দেড় যুগে যবিপ্রবি : সংকটের চেয়ে প্রাপ্তি বেশি
সময়ের পরিক্রমায় যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) এখন দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাতারে। বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেনের দক্ষ নেতৃত্বে প্রাণবন্ত শিক্ষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে সব ব্যঙ্গাত্মকে কালের ডাস্টবিনে ফেলে শিক্ষা ও গবেষণায় এখন দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য রোল মডেল যবিপ্রবি। ২০০৭ সালে ২৫ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু হয়ে আজ দেড় যুগে প্রবেশ করেছে যবিপ্রবি
প্রকাশ | ২০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেখ সাদী, যবিপ্রবি
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে স্থানীয়দের কাছে আমবটতলা কলেজ নামে পরিচিত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও পরিবেশের দরুন যশোর জেলার বেশিরভাগ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীও ব্যঙ্গাত্মক সুরে আমবটতলা কলেজ বলত। দেশের মানুষও তেমন চিনত না বিশ্ববিদ্যালয়টিকে। তবে সময়ের পরিক্রমায় যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) এখন দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাতারে। বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেনের দক্ষ নেতৃত্বে প্রাণবন্ত শিক্ষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে সব ব্যঙ্গাত্মকে কালের ডাস্টবিনে ফেলে শিক্ষা ও গবেষণায় এখন দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য রোল মডেল যবিপ্রবি। ২০০৭ সালে ২৫ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু হয়ে আজ দেড় যুগে প্রবেশ করেছে যবিপ্রবি।
গবেষণা ও উদ্ভাবন : যবিপ্রবির জিনোম সেন্টারে শুধু কোভিড-১৯ পরীক্ষা নয় করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ধরনের আরেক সাব-ভ্যারিয়েন্ট ২২উ : ঙসরপৎড়হ/ইঅ.২.৭৫ শনাক্ত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক কম খরচে করোনাভাইরাস শনাক্তে 'সাইবারগ্রিন পদ্ধতি' উদ্ভাবন করেছিলেন। বিজ্ঞান ও গবেষণায় অনন্য অবদানের জন্য ২০২২ সালে যবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেনকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত এলসেভিয়ার র?্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যবিপ্রবি প্রথম অবস্থান অর্জন করে। এ বছরের শুরুতে প্রকাশিত এডি সায়েন্টিফিক ইনডেক্সে যবিপ্রবির প্রায় ৫৪ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী স্থান পান। এছাড়াও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উৎসাহ ও সহযোগিতায় কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সেল ও ড. এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স স্টাডিজ। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেল কালচার ও গ্রিনহাউজের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। স্কোপাস ডাটাবেইজ অনুযায়ী ২০২৩ সালে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশে দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অষ্টম ও সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১২তম অবস্থানে ছিল যবিপ্রবি। ২০২৩ সালে মোট ৪৩০টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় : ১০তলা মুনশি মেহেরুলস্নাহ ছাত্র হল ও বীর প্রতীক তারামন বিবি ছাত্রী হলের উদ্বোধনের মাধ্যমে এ বছরই সম্পূর্ণ আবাসিক হতে যাচ্ছে যবিপ্রবি। শিক্ষার্থীদের সম্পূর্ণ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করবে হলগুলো। এ হলগুলো উদ্বোধন হলে শিক্ষার্থীরা তাদের একাডেমিক কার্যক্রম ও গবেষণায় অধিক ভূমিকা রাখবে ও দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায়ও শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হবে না বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
ক্রীড়াঙ্গনে যবিপ্রবি : গবেষণা ও শিক্ষায় যেমন নেতৃত্ব দিচ্ছে যবিপ্রবি তেমনি ক্রীড়াঙ্গনেও কোনো কমতি নেই এই ৩৫ একরের বিশ্ববিদ্যালয়টির। ২০১৯ সালে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ১৪তম বারের মতো দেশের দ্রম্নততম মানবী শিরীন আক্তার যবিপ্রবির শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান (পিইএসএস) বিভাগের শিক্ষার্থী। পিইএসএস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জহির রায়হান টোকিও অলিম্পিক ২০২০ এ বাংলাদেশের হয়ে চারশ' মিটার স্প্রিন্টে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। ২০২২ সালের জাতীয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় ত্রিপল জাম্পে ১২.০২ মিটারের রেকর্ড ভেঙে ১২.৩৮ মিটারের জাতীয় রেকর্ড গড়েন যবিপ্রবির সোনিয়া আক্তার। জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রশিক্ষণ ক্যাম্প-২০২৩ এর কোচ হিসেবে মনোনীত হয়েছেন যবিপ্রবি শরীরচর্চা শিক্ষা দপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুলস্নাহ হেল কাফি। জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় যবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের দারুণ পারফরম্যান্সে যবিপ্রবি এখন আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজকও বটে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী ও অসামান্য অবদান রাখেন যবিপ্রবি শিক্ষার্থী উজ্জ্বল সূত্রধর, জাতীয় মহিলা দলের ফুটবলার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী নিলুফার ইয়াসমিন নীলা, আশরাফুজ্জামান রচি, বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন যবিপ্রবির দুই শিক্ষার্থী মিতু আক্তার এবং মো. তারেক হাসান।
