শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভাতেই মিলবে দরকারি পুষ্টি উপাদান জিঙ্ক

নতুনধারা
  ০৫ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

আবুল বাশার মিরাজ, বাকৃবি

কী, শিরোনাম পড়ে অবাক হচ্ছেন তো! অবাক হওয়ার কিছুই নেই। দেশের কৃষি বিজ্ঞানীর কল্যাণে এটি এখন সত্যি হয়ে গেছে। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। দেশের বাজারে খোঁজ করলেই পাবেন এমন ভিটামিন যুক্ত চাল। আর সে চাল সিদ্ধ করেই পেতে পারেন জিঙ্ক ভিটামিন।

কৃষি বিজ্ঞানীরা বলেছেন, জিঙ্ক সাধারণত সামুদ্রিক মাছ, মাংস, কলিজা ও ফলমূলে বেশিরভাগ পাওয়া যায়- যার বেশিরভাগই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রতিদিন গ্রহণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রতিদিন ঘাটতি থেকে যায় প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। মানবদেহে জিঙ্ক প্রায় ৩৬০ ধরনের হরমোনকে তাদের কার্যকারিতা সম্পন্ন করতে সহায়তা করে। জিঙ্কের ঘাটতির কারণে অসম্পূর্ণ থেকে যায় আমাদের বিপাকীয় কার্যক্রম- তথা বৃদ্ধি ও বিকাশ। আর এসব কারণেই বাংলাদেশের উচ্চ ফলনশীল ধানের সঙ্গে পরাগায়ন ঘটিয়ে জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাতগুলো উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ ধান থেকে কৃষকরা নিজেরাই বীজ তৈরি করে রোপণ করতে পারবেন।

কৃষি বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রোপা আমন মৌসুমের জন্য দুটি জিঙ্কসমৃদ্ধ জাত ব্রি ধান৬২ এবং ব্রি ধান৭২ (স্বল্প জীবনকাল) উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। ব্রি ধান৬২ এর প্রতি কেজি চালে প্রায় ২০ মিলিগ্রাম জিঙ্ক রয়েছে। হেক্টর প্রতি এর ফলন ৪ থেকে সাড়ে ৪ টন। বছরের অন্যান্য মৌসুমেও এ ধানের আবাদ করা যায়। ব্রি ধান৭২-এর প্রতি কেজি চালে জিঙ্ক রয়েছে ২২ দশমিক ৮ মিলিগ্রাম। হেক্টরপ্রতি ফলন ৫ দশমিক ৭ থেকে ৭ দশমিক ৫ টন। এ ধান চাষাবাদে প্রচলিত জাতের চেয়ে কম পরিমাণে ইউরিয়া সার লাগে। এদিকে বোরো মৌসুমের জন্য ব্রি ধান৬৪ উদ্ভাবন করা হয়েছে, যার প্রতি কেজিতে ২৫ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম জিঙ্ক রয়েছে। হেক্টর প্রতি এর ফলন ৭ টন। উচ্চ ফলনশীল বোরো ধানের মতো। ব্রি ধান৭৪-এর প্রতি কেজি চালে জিঙ্ক রয়েছে ২৪ দশমিক ২ মিলিগ্রাম। হেক্টরপ্রতি ফলন ৮ টনেরও বেশি। এ জাতটি মধ্যম মানের বস্নাস্ট রোগ প্রতিরোধী। ব্রি ধান২৮-এর বিকল্প হিসেবে সম্প্রতি উদ্ভাবন করা হয়েছে ব্রি ধান৮৪, এটিও জিঙ্কসমৃদ্ধ।

বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মীর্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবন করেছে বিনাধান২০। এর চালের রঙ লালচে ও বাদামি। প্রতি কেজি চালে ২৬ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম জিঙ্ক রয়েছে। এ জাতটি চাষাবাদ উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদের মতোই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একটি হাইব্রিড জাতের জিঙ্ক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। বিইউ হাইব্রিড ধান১ নামে এই জাতে মানবদেহের জন্য অতি প্রয়োজনীয় আয়রন ও জিঙ্ক রয়েছে। এটি সুগন্ধি গুণসম্পন্ন। প্রতি কেজি চালে ২২ মিলিগ্রাম জিঙ্ক রয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কর্মশালায় বেসরকারি সংস্থা হারভেস্টপস্নাস বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার ড. মো. খায়রুল বাশার বলেন, বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এ পর্যন্ত ১৬টি বায়োফরটিফাইড ক্রপ জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর মধ্যে জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত ৮টি। যা দেশের মানুষের জিঙ্কের চাহিদা পূরণ করবে। কিভাবে সেগুলো বাজারজাত করা যায়, সে লক্ষ্যে তার প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রথম কৃষক-পর্যায়ে জিঙ্ক ধানের বিতরণ শুরু করে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং এনজিওদের মাধ্যমে বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ উপজেলায় বীজ বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছে। ধান ছাড়া বায়োফর্টিফাইড ফসলের অন্যান্য জাতগুলো কৃষকপর্যায়ে খুব সহজলভ্য না হলেও আগ্রহী উৎপাদনকারীরা গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে বীজ সংগ্রহ করতে পারেন। বর্তমানে বিএডিসি কিছু পরিমাণে বীজ উৎপাদন শুরু করেছে এবং মেহেরপুর, যশোর, বগুড়া, মানিকগঞ্জ এবং রাজশাহী এলাকায় কিছু বীজ উৎপাদনকারী প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার জিঙ্ক ধান বীজ উৎপাদন করে যাচ্ছে।

গবেষণায় উঠে এসেছে দেশে পাঁচ বছরের নিচে এমন বয়সী ৪৪ শতাংশ শিশু জিঙ্ক স্বল্পতায় ভুগছে। আবার বিভিন্ন বয়সী ৫৭ শতাংশ নারীর রয়েছে জিঙ্কস্বল্পতা। ১৫ থেকে ১৯ বছরের শতকরা ৪৪ ভাগ মেয়ে জিঙ্কের অভাবে খাটো হয়ে যাচ্ছে। এর সমাধান খুঁজতেই ভাতের মাধ্যমে জিঙ্কের অভাব দূর করতে জিঙ্কসমৃদ্ধ ধান উদ্ভাবন করেছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, অধিক পরিমাণে জিঙ্ক থাকা সত্ত্বেও এই ভাতের স্বাদ ও রঙয়ের কোনো তারতম্য হয় না।

পুষ্টি গবেষকদের মতে, জিঙ্কের ঘাটতির কারণে শিশুর শরীরের কলা গঠন ব্যাহত হয়, বাড়বাড়তি কমে যায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, খাদ্য গ্রহণে অরুচি, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়াসহ শিশুর নানাবিধ রোগ দেখা দেয়, স্মৃতিশক্তি কমে যায় ও কম মেধাবী হয়। নারীদের সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা হারানো, কম ওজনের সন্তান জন্ম দেওয়া, বামন বা খাটো শিশুর জন্মদান, গর্ভবতী মায়েদের প্রসবকালীন জটিলতা দেখা দেয়- যা মা ও শিশুমৃতু্যর কারণ হতে পারে। তা ছাড়াও জিঙ্কের অভাবে মানসিক ভারসাম্যহীনতা, দৃষ্টিশক্তিতে ব্যাঘাত ঘটা, মাথার চুল পড়ে যাওয়া ও প্রস্টেট গ্রন্থির সমস্যা দেখা দেয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক ১২-১৫ মিলিগ্রাম, দুগ্ধদানকারী মায়েদের ১৬ মিলিগ্রাম এবং শিশুদের ২-১০ মিলিগ্রাম জিঙ্ক প্রয়োজন।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান বলেন, সরকার যদি জিঙ্কসমৃদ্ধ ধান চাষে কৃষকদের উৎসাহিত ও সহযোগিতা করে তাহলে ভালো ফল আসবে। এ ছাড়া সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানের সময় যদি জিঙ্কসমৃদ্ধ ধান-চাল ক্রয় করা হয় তবে কৃষকদের মধ্যে এ ধান আবাদে আগ্রহ বাড়বে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<82934 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1