জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে কৃষি উৎপাদন ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমে যেতে পারে। সার্বিকভাবে অর্থনীতি ও পরিবেশ দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফসলের স্থানে ফুল দৃশ্যমান হবে। পরিবেশে বৈচিত্র্যহীনতা দেখা দেবে। মূলত আমাদের এই দরিদ্রতম ও উন্নতশীল দেশের যারা মূলকারিগর, যাদের মাধ্যমে এই উৎপাদন প্রক্রিয়া বিকেন্দ্রীকরণ হয়ে রূপান্তরিত রূপে মুনাফাখোরদের হাতে পৌঁছায়, কিন্তু সেই সব কারিগরদের জন্য ফসল ফলানোর ক্ষেত্রে ঈড়ংঃ ড়ভ চৎড়ফঁপঃরড়হ ঢ়বৎ শম/সফং বঃপ. কখনোই নিশ্চিত করে না।
যেমন ধরা যাক- বাংলাদেশের পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার কথা: ২০২২ সাল নাগাদ- সেখানকার কৃষকরা পেঁয়াজ আবাদ করে ব্যাপক পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। হালি বা মূল পদ্ধতির মাধ্যমে পেঁয়াজ আবাদ করে আবাদের মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টি হওয়ায় রোপণকৃত পেঁয়াজের বীজ ফুটাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অনেক গাছে ফলন না হয়ে দুর্ভাগ্যজনক শুধু ফুল দৃশ্যমান হয়। আগাম জাতের পেঁয়াজে ফুল আসা কলি স্বাভাবিক হলেও মূল পদ্ধতির পেঁয়াজের কলিতে ফুল ধরাটা অর্থনীতিতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিগত কয়েক বছর যাবত পাবনা সাঁথিয়া পেঁয়াজের ফলন বেশি হওয়ায় এ বছর কৃষক ফলন বেশি পাওয়ার আশায় আরও বেশি মাত্রায় বীজবপন করে উৎপাদন মাত্রা বাড়াতে গিয়ে চরম লোকশানের গড় মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতারং, এই বছর ভিন্ন চিত্র। পূর্ববর্তী বছরগুলোতে ফসলের অফুড়ন্ত ফলন ফলিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরছিল। কিন্ত এবার উৎপাদনের কারিগরখ্যাত কৃষক চোখের জলে বাড়ি ফিরছে।
বাস্তবতা হলো, এ অঞ্চলের পেঁয়াজের ৮০ শতাংশ জমির ফুল এসেছে, ফুল আসা পেঁয়াজের দাম কম এবং এই ঘাটতি বহু আকারে দেখা দেবে। সাঁথিয়া কৃষি কার্যালয়ের বরাদ্দ অনুযায়ী ওই বছর ১৬,৭৫০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। দুইটি পদ্ধতিতে পেঁয়াজের উৎপাদন হয় : একটি হলো- মুড়ি কাটা পদ্ধতি, অন্যটি হলো- হালি বা মূল পদ্ধতি। সাঁথিয়ায় হালি বা মূল পদ্ধতিতে পেঁয়াজের আবাদ বেশি হয়ে থাকে। হালি পদ্ধতিতে চাষাবাদের শুরুর মৌসুম হচ্ছে- জানুয়ারি বা ফেব্রম্নয়ারি মাসে। মার্চ বা এপ্রিল মাসে ফসল কৃষকের ঘরে ওঠে। সাধারণত হালি পেঁয়াজে কখনো ফুল আসে না। কিন্তু ফুল এলেও বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না। ফুল আসলে তা তুলে ফেলতে হয়। এদিকে কৃষিবিদরা বলছেন, পেঁয়াজ মূলত তিনটি কারণে ফুল আসে। যেমন: আবাদের শুরুতে বৃষ্টি, বেশি বয়সি বীজ রোপণ ও ত্রম্নটি যুক্ত পেঁয়াজের বীজবপন।
