রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

শীতবস্ত্র নিয়ে শীতার্তদের পাশে

আবদুলস্নাহ আল মামুন
  ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শীতবস্ত্র নিয়ে শীতার্তদের পাশে

বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবারের শীতের তীব্রতা তুলনামূলক বেশি ছিল। বিশেষ করে জানুয়ারির মাঝের সময়টাতে শীত ছিল হাড় কাঁপানো। শীতের এই তীব্রতা দেখে বিগত বছরের মতো এবারও শীতবস্ত্র নিয়ে শীতার্ত মানুষদের পাশে থাকার উদ্যোগ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'জোনাকি'। এক সপ্তাহ ধরে টাকা তোলার পর পাবনা জেলার কয়েকটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে শীতবস্ত্র বিতরণের সিদ্ধান্ত হয়।

আমাদের তিন বন্ধু শরীফ, রেজোয়ান আর আমার দায়িত্ব পরে সাথিয়া উপজেলায় শীতবস্ত্র বিতরণের জন্য। পাবনা শহর থেকে ৩৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে সাথিয়া উপজেলার অবস্থান। কৃষির জন্য এই উপজেলার খ্যাতি আছে। দেশের গরুর দুধ উৎপাদনের অন্যতম হাব এই সাথিয়া। চারদিকে ফসলের মাঠ আর বিস্তীর্ণ জলাভূমি। এই জলাভূমি বর্ষার সময় হাওড়ের মতো রূপ ধারণ করে তখন এগুলো থেকে অনেক মাছ পাওয়া যায়।

দুপুর ৩টায় পাবনা বাস টার্মিনাল থেকে বাসে করে শীতবস্ত্র নিয়ে আমরা তিন বন্ধু রওনা হই। পঁয়তালিস্নশ মিনিট পাড়ি দেওয়ার পর আমরা সাথিয়ার ছন্দহ গ্রামে পোঁছাই। এই গ্রামেই বন্ধু শরীফের বাড়ি।

প্রথমে গ্রামের আলপথ দিয়ে হেঁটে এক বৃদ্ধ মহিলার বাড়িতে যাই। উনার স্বামী মারা গেছেন অনেক আগে, এখন একা একা শেষ জীবন কাটছে। আমাদের কম্বল হাতে পাওয়ার পর চোখের কোনে পানি জমে গেছে। হাত তুলে আমাদের জন্য দোয়া করেন। ওই পথ দিয়ে আমরা আরেক বৃদ্ধ মহিলার বাড়িতে যাই। কিন্তু উনি বাড়িতে নেই। শীতে একা একা বাড়িতে থাকতে পারেন না বলে মেয়ের বাড়িতে চলে গেছেন। এই শীতটা মেয়ের বাড়িতে কাটিয়ে দিবেন বলে পাশের ঘরের একজন বলল। আমরা উনার কম্বলটা পাশের ঘরে পৌঁছে দিয়ে বলেছি, উনার মেয়ের বাড়িতে যেন পৌঁছে দেওয়া হয়।

এভাবে সন্ধ্যার আগে দুই-তিনটা গ্রামের বৃদ্ধ পুরুষ এবং মহিলার কাছে কম্বল পৌঁছে দেই। কিন্তু আমাদের হাতে তখনো দুটি কম্বল ছিল। ওগুলো পৌঁছে দিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরতে হবে। সন্ধ্যা নামার পর বিল পাড়ি দিয়ে একটা বাড়িতে যেতে হলো। বিলে নামার পরই শোনা গেল শেয়াল ডাকার শব্দ। বন্ধু শরীফ বলল, শীতের কারণে শেয়ালের ডাক বেড়ে গেছে। গরমের সময় এমন শোনা যায় না। চারদিকে অন্ধকার। ভুতুড়ে ভুতুড়ে একটা পরিবেশ। লোকমুখে প্রচলিত আছে, ওই বিলে নাকি ভূত আছে। মিনিট-দশেক হাঁটার পর আমরা ওই বাড়িতে পৌঁছে যাই। নির্জন এক গ্রামে ওই বাড়ি। বিদু্যতের বাতিগুলো নিভু নিভু করে জ্বলছে। বাইরে একটা ঘোড়া বাঁধা আছে। বাড়িতে তিনটা ঘর। পঞ্চাশোর্ধ্ব একজন মহিলা বিদু্যতের লাল আলোতে শিম কাটছেন, রান্না করার জন্য। আমাদের দেখে প্রায় কেঁদেই দিলেন। বললেন, 'তোমরা আসছ, আমি অনেক খুশি হয়েছি। আমার ঘরবাড়ি কিছুই নেই, অন্যের বাড়িতে থেকে কোনো রকম জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি। দোয়া করি, তোমাদের জন্য।'

বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার সময় হয়ে গেছে, এশার নামাজের আজান পড়েছে চারদিকে। পথে শরীফের বাসায় ঢুকলাম। আমাদের জন্য রান্না আগেই করে রেখেছে। এ যেন অনেকদিন পর মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ। শরীফদের খেজুর গাছ আছে, গাছ থেকে শরীফের আব্বু তাজা তাজা খেজুরের রস এনে দিলেন, সঙ্গে বাসায় বানানো ভাপা পিঠা। গ্রামের এমন আতিথেয়তা সব সময় মনোমুগ্ধকর। হাতে থাকা একটি কম্বল বিতরণের দায়িত্ব শরীফের আম্মুকে দিয়ে আমরা ফেরার পথ ধরলাম।

শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে এক মুহূর্তের জন্য বের হয়ে অনেকগুলো অভিজ্ঞতা হয়েছে। গ্রামের মানুষের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলা, তাদের মুখে হাসি ফোটানো- এ দৃশ্য খুবই তৃপ্তিদায়ক। ছবির মতো সুন্দর গ্রামটি দেখে মনে হয়েছে, নিজেদের ব্যস্ততার পাশ কাটিয়ে আবার কবে গ্রামে ফিরতে পারব!

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে