মৎস্যবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের সিন্ধুযাত্রা
প্রকাশ | ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মোস্তাকিম সাদিক
প্রকৃতি বরাবরই মানুষকে তার দিকে টানে। মানব ও প্রকৃতির বন্ধন এক অদৃশ্য মায়ায় ঘেরা। প্রকৃতির সান্নিধ্যে গেলে এক পরম শান্তির পরশ অনুভূত হয়।
সবেমাত্র সেমিস্টার পরীক্ষার ক্লান্তি-গস্নানি শেষ হলো। আমাদের নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স বিভাগের কোর্স শিক্ষিকা জানালেন ফিল্ড টু্যরের আয়োজন করতে হবে। কক্সবাজার মেরিন রিসোর্স অনেক সমৃদ্ধ হওয়ায় কক্সবাজারকেই শিক্ষা সফরের নির্বাচিত জন্য করলাম। যেখানে স্বপ্নকে আকাশের গায় মিলিয়ে ধরতে পারা যায়, যেখানে দিগন্তকে ছোঁয়া যায় অতি সহজে, যেখানে পাখপাখালির শব্দ মুগ্ধ করে পর্যটকদের।
কি সুন্দর আবহাওয়া। বৃষ্টির পানিতে পুরো প্রকৃতি যেন গোসল করে নতুন সাজে সজ্জিত হয়েছে। সে সময়ই আমরা মৎস্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা গিয়েছিলাম সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। এটিই একমাত্র জায়গা, যেখানে একইসঙ্গে সমুদ্রের পাশে পাহাড়গুলো দাঁড়িয়ে আছে মূর্তমান। একদিকে নির্মল সমুদ্রের বাতাশ অপরদিকে সবুজের অরণ্য, সবদিকেই যেন সৌন্দর্যের লীলাভূমি। নির্মল সমুদ্রের বাতাশ অপরদিকে সবুজের অরণ্য, সবদিকেই যেন সৌন্দর্যের লীলাভূমি। গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাত ১১টায় নোবিপ্রবি ক্যাম্পাস থেকে যাত্রা শুরু করলাম আমরা কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। সফরসঙ্গী হয়েছেন আমাদের দুইজন শিক্ষকও। যাত্রাপথে বাসে আমাদের অনেক আনন্দে সময় কেটেছে। সবার মধ্যে অনেক বেশি উদ্দীপনা কাজ করছিল। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের সোনালী আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে আর রাস্তার দুই পাশে সবুজ পাতার ওপর সূর্যের কিরণ প্রতিফলিত হয়ে যেন আমাদের কাছে আসছে। ভোরের আলোতে সবকিছু প্রাণবন্ত লাগছিল। কক্সবাজার শহরে প্রবেশের মুহূর্তটি ছিল সবচেয়ে দারুণ। প্রবেশের রাস্তা ঢালু হওয়ায় বাস থেকে সমুদ্রের প্রথম দেখা পেয়ে গেলাম তখনই, সবাই মাথা উঁচিয়ে একটু দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ল। আমিও দেখলাম এক নজরে, মনে হচ্ছে যেন এখনই বাসটি আমাদের নিয়ে নীল জলরাশিতে হারিয়ে যাবে। এরপর হোটেলের সামনে গিয়ে আমাদের বাসটি থামল এবং আমরাও বিশ্রামের জন্য নির্ধারিত কক্ষে প্রবেশ করলাম। সফরের প্রথম দিন দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই খুব দ্রম্নতই তৈরি হয়ে গেলাম নির্ধারিত স্থানে যাওয়ার জন্য। স্পটের মধ্যে ছিল হিমছড়ি, মিনি বান্দরবান, ইনানী ও রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড। প্রথমে