হ্যাচারি ও মিউজিয়াম : গবেষণার পাশাপাশি দেশে উন্নতমানের মাছের পোনা সরবরাহ করছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম হ্যাচারি যবিপ্রবির 'হ্যাচারি অ্যান্ড ওয়েট ল্যাব'। দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ মৎস্য সংরক্ষণশালা যবিপ্রবির ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন বায়োসায়েন্স (এফএমবি) বিভাগের 'অ্যাকুয়াটিক বায়োডায়ভার্সিটি মিউজিয়াম'। এতে সংরক্ষিত আছে প্রায় ৪৭৫ প্রজাতির স্বাদু ও সামুদ্রিক প্রাণী।
ভেটেরিনারি অনুষদ : ঝিনাইদহ ভেটেরিনারি কলেজ যবিপ্রবিতে ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদ হিসেবে যুক্ত হয়েছে। জরাজীর্ণ কলেজটিকে নতুনমাত্রা ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে যবিপ্রবি কর্তৃপক্ষ সুনজর দিয়েছেন। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অনুষদটিতে শৃঙ্খলা ফেরাতে সব রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
নতুন তিন বিভাগ ও ইনস্টিটিউট : চলতি বছরে বায়োকেমিস্টি অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজি, ফলিত পরিসংখ্যান ও হিউমিনিটিস (নন ডিগ্রি) নামে তিনটি বিভাগ চালু করবে যবিপ্রবি।
বিশ্ব র?্যাংকিংয়ে যবিপ্রবি : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক বিশ্বের প্রথম সারির চিকিৎসা ও বিজ্ঞান বিষয়ক নিবন্ধ প্রকাশনা সংস্থা 'এলসেভিয়ার'-এর সমন্বিত জরিপে বিশ্বসেরা ২% গবেষকের তালিকায় স্থান পেয়েছে যবিপ্রবির তিনজন শিক্ষক। টাইমস হায়ার এডুকেশনের এসডিজি র?্যাংকিং-এ যবিপ্রবির অবস্থান ছিল সারা বিশ্বের ৮০০-১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে। এছাড়াও বিগত বছরগুলোতে এলসেভিয়ার র?্যাংকিংয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালগুলোর মধ্যে গবেষণায় ১ম দিকের সারিতে অবস্থান করছে।
গবেষণাগার : বিগত কয়েক বছরে যবিপ্রবিতে কয়েকটি বিশ্বমানের গবেষণাগার তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো : জিনোম সেন্টার, নেইম ল্যাব, সিএসআরএল ল্যাব, হ্যাচারি অ্যান্ড ওয়েট ল্যাব, এনিমেল হাউস, আইপিই বিভাগের ওয়ার্কশপ, কন্ডিশনিং ল্যাব ইত্যাদি।
সেশনজট ও র?্যাগিংমুক্ত ক্যাম্পাস : বিশ্ববিদ্যালয়টির যাত্রার শুরুতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় সেশনজট ও র?্যাগিংয়ে শিক্ষার পরিবেশ ছিল অত্যন্ত নাজুক। স্থানীয় ও অপরাজনীতির প্রভাব অনেকটা কাটিয়ে একটি স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে কর্তৃপক্ষ। যার দরুন গত সাত বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্পূর্ণ সেশনজট মুক্ত। র?্যাগিং ও বিভিন্ন অপরাধ বিষয়ে প্রশাসনের জিরো টলারেন্স নীতির প্রয়োগের ফলে যবিপ্রবি এখন দেশের র?্যাগিংমুক্ত অন্যতম ক্যাম্পাস যবিপ্রবি।
আইএসও সনদপ্রাপ্ত ল্যাব : কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের নেইম ল্যাব, সেন্টার ফর সফিস্টিকেটেড ইনস্ট্রুমন্টেশন অ্যান্ড রিসার্চ ল্যাবরেটরি (সিএসআইআরএল) ও জিনোম সেন্টারকে আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রকারী প্রতিষ্ঠান আইএসও-এর সনদ হস্তান্তর করেছে।
গবেষণায় অনুদান প্রাপ্তি : যবিপ্রবির ২৮ জন শিক্ষক বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পে সাড়ে ৪৪ লাখ টাকা অনুদান পায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, সফটওয়্যার প্রকৌশল এবং তথ্যপ্রযুক্তি ডিগ্রি প্রোগ্রামগুলোকে আপগ্রেড করতে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) দেশের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ঋণ অনুমোদন দিয়েছে গত বছর। তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে যবিপ্রবি।
নাগরিক সেবায় যবিপ্রবি : যবিপ্রবির গবেষণাগারে বাংলাদেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল দিয়ে আমদানিকৃত পণ্যের গুণাগুণ নির্ণয় করা হয়। যবিপ্রবিতে ২০২০ সালে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হলে বৃহত্তর যশোর, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও বাগেরহাটের লক্ষাধিক নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে প্রতিবছর আগস্টে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের মাধ্যমে কয়েক হাজার মানুষকে সেবা প্রদান করে আসছে যবিপ্রবি। সাধারণ মাছ চাষিদের উন্নত মানের সরবরাহ করে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের 'হ্যাচারি অ্যান্ড ওয়েট ল্যাব'।
শিক্ষার্থীদের দাবি : বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট্ট আয়তন নিয়ে বেশ অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছেন যবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তন বৃদ্ধি করা, শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষকদের পাঠ মূল্যায়ন করা, কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ার সুন্দর পরিবেশ ও কম দামে খাবার মান উন্নতি করা, হলগুলোর ডাইনিংয়ে নিম্নমূল্যে খাবার প্রদান ও যথাযথ পুষ্টিগুণ বজায় রাখতে হবে, সেমিস্টার ফি ও হলের আবাসিক ফি কমিয়ে আনা, গবেষণায় শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করতে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া, ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের বসার জন্য জায়গা তৈরি করা, পরিবহণ সংকট দূর করা, চব্বিশ ঘণ্টা জরুরি চিকিৎসা সেবা চালু করা, ক্যাম্পাস থেকে আমবটতলা ও বেলতলা পর্যন্ত ফুটপাত করা প্রভৃতি।