দক্ষিণাঞ্চলে বিনা উদ্ভাবিত সরিষা চাষের সম্ভাবনা

প্রকাশ | ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

নাজমুন নাহার
সরিষা

বরিশালে অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিল রয়েছে। যে কারণে এখানে ধানের ফসলের উৎপাদন ভালো হয়। এ জন্য এক সময় এ অঞ্চলকে বলা হতো বাংলার ভেনিস। পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রভাবে ওখানকার নিচু জমিগুলো এখন বছরের বেশ কিছু সময় পানিতে নিমজ্জিত থাকে। ফলে রবি মৌসুমে ফসলের উৎপাদন একটু দেরি হয়। বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী ও বরগুনা এই ছয়টি জেলার সমন্বয়ে বরিশাল বিভাগ গঠিত। এই ছয় জেলার শস্যবিন্যাস এবং মাটির গঠনভেদে রয়েছে বিপুল বৈচিত্র্যতা। একটা সময় কৃষকরা শুধু ধান আবাদ করলেও এখন অনেকেই রবি মৌসুমে সরিষা করতে আগ্রহী। কারণ, সরিষা উৎপাদনে একদিকে যেমন ভোজ্যতেলের আমদানিনিভর্রতা কমে। অপরদিকে, স্বাস্থ্যের জন্য এই তেল হিতকর। তাছাড়া সরিষা থেকে ভাঙানো খৈলের বাজারমূল্য ভালো। এর গাছ শুকিয়ে রান্নার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। প্রচীনকাল থেকেই আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসায় সরিষার তেল বেশ জনপ্রিয়। বাঙালি ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে এই তেল। সরিষার তেল কোলেস্টেরলের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। কারণ, এর তেল মনোস্যাচুরেটেড ও পলিস্যাচুরেটেড ফ্যাটে সমৃদ্ধ। এসব কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ইতোমধ্যে সরিষার বেশ কয়েকটি জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে বিনা সরিষা-৯, বিনা সরিষা-১১, বিনা সরিষা-১২ বেশ জনপ্রিয়। এই জাতগুলো বাংলার শস্যভান্ডার খ্যাত দক্ষিণাঞ্চলের জন্য রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বিনা সরিষা-৯: বিনা সরিষা-৯ একটি উচ্চফলনশীল সরিষার জাত। এর উচ্চতা ৮৫-৯০ সে.মি.। সরিষার জীবনকাল মাত্র ৮৫-৯০ দিন। বীজের রঙ লালচে কালো। বীজে তেলের পরিমাণ ৪৩ শতাংশ। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ১.৭ টন। বিনা সরিষা-৯ এর বিশেষ গুণ হলো বৃষ্টিজনিত সাময়িক জলাবদ্ধতা সহনশীল (৫ দিন পর্যন্ত)। জোয়ার-ভাটার এ অঞ্চলে আমন মৌসুম দেরিতে হওয়ায় সরিষা আবাদের সময় চলে যায়। সেক্ষেত্রে বরিশালের বিভিন্ন স্থানে পরীক্ষণে দেখা গেছে, বিনা সরিষা-৯ নাবীতে বপন করলেও ভালো ফলন পাওয়া যায়। বিনা সরিষা-৯ জাতটি ৬-৮ ডি এস/মি. মাত্রার লবণাক্ততা সহনশীল। এছাড়া খেসারির মতো বিনা সরিষা-৯ মাটিতে 'জো' থাকা অবস্থায় ধানক্ষেতে ছিটিয়ে চাষ করা যায়। জমি চাষ দেয়া লাগে না। তাই খরচ কমে যায়। বিনা সরিষা-১১: বিনা সরিষা-১১ বিনা উদ্ভাবিত আরও একটি উচ্চফলনশীল জাত। এর জীবনকাল মাত্র ৭৮-৮২ দিন। স্বল্পজীবনকালীন আমন ধানের জাত চাষ করে বিনা সরিষা-১১ আবাদ করা যেতে পারে। অন্যান্য সরিষা দুই প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট হলেও বিনা সরিষা-১১ চার প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট। তাই এর ফলন ভালো হয়। সর্বোচ্চ ফলন ১.৮ টন/ হেক্টরপ্রতি এবং বীজে তেলের পরিমাণ ৪৪ শতাংশ। ভোজ্যতেলের আমদানি কমানোর ক্ষেত্রে সরিষা চাষের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ সয়াবিন তেল ও পাম অয়েল ব্যবহার করছে। এই তেল দীর্ঘ দিন ব্যবহার করলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। তাছাড়া, সরিষার তেল ঘন হওয়ায় পরিমাণে কম লাগে। এক ফসলি জমিকে দুই থেকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তরিত করতে হলে অবশ্যই স্বল্পজীবনকালীন জাত বাছাই করতে হবে। সেক্ষেত্রে যেসব জমি উঁচু এবং মাঝারি উচুঁ জমি রয়েছে সেখানে জীবনকাল কম এমন আমন জাতের আবাদ করে বিনা সরিষা-৯ বা বিনা সরিষা-১১ চাষ করলে কৃষক লাভজনক হবে। দক্ষিণাঞ্চলের শস্যবিন্যাসে সরিষার আবাদ বৃদ্ধি করতে পারলে কৃষক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন। পাশাপাশি কৃষিতে দেশ হবে আরো সমৃদ্ধ। লেখক: নাজমুন নাহার, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বরিশাল।