আমরা আমাদের গাড়ি নিয়ে মেরিন ড্রাইভ ধরে মিনি বান্দরবান যাব। যাওয়ার পথে মেরিন ড্রাইভ সড়কের সৌন্দর্য ছিল অসাধারণ। একদিকে নীল জলরাশির বড় বড় ঢেউগুলো আঁচড়ে পড়ছে তীরে, অপরদিকে পাহাড়গুলো হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এর মাঝখান দিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখলাম প্যারাসেইলিং পয়েন্ট, যেখান থেকে পাখির মতো উড়ে উড়ে উপভোগ করা যায় সাগর ও পাহাড়কে। চলতিপথে রাস্তার ধারে অনেকে ডাব ও অন্যান্য পানীয় এর পসরা সাজিয়ে বসেছে। মিনি বান্দরবানের একটু আগেই বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের অবস্থান। তাই এক নজরে দেখেও নিলাম এই প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির পর এই প্রতিষ্ঠান আমাদের সমুদ্র অঞ্চল নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে আমরা এর মাধ্যমে আমাদের সমুদ্রতলের খনিজসম্পদ সম্পর্কে অনেক বেশি তথ্য পাব আশা করি, যা আমাদের দেশকে অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করবে। এরপর মিনি বান্দরবানে আমাদের যাত্রা শুরু। মূল সড়ক থেকে পূবের দিকে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এই সড়কটি চলে গিয়েছে। মূলত বান্দরবানে যে রকম পাহাড়ের মাঝখানে আঁকাবাঁকা পথ, তেমনি এখানেও এমনটি হওয়ার কারণে এর নাম দেওয়া হয়েছে মিনি বান্দরবান। এই জায়গায় পাহাড়ের চূড়া থেকে সমুদ্র ও সমতল দুটিই দেখা যায় পরিপূর্ণভাবে। আমরা সবাই ও পাহাড়ের ওপর থেকে সমুদ্র দেখব বলে উঠে গেলাম চূড়ায় আর কিছুক্ষণ অবস্থান করে প্রশান্তির শ্বাস নিলাম আর সবাই মিলে ছবিও তুললাম।
সূর্যের কিরণ মাথার ওপর থেকে ধীরে ধীরে পশ্চিমে হেলে পড়ছে। পাহাড় থেকে নেমে এবারের যাত্রা ইনানীর পথে। ইনানীতে পৌঁছে আমরা খুব দ্রম্নতই সৈকতে নেমে পড়লাম। ধু ধু বালুচর চারদিকে, সামনে এগোতেই হাতছানি দিচ্ছে দিগন্তজোড়া নীল জলরাশি। মাছ ধরার নৌকাগুলো দুলতে দুলতে তার গন্তব্যে ছুটছে। বালির ওপর লাল কাঁকড়ার দল আমাদের উপস্থিতি ঠের পেতেই তাদের গর্তে লুকিয়ে বাঁচল। তাদের মতে, এই দুই পা-ওয়ালারা আমাদের এলাকায় কি করছে? যাক তাদের বিরক্ত না করেই নেমে পড়লাম সমুদ্রে। সাগরের উর্মিমালা এসে আমাকে তার স্বাদ গ্রহণ করল। এভাবে খানিকটা লোনা পানিতে থাকার পর সবাই মিলে ছবি তুললাম আবার ব্যক্তিগত ছবিও তুললাম। সেখানে অনেকগুলো ঘোড়া ছিল, যেগুলো ভাড়া দিয়ে চড়া যায়। জীবনে প্রথমবার ঘোড়ার পিঠে উঠলাম। খুব বেগ পেতে হয়েছে অবশ্য প্রথম বলে। চড়তে চড়তে নিজেকে যেন হারিয়ে ফেললাম সেই
প্রাচীন যুগে যখন ঘোড়া ছাড়া কোনো মাধ্যম ছিল না যোগাযোগের অথচ আজ যোগাযোগ ব্যবস্থা কতই না উন্নত। সুপারসনিক বিমানের দ্বারপ্রান্তে আমরা দাঁড়িয়ে, অদূর ভবিষ্যতে হয়ত এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে মানুষ পৌঁছে যাবে অনায়াসেই। ঘোড়ায় চড়ার পর আরও কিছুটা সময় কাঠিয়েছি, এর মধ্যেই সূর্য ডবু ডুবু অবস্থা। মনে হচ্ছে, ধীরে ধীরে পানির নিচে ডুবে যাচ্ছে। গোধুলির এই সময়টা কার না প্রিয়, সৈকতের পাড়ে বসে এমন দৃশ্য দেখা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। এরপর আমরা চলে এলাম গাড়িতে ফিরে আসার জন্য। সময় স্বল্পতার কারণে দিনের বেলায় হিমছড়িতে সময় কাটানে হয়নি। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম কিছুটা সময় সমুদ্রের নির্মল বাতাস গ্রহণ করব হিমছড়িতে অবস্থান করে। হিমছড়িতে অবস্থানের পর রওনা দিলাম শহরের উদ্দেশে। এবারের গন্তব্য রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড।
রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড মূলত একটি বড় আকারের দ্বিতল অ্যাকুরিয়াম, যেখানে মিঠাপানির ও সামুদ্রিক হরেক রকম প্রাণীর সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। হিংস্র হাঙর থেকে শুরু করে ছোট ছোট লার্ভাও দেখা পাওয়া যায় এখানে। ফিশারিজ বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা এখানে আসতে পেরে সত্যিই আনন্দিত। এখানে আমরা সামুদ্রিক কোরাল, শাপলা পাতা, কচ্ছপ, শামুকসহ শত শত এ্যানিমল দেখেছি। হাঙর দেখার জন্য আমরা সবাই উৎসুক ছিলাম, অন্যান্য দর্শনার্থীরাও খুবই মনোমুগ্ধভাবে উপভোগ করছিল। এটি দেখার মাধ্যমে আমাদের প্রথম দিনের কার্যসূচি শেষ হলো এবং সবাই রাতের খাবার শেষ করে বিশ্রামের জন্য হোটেলে চলে এলাম।
দ্বিতীয় দিনের নির্ধারিত স্থান ছিল রামুতে অবস্থিত রাবার বাগান ও রাং কুট বৌদ্ধবিহার। এ ছাড়াও ছিল, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট পরিদর্শন করা। পাহাড়ের গায়ে সারি সারি রাবার গাছ। খুব সকাল সকাল যাওয়ায় কর্মচারীদের রাবার সংগ্রহের পদ্ধতিও দেখলাম। এই রাবারের তৈরি কত জিনিসই না আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছি। বর্তমান বিশ্বে এর আলাদা কদরও রয়েছে। এই রাবার বিক্রি করে আমরা অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি তবে, অবশ্য এই খাতকে প্রসারিত করতে হবে। বন্ধুরা সবাই মিলে ছবি তুলে বিদায় নিলাম এখান থেকে।
রাবার বাগানের পর আমাদের গন্তব্য এবার রাং কুট বৌদ্ধবিহার। এই বিহারের ইতিহাস ও অনেক পুরনো। মৌর্যবংশের তৃতীয় সম্রাট অশোক এটি স্থাপন করেন। আশপাশের অন্যান্য বিহার থাকলেও বৌদ্ধদের কাছে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে সম্রাট অশোকের মূর্তি, চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙয়ের মূর্তি, প্রতীকী সারনাথ (বুদ্ধের প্রথম ধর্মপ্রচার দৃশ্য) সহ আরও অনেক মূর্তি রয়েছে। এখানে একটি ঝুলন্ত ব্রিজও দেখতে পাওয়া যায়।
বৌদ্ধবিহার দেখা শেষে চলে আসি কক্সবাজার শহরে। দুপুরের খাবার ও ফ্রেশ হয়ে আমাদের স্টাডি টু্যরের বিষয় হিসেবে পরিদর্শনে যায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটে। সেখানের এক কর্মকর্তা আমাদের তাদের কাজ সম্পর্কে বর্ণনা দেন এবং কৃত্রিমভাবে সামুদ্রিক লেটুসের (সি উইড) চাষ পদ্ধতি শেখালেন। পরে তা আমাদের খাওয়ার জন্য বললে আমরাও স্বাদ নিয়ে দেখি। নোনতাওয়ালা এই লেটুস খুবই এন্টিঅক্সিডেন্ট-সমৃদ্ধ। বর্তমানে এর গবেষণা অনেক প্রতিষ্ঠান করছে।
এটি পরিদর্শনের পর বিকাল বেলা আমরা সবাই মিলে সৈকতে ফুটবল খেলতে বেরিয়ে পড়লাম। আকাশে কালো মেঘ, এই বুঝি বৃষ্টি নামবে। ঠান্ডা হাওয়া এসে মনটাকে হাল্কা করে দিল। দুই দলে ভাগ হয়ে শুরু হলো আমাদের খেলা। চারদিকের হাওয়ায় দৌড়ালে আরও বেশি গায়ে লাগছে। ফুটবল খেলা শেষে সবাই সমুদ্রের পানিতে গোসল করতে নেমে পড়ি। সবাই পানির মধ্যে অনেক হৈ-হুলেস্নাড় করে একে অপরের সঙ্গে মজা করেছি, কেউ একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিচ্ছে, কেউ বা বল নিয়ে পানিতে ভলিবল খেলছে।
এরপর হোটেলে ফিরে সবাই ফ্রেশ হয়ে ডিনার করতে চলে যায়। ডিনারটি আমাদের এক শিক্ষক স্পন্সর করেন। ডিনার শেষে কাঁকড়া খাব উদ্দেশে শালিক রেস্টুরেন্টে যাই। কাঁকড়া ফ্রাই খেয়ে সবাই মিলে এরপর বেরিয়ে পড়ি ব্যক্তিগত কেনা কাটার জন্য। সৈকতে অনেক ধরনের দোকান ও মার্কেট রয়েছে, যেখানে নানান জিনিস কিনতে পাওয়া যায়। শামুকের তৈরি নানান কারুকার্যময় জিনিসপত্র থেকে শুরু করে হরেক রকমের আচার। আমার বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই তাদের পরিবারের জন্য বিভিন্ন কিছু কিনছে, আমিও আমার তিন ভাগ্নে ও বোনের জন্য ব্রেসলেট কিনলাম। ব্রেসলেট কিনার সময় স্বয়ং আমাদের শিক্ষিকা নিজেই পছন্দ করে দিয়েছেন। সত্যি একটি টু্যরের মাধ্যমে অনেক কিছু শেখাও যায় আনার অমন অনেক স্মৃতি মনের কোঠরে হয়ত রয়ে যাবে। কেনাকাটা শেষে রাত্রিবেলা সবাই মিলে শেষবারের মতো সমুদ্রের গর্জন শুনতে আবারও হাজির হলাম। বিশাল বিশাল ঢেউগুলো ফেনা তুলে আঁচড়ে পড়ছে তীরে। এভাবে খানিকটা সময় সমুদ্রের গর্জন শুনে আমরা গাড়িতে উঠার জন্য চলে আসি। নির্ধারিত সময় আমাদের বাস কক্সবাজার ত্যাগ করে।
এই টু্যর থেকে আমরা অনেক কিছু দেখেছি ও শিখেছি। আমার স্মৃতির কোঠরে এই দিনগুলো স্বর্ণাক্ষর দিয়ে লিখিত থাকবে। কক্সবাজারের সৌন্দর্যের বিশালত্ব বলে শেষ করা যাবে না। আমার এক বন্ধু ইফতেখার আসিফ বলে, 'কক্সবাজার আগেও এসেছি অনেকবার, কিন্তু এমন আনন্দঘন টু্যর হয়নি। আমরা প্রত্যেকেই খুব উপভোগ করেছি এই দুই দিন। সামনে আরও অনেকবার যাওয়া হবে হয়ত, কিন্তু এই আনন্দ তখন থাকবে না।'
এটিই ছিল আমাদের শিক্ষা সফরের গল্প। আমাদের স্মৃতির জাদুঘরের এক অধ্যায়।