'কাদাকনাথ মুরগি' পালনে হতে পারেন কোটিপতি

প্রকাশ | ২১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

আলতাব হোসেন
কাদাকনাথ বা কড়কনাথ মুরগি নামের এক প্রজাতির মুরগির পালক থেকে শুরু করে হাড়-মাংস সবই কালো। রক্ত যদিও লাল- তবে, তাতে আছে কালচে আভা। কেবল ডিমের রং-ই সাদা। বাংলাদেশের অনেক জায়গায় এই মুরগিকে কড়কনাথ মুরগি বলেও ডাকা হয়। 'কালো জগতের আলো। কথাতেই আছে। একদম খাঁটি কথা।' কালো রং নিয়ে যে যতই দুর ছাই বলুক না কেন, গোটা দুনিয়ায় কালো জিনিসের কদর বেশি। মূল্যও নজরকাড়া। যেমন- কালো পাথর, কালো মুক্তা বা/বস্ন্যাক ডায়মন্ড। অধিকাংশই জানেন না, যে কালো রঙের মুরগিও পাওয়া যায়। পালক, ঠোঁট, পা, নখ, ঝুঁটি, চোখ, এমনকি ভেতরের মাংসের রংও কুচকুচে কালো। এই বিরল মুরগির মাংসই নয়, হাড়, ভেতরের নাড়িভুঁড়ি ও ডিমের রংও হালকা কালো রঙের। তবে, ভারতে এই মুরগির ডিম হালকা সোনালির রঙের হয়ে থাকে। যা সোনার ডিমের মতোই। কালো মুরগির মাংস কালো বলে অনেকে এড়িয়ে যান। কিন্তু এই বিরল প্রজাতির মুরগির উপকারিতার কথা সব গবেষকরাই এককথায় মেনে নিয়েছেন। কালো মুরগি বা কাদাকনাথ মুরগিতে রয়েছে প্রচুর প্রোটিন, ভিটামিন ও অন্যান্য খাদ্যগুণ। রয়েছে ওষুধি গুণসম্পন্নও। আমেরিকার ফ্লোরিডায় এই কালো রঙের মুরগির ব্যবসা করে অনেকেই হয়েছেন কোটিপতি। এখন এই কালো মুরগি ভারতে পাওয়া যায়। মধ্যপ্রদেশের আদিবাসীরা ইন্দোনেশিয়া থেকে মুরগি এনে হাইব্রিড প্রজাতির মুরগিতে পরিণত করে। তারপর থেকেই কালো মুরগির চাষ শুরু হয়। এই হাইব্রিড কালো মুরগিকেই দেশীয় ভাষায় কাদাকনাথ মুরগি বলা হয়। মধ্যপ্রদেশে আবার একে কালো মাসিও বলে। ভারতের মধ্যপ্রদেশের 'কালোমাসী' খ্যাত কাদাকনাথ মুরগির খামার করে নরসিংদীর শিবপুরের মজলিশপুর গ্রামের কামরুল ইসলাম মাসুদ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে আয়ের মুখ দেখেছেন। এতে খুলে গেছে তার ভাগ্যের চাকা। দেশের দূরদূরান্ত থেকে তার এই খামার থেকে মুরগি নিতে ছুটে আসছেন অনেকেই। এই কালো মুরগি এখন তার কাছে কালো সোনা। এখন তিনি কোটিপতি। এই মুরগির ঠোঁট, পাখ এবং মাংসের চাহিদা রয়েছে দেশের সর্বত্র। প্রতিদিন দুই শতাধিক বাচ্চা মুরগি বিক্রি হচ্ছে এই খামার থেকে। এক মাসের একটি বাচ্চা বিক্রি করছেন ৭৫০ টাকায়। এ ছাড়া মাংসের উপযোগী প্রতিটি মুরগি বিক্রি হচ্ছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকায়। আর প্রতিটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়। এসব বিক্রি করে কামরুল ইসলাম মাসুদ মাস শেষে আয় করছেন ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা। জানা গেছে, ২০১৬ সালে ভারতের মধ্যপ্রদেশ থেকে মাত্র ১০টি কাদাকনাথ মুরগির বাচ্চা দিয়ে যাত্রা শুরু করেন কামরুল ইসলাম মাসুদ। পরে মুরগি থেকে ডিম পেয়ে ধীরে ধীরে বাড়াতে থাকেন এই মুরগির সংখ্যা। এরপর তৈরি করেন ছোট একটি খামার। দিন দিন লাভের সংখ্যা বাড়তে থাকলে খামারের আকারও বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে তিনি প্রায় চার একর জমি নিয়ে এই খামার গড়ে তুলেন। তার খামারে এখন তিন হাজারের অধিক কাদাকনাথ মুরগি রয়েছে। মুরগির ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর জন্য রয়েছে তিনটি ইনকিউভেটর মেশিন এই মুরগির মাংসের প্রতি কেজির দাম হাজার টাকা। একজোড়া ডিম কিনতে লাগবে ২৫০ টাকার বেশি। কেন এত দাম এই প্রজাতির মুরগির ডিম আর মাংসের? কারণ, এই মুরগিতেই অসুখ থেকে মুক্তির জাদু দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ থেকে শুনু করে রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ, পেশিশক্তি বৃদ্ধি থেকে শুরু করে ক্যানসার প্রতিরোধেও এটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে বলে ধারণা চিকিৎসকদের। এই মুরগিতে রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও প্রচুর পরিমাণ আয়রন। খাদ্য তালিকায় এর মাংস সুস্বাদু, ওষুধি গুণসম্পন্ন ও দামি। এ মুরগির মাংসে রয়েছে মাত্র ১.৯৪ শতাংশ ফ্যাট; কিন্তু প্রোটিনের মাত্রা অন্য সব মুরগির মাংস থেকে কয়েক গুণ বেশি। \হএ জাতের মুরগির আদি নিবাস ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপ। সেখানে এটাকে বলা হয় 'আয়্যাম কেমানি'। ভারতের মধ্য প্রদেশে কাদাকনাথ 'কালোমাসি' বা 'কড়কনাথ' নামে পরিচিত। এর ডিম ও বাচ্চা বিক্রি করেও বেশি লাভবান হওয়া যায়। মধ্যপ্রদেশ প্রথম চাষ শুরু হলেও এখন বিভিন্ন প্রান্তেই এই মুরগি পাওয়া যায়। কর্ণাটক, কেরলা, তেলেঙ্গানা, ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গেও বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের কাকদ্বীপ, নামখানা ও কুলপিতে এই মুরগির চাষ শুরু হয়েছে। কাদাকনাথ মুরগির তিনটি প্রজাতি রয়েছে। জাত ৩টি হলো- জ্যাড বস্ন্যাক, পেনসিল্ড এবং গোল্ডেন কাদাকনাথ। জ্যাড বস্ন্যাকের ডানা পুরোপুরি কালো, পেন্সিল কাদাকনাথের আকার পেন্সিলের মতো। গোল্ডেন কাদাকনাথের ডানাগুলিতে সোনালি বণের্র দাগ রয়েছে। কড়কনাথ মুরগী পালন করে আপনি যথেষ্ট পরিমাণে আয় করতে পারেন। যদি আপনি ১০০টি বাচ্চা নিয়ে ফার্ম শুরু করেন, তবে এর জন্য আপনার ১৫০ বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন পড়বে। তবে বড় করে করতে হলে অর্থাৎ ১০০০টি কালো মুরগির পালনের জন্য ১৫০০ বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন হবে। মনে রাখবেন, পোলট্রি ফার্ম গ্রাম বা শহরের বাইরে এমন একটি জায়গায় হওয়া উচিত, যেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি এবং বিদু্যৎ রয়েছে। কাদাকনাথ মুরগি এবং মুরগির জন্য একটি শেড তৈরি করতে হবে- যাতে পর্যাপ্ত আলো এবং বাতাস যেতে পারে। এর সঙ্গে, খেয়াল রাখতে হবে, দুটি শেড একসঙ্গে যেন না হয় এবং একটি শেডে একটি প্রজাতির বাচ্চাই পালন করা উচিত। মনে রাখবেন, মুরগি এবং মুরগির ছানাকে গভীর রাতে খাবার দেওয়া উচিত নয়। এই মুরগির চাষ অনেকে করে থাকেন ইদানীং। এই মুরগির চাষের ক্ষেত্রে মোটা লাভ রয়েছে। কাদাকনাথ মুরগির মাংস অত্যন্ত সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। তাই এই মুরগির ইদানীং ভোক্তাসংখ্যা তৈরি হচ্ছে দেশে। কড়কনাথ মুরগি তাই চাষ করে লাখ লাখ টাকা রোজগার করতে পারেন অনেকে। কাড়কনাথ মুরগি পালন কৃষকদের জন্য একটি ভালো বিকল্প। এই মুরগির বৈশিষ্ট্য ও ভালো বাজারমূল্যের কারণে খামারিরা অল্প সময়ে ভালো লাভ করতে পারেন। কিছু