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে এবং মানুষের অবিবেচক, অবিজ্ঞানী কান্ডের ফলে সৃষ্টি হয় ডবোচর। এখন আমরা আলোচনা করছি ভোজনরসিক বাঙালির লোভনীয় ইলিশ মাছের কথা। যে চরে বাধা পেয়ে ইলিশ যাচ্ছে ভিন্ন পথে, আমরা এতে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। আজ ইলিশ মাছ ডিম ছাড়ছে অন্যের বাড়িতে। সেই ডিম ফুটে বের হওয়া ছানা-পোনারা খাবারের খোঁজে এসে জড়ো হচ্ছে ডবোচরগুলোতে। এই ডবোচরগুলোতে জমা হচ্ছে অন্যান্য মাছের পোনাও। তখন আবার সেই মাছের লোভে ছুটে আসছে, অসাদু ব্যবসায়ী ও মুনাফা লোভীরা। তারা বাচ-বিচার ছাড়াই মাছ স্বীকারে যুক্ত হয়, ক্ষতিকর নিষিদ্ধ জাল ফেলে ডবোচর ও আশপাশের নদীতে আশ্রয় নেওয়া ছোট ছোট মাছগুলোকে ধরে নিয়ে যায়। এতে অন্যান্য প্রজাতির মাছ, জলজপ্রাণী ও উদ্ভিদ রেণু পোনা জালে আটকা পড়ে অকালেই মৃতু্যবরণ করে। এই বিধ্বংসী কাজ থেকে রেহাই পায় না, চাপিলা, ঝাটকা কিংবা ছোট আকারের ইলিশও। যে কারণে আমাদের অর্থনীতি নিম্নগামী হচ্ছে দারুণভাবে।
মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন বিভাগের ব্যবস্থপনা পরিচালক মোলস্না এমদাদুলস্নাহ হকের মতে কয়েক বছর ধরে ভরা মৌসুমে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ উঠছে না। এর প্রধান কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টির ব্যাকরণ বদলে যাচ্ছে। বর্ষার বড় সময়জুড়ে বৃষ্টি থাকছে না। আবার হঠাৎ হঠাৎ ভারী বেগমান বৃষ্টি হচ্ছে- যা ইলিশ আবাদের জন্য সহনীয় নয়। যদি অতিরিক্ত খড়া, অনাবৃষ্টি, প্রচন্ড গরম, পানির তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা অসামঞ্জ্যকরণ হয় তাহলে ইলিশের পেটে ডিম আসে না। এর সঙ্গে নদীর স্রোত, পানির গভীরতাও সম্পর্কৃত।
২০৫০ সালে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার কৃষি প্রধান দেশগুলো শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই মুহুর্মুহু ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে দাঁড়াবে। ৯.০ দশমিক চার ভাগের সমান যাহা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। দক্ষিণ এশিয়ার- বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কার মধ্যে আঞ্চলিক জোরদার খাদ্য ব্যবস্থা ও পুষ্টি উন্নয়ন ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে ঘঁঃৎরঃরড়হ ড়ভ এৎড়ঃিয ঝধঢ়ষরহম করা হয়। এই সংস্থাটির প্রথম অধিবেশন শুরু হয়- ২০১৯ সালে। (ঝধঢ়ষরহম)-এর তথ্য অনুযায়ী জলবায়ু মোকাবিলার জন্য সুন্দর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা না হলে কৃষিকরা অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জলবায়ুর প্রভাবে উত্তাল পৃথিবী দাবানলে পুড়ছে। জলবায়ু সমস্যা প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। প্রকৃতি কাঁদছে, উন্নয়নের নামে ব্যাপক গাছ কাটা হচ্ছে। পাহাড় কাটছে। ইৎবধশ উড়হি :যব ঈধঃপযসবহঃ অৎবধ. আমাদের উপমহাদেশে আরও বেশি সমস্যা। ঋতু বৈচিত্র্যের দেশে শীত কমছে, গরম বাড়ছে। আমাদের আগামীর প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর বাসযোগ্য পৃথিবী চাই।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যেসব দেশের ওপর বেশি পড়ছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সুমদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য জোয়ারের পানি বেশি পস্নাবিত হয়। সমুদ্রের নোনা পানি আগের চেয়ে বেশি ঢুকে যাচ্ছে। জাতিসংঘের জলবায়ু সংক্রান্ত প্যানেল-ওচঈঈ-এর সর্বশেষ রিপোর্টে বলা হয়েছে চলতি শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে ২১ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়া হতে পারে। দেশের কৃষি অঞ্চলের উৎপাদন ৩১ থেকে ৪০ শতাংশ হ্রাস পাবে। জলবায়ু পরিবর্তন ও পানির চাহিদা বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে ১০ শতাংশ পানির সংকটের মধ্যে আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে- ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের পরিমাণ ও তীব্রতা দুটোই বৃদ্ধি পাবে। জলবায়ু পরিবর্তন উষ্ণকৃষির জন্য প্রযুক্তি ও ডিজিটাল আরও বেশি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রযুক্তি বিনিময়ের গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যায় মানবজাতি চিন্তিত। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে খাদ্য উৎপাদনের বড় ভূমিকা অগ্রগণ্য। ঋঅঙ-এর সম্মেলনে (৩৬তম এশিয়া ও প্যাসিফিক আঞ্চলিক সম্মেলন)-এর মাধ্যমে ৪৬টি দেশের কৃষি সচিব ও সরকারি কর্মচারীরা সম্মেলনে যোগ দেন। এই সম্মেলনে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞান, প্রযুক্তির বিষয়ক অভিজ্ঞতা ও পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাওয়া সম্পূরক বটে। ওই সম্মেলনে ঋঅঙ-এর ডেপুটি ডাইরেক্টর জম-সিন-কিম বলেন, শুধু উন্নত কৃষি উৎপাদন নয়, উন্নত পুষ্টি ও পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি ব্যবস্থাকে টেকসই করাসহ জীব বৈচিত্র্যকে রক্ষা করে, প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার এবং জলবায়ু সহনশীল কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়গুলো অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
২০১৫ সালের নভেম্বরে ল্যান্ডসেট এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ৩টি বিষয় উলেস্নখ করা হলো। যথাক্রমে : চিন্তা ও কল্পনার সমস্যা আর দ্বিতীয় জ্ঞান তথা গবেষণা ও তথ্যের ঘাটতি, বাস্তবায়ন ও সুশাসন বৈশ্বিক ও জলবায়ু পরিবর্তনে জনজীবন হুমকির সম্মুখীন। অতঃপর, উপরোক্ত বিষয়গুলোতে সরকারি ও প্রতিষ্ঠানসমূহের সমস্যার স্বীকৃতি দিতে ও ব্যবস্থা নিতে বিলম্ব লক্ষণীয়। প্রথমটির ক্ষেত্রে নিজস্ব উৎপাদনের ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সেই গুরুত্বের কাছে পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য ম্স্নান হচ্ছে। প্রান্তিক মানুষ বেশি পিছিয়ে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক ওচঈঈ-এর (প্যানেল অব ক্লাইমেন্ট চেইঞ্জ)-এর এক প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয় যে, জলবায়ু পরিবর্তন, খারাপ আবহাওয়া, পাহাড় কাটা, বিশ্বজুড়ে তীব্র খড়া, তাপদাহ ও ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদির ফলে প্রায় ৩৬০ কোটি মানুষ উচ্চ ঝুঁকিতে পড়েছে। ২০২০ সালের আদম শুমারিতে ৮৯ কোটির বেশি মানুষ উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলে বাস করে- যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ এই চিত্র ১০০ কোটি ছাড়াতে পারে। প্রায় প্রতিনিয়ত জাতিসংঘের জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা সর্তকবাণী দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্র পৃষ্ঠে উচ্চতা বাড়ছে। নিম্নাঞ্চল পানিতে ডুবে যাবে। মানুষের জানমাল ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। বিশ্বজুড়ে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে। শ্রম বাজার ধ্বংস হবে, গরিব মানুষের সংখ্যা বাড়বে। অর্থনৈতিক বিপর্যয় প্রকট হবে।