পরিচায়ক বাংলা ভাষা। ইতিহাসের পাতায় রক্তকালিতে লেখা রয়েছে ভাষার প্রতি বাংলা মায়ের সন্তানদের আত্মত্যাগের গল্প। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারিতে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। এতে রফিক, জব্বার, শফিউর, সালাম, বরকতসহ অনেকেই শহীদ হন। রক্তাক্ত সেই ঐতিহাসিক দিনটিকে স্মরণ করে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'। একজন বাঙালি হিসেবে এই দিনটি সবার কাছে স্মরণীয়। '৫২-এর ভাষা আন্দোলন, বাঙালির আত্মত্যাগ চেতনা ও সাহস যুগিয়েছে একাত্তরে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা পেয়েছিলাম আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ। ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা প্রতিটি বাঙালির দায়িত্ব।