জিনিস মাথায় রাখা জরুরি যেমন সঠিক বাসস্থান, খাবার এবং মুরগির যত্ন। এ ছাড়া মুরগির টিকা এবং রোগ থেকে রক্ষা করাও খুবই জরুরি। ভালো পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষকরা কাড়কনাথ মুরগি পালন করে কোটিপতি হতে পারেন। কাড়কনাথ মুরগির মাংস কালো রঙের এবং এতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, আয়রন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানও রয়েছে। এর স্বাদও খুবই চমৎকার। বাজারে কাদাকনাথ মুরগির মাংস ও ডিম অনেক দামে বিক্রি হয়। এর চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। কাদাকনাথ মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি- যা তাদের রোগ থেকে রক্ষা করা সহজ করে তোলে। কাদাকনাথ মুরগি পালন করা সহজ এবং রক্ষণাবেক্ষণে খুব বেশি খরচ হয় না। কাদাকনাথ মুরগির বিশেষত্ব হলো এটি অন্যান্য মুরগির তুলনায় কম অসুস্থ হয়- যার কারণে আপনি মুরগি পালনে কম খরচ পান। এ ছাড়া কাদাকনাথ মুরগির মাংস খুবই সুস্বাদু এবং অনেক পুষ্টিগুণ থাকায় বাজারে এর চাহিদা অনেক বেশি। গবেষণায় প্রমাণিত যে, অন্যান্য মুরগির তুলনায় এই প্রজাতির মুরগির পুষ্টিগুণ অনেক। আরও আশ্চযের্র কথা যে, এই মুরগিতে কোনো ফ্যাট থাকে না। রয়েছে আয়রন, প্রোটিন, ভিটামিন বি১, সি, ই, বি১২, নিয়াসিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস। এই চিকেনে কোলেস্টেরলও নেই। রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। তাই প্রয়োজনীয় ভিটামিন দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। এই সুস্বাদু মাংসে কোলেস্টেরলের মাত্রা কম থাকার কারণে হার্টের জন্য বেশ ভালো। এতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন, খনিজ উপাদান থাকার কারণে রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি থাকে না। হার্ট সুস্থ রাখার জন্য কালো মাংসের কদর বাড়িয়ে ডায়েটে আনুন বদল। এই প্রজাতির মুরগির মাংসে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকায় দেহের মধ্যে ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা যেমন গড়ে তোলে তেমনি ক্যানসারের কোষের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে সাহায্য করে। গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন ও প্রোটিনে ভরপুর থাকায় শরীরে যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ডায়েটে এই ধরনের মাংসের পদ রাখলে আপনার শরীরের নানান সমস্যার সমাধান হয়ে উঠতে পারে এক নিমেষে। চোখের দৃষ্টি বাড়াতেও এই মাংসের জুড়ি মেলা ভার। এই ধরনের মাংসে কারনোজিন নামক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকায় চোখের দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে। ঋতুস্রাবের সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে, ত্বকের নানান সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে, মাথাব্যথা ও অ্যাজমার রোগ সারাতে সহায়তা করে, রক্তাল্পতার ঝুঁঁকি কমায়, মহিলাদের ক্ষেত্রে অস্টিওপোরোসিস ও অস্টিআর্থ্রাইটিস রোগ প্রতিরোধেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে এই কালো মাসি!