খেজুর রসের খোঁজে...
প্রকাশ | ২০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ
চলছে শীতকাল। আর এই শীতের সকালে খেজুরের রস ছাড়া যেন জমেই না। শীতের সকাল আর খেজুরের রস যেনো একে অপরের পরিপূরক। কোনো একদিন ভোরে সেই রস খাওয়ার ইচ্ছা ছিল অনেকদিনের। সেই ইচ্ছাটা আরও তীব্র হতে থাকে শীতকালীন ও নির্বাচনের লম্বা ছুটিতে বাড়ি আসায়। ঢাকায় থাকাকালীন চিন্তাভাবনা থাকলেও বাড়িতে আসার পর সবকিছুই যেনো হুটহাট ঠিক হয়ে যায়।
ছুটিতে গ্রামের বাড়ি নরসিংদী আসার পর বেশ কয়েকটি স্থানে ঘুরার মাঝে খেজুরের রস খাওয়ার পরিকল্পনা হয়। আমি, আমার বন্ধু সাখাওয়াত ও ছোট ভাই অপি এই তিনজন মিলে সবকিছু ঠিকঠাক করলাম। সে অনুযায়ী, আমরা বৃহস্পতিবার সবাই সাখাওয়াতের বাড়িতে ঘুরতে গেলাম। আমাদের সঙ্গে যুক্ত আমার আরেক বন্ধু সাইফুল। সেদিন বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরাঘুরির পর মোটামুটি ঠিক হয়ে গেল যে আমরা পরদিন সকালেই খেজুরের রস খেতে যাচ্ছি। রাতে খাবারের পর থেকেই কীভাবে কি করব, না হবে, সবকিছু ফাইনাল করা হয়। মূলত আমাদের বড় ভাই মোবারক ভাই খেজুরের রস খাওয়াতে নিয়ে যাবেন। স্থানও মোটামুটি ফাইনাল হয়ে যায় রাতেই। সমস্যা হয়ে যায় এত সকালে আমরা যাব কীভাবে। পরে আমরা দুটি মোটর সাইকেলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। বলা বাহুল্য, আমরা সবাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী।
শুক্রবার সকালে ফজরের নামাজের পর আমরা মোটর সাইকেলে করে রওনা দেই। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে প্রচন্ড শীত উপেক্ষা করে আমরা গন্তব্য স্থলে যাওয়া শুরু করি। পথে কুয়াশার জন্য মোটর সাইকেলের হেড লাইটেও কিছু দেখা যাচ্ছিল না। তো ধীরে ধীরে আমরা মনোহরদী পৌঁছাই। সেখানে আমরা মোবারক ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করি। তিনি তার এক ছোট ভাইকে নিয়ে আমাদের নিয়ে নির্ধারিত গন্তব্যস্থলের দিকে আবারও রওনা হন। পথিমধ্যে ভাইয়ের আরও কয়েকজন বন্ধু মোটর সাইকেলে করে এসে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হন। প্রায় ঘন্টাখানেক পর আমরা আমাদের গন্তব্যস্থল গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার আমরাইদ বাজারের পাশের একটি খেজুরের রস বিক্রেতার গাছের নিচে পৌঁছাই। আমরা যাব, তা আগে থেকেই উনাকে জানিয়ে রাখায় তিনি সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
শীত শুরুর সঙ্গে সঙ্গে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। মূলত খেজুর গাছ কেটে পরিষ্কার করে রস সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। আমরা যার কাছ থেকে খেজুরের রস খেতে গিয়েছিলাম, তার অনেকগুলো গাছ। তিনি প্রতিদিন বিকালে নলি, কোমরবন্ধ রশি সঙ্গে নিয়ে খেজুর গাছের সাদা অংশ পরিষ্কার করে রসের জন্য ছোট-বড় কলসি ও মাটির হাড়ি বেঁধে রাখেন। মাটির কলসিতে সারারাত রস জমে। ভোরের আলো বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাছ থেকে মাটির হাড়ি নামিয়ে খেজুরের রস সংগ্রহ করেন। আমাদের সামনেই তিনি গাছ থেকে খেজুর রসের হাড়ি পেড়ে তা আমাদের ছেকে দেন।
শীতের সকালে গাছ থেকে নামানো কাঁচা রসের স্বাদ বর্ণনায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সেখানে যেয়ে অনেকেই রস খাওয়া শুরু করে দেয়, আবার কেউ কেউ আমার মতো রসের হাড়ি নিয়ে কিংবা খেজুর গাছে সঙ্গে ছবি তোলা শুরু করে দেয়। যাই হোক, পরে আমরা সবাই খেজুরের রস খাই। রস খাওয়ার পর আমরা সবাই মিলে ছবি তুলি। খেজুরের রস বিক্রেতাও অনেক মজার মানুষ ছিলেন। তিনি আমাদের সঙ্গে একটি ফানি ভিডিও করেন, সেটি পরে আবার তার ফেসবুক পেইজে আপলোডও করেন তিনি। সেখানে তিনি বলেছিলেন 'আমারে ফলো দিলে কি আপনাদের কোনো কষ্ট হইবো, আমারে একটা ফলো দিয়েন'। যাই হোক, তার অনেক জায়গায় খেজুরের রসের অর্ডার থাকায় আমাদের মাত্র ৯ লিটার রস খেতে দিতে পেরেছিলেন। আসার সময় তাকে অনেক অনুরোধ করে বোতলে করে কয়েক লিটার রস নিয়ে আসি। খেজুরের রসের স্বাদ সবাই উপভোগ করলেও অনেকেরই মেলেনি তৃপ্তি। মূলত আমরা মোবারক ভাই ও তার বন্ধুদের আতিথিয়েতায় মুগ্ধ। তারা না থাকলে হয়ত আমরা এমন বিশুদ্ধ খেজুরের রস খেতে পারতাম না। পরে আমরা তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করি এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। খেজুরের রস খাওয়া শেষে আমরা সবাই মনোহরদী এসে হালকা নাস্তা করি। পরে তাদের থেকে বিদায় নিয়ে মোটর সাইকেলে করে যে যার বাড়িতে চলে যাই। সেদিন সকালটি সত্যিই স্মৃতি পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে।