বুধবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১

আধুনিক প্রযুক্তি কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে হবে

প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন
  ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
আধুনিক প্রযুক্তি কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে হবে

আধুনিক লাগসই প্রযুক্তি কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। মোবাইল ফোন, রেডিও, টিভি, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, সিনেমা সবই কৃষক তথ্য সেবার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃষকদের জন্য সরকারিভাবে একটি কমিউনিটি রেডিও চালু হয়েছে। বেসরকারিভাবে আরও ১৪টি রেডিও কৃষকদের তথ্যসেবা দিচ্ছে। এক্ষেত্রে ই-কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ই-কৃষি হলো- ইলেকট্রনিক প্রবাহের মাধ্যমে কৃষি বিষয়ক তথ্য সরবারহের একটি আধুনিক প্রক্রিয়া। যেখানে ইন্টারনেট, রেডিও, টেলিভিশন ও মোবাইল ফোন ইত্যাদি ইলেকট্রনিক যন্ত্রের মাধ্যমে দ্রম্নততার সঙ্গে কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য নির্ভরযোগ্যভাবে কৃষক, সম্প্রসারণকর্মী, ভোক্তা এবং সংশ্লিষ্ট সবার কাছে পৌঁছে দেয়া যায়।

বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকষের্র যুগে তথ্য সরবরাহের এক অসীম দুয়ার খুলে গেছে মুঠো ফোনের আবির্ভাবের মাধ্যমে। মোবাইল ফোনের স্বল্পমূল্য ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এর বিস্তৃতি কৃষি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি কৃষকের দোর গোড়ায় ব্যক্তিগতভাবে পৌঁছানো খুবই সহজ হয়েছে। এই নতুন তথ্যপ্রযুক্তি কৃষকের দোরগোড়ায় সঠিকভাবে পৌঁছাতে পারলে বাংলাদেশের কৃষি ও পলস্নী উন্নয়ন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। বিদ্যমান অন্যান্য উপায় হতে মুঠো ফোনের মাধ্যমে কৃষক অল্প খরচে নিজের প্রয়োজনীয় তথ্যাদি পেতে পারে বিশেষ করে তাদের বিভিন্ন সামাজিক সংস্থার মাধ্যমে। এতে করে কৃষকের মধ্যে প্রযুক্তি গ্রহণের হার দ্রম্নত বৃদ্ধি পাবে। কৃষি উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে মাটি, আবহাওয়া, কীটপতঙ্গ, রোগবালাই, ফসল সংগ্রহ, গুদামজাত ও বাজারজাত করণের বিচিত্রতা এবং আরও নানাবিধ কারণে কৃষকের কাছে বিভিন্ন তথ্য খুবই জরুরি। বিশেষ করে কোনো নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের বেলায়। কৃষি সম্পর্কিত যে কোনো তথ্যকেই কৃষি তথ্য বলা যেতে পারে। যেমন কৃষি সম্পদ: জমি, মাটি, পানি ও আবহাওয়া কৃষি বিনিয়োগ: মূলধন, শ্রম, বীজ, সার, কীটনাশক ও যন্ত্রপাতি ইত্যাদি এবং শস্য উৎপাদন প্রযুক্তি, গবাদি পশু ও মৎস্য পালন, খামার ব্যবস্থাপনা, শস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও আরও অন্যান্য কৃষিপণ্যসমূহ। কৃষি উন্নয়ন ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে তথ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে- যাতে কৃষক, কৃষি গবেষণাগার ও সম্প্রসারণ কর্মীর মধ্যে মেলবন্ধন রচনা হতে পারে। সঠিক সময়ে কৃষক সঠিক ও নিশ্চিত তথ্য পেলে তার সিদ্বান্ত গ্রহণ সহজ হয় ও তার তুলনামূলক পারদর্শিতা বৃদ্ধি পায়- যা কিনা বর্ধিত কৃষি উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর সহায়ক। স্থানীয় পর্যায়ে পর্যাপ্ত তথ্য ও কারিগরি জ্ঞানের অভাবে নিশ্চিতভাবেই ফলন কম হয়। বাংলাদেশের চাষিদের সাহায্য করার জন্য কৃষি ও পলস্নী উন্নয়নের স্বার্থে তাই তথ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে বা গুরুত্বের দাবি রাখে।

বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। এ দেশের অর্থনীতির প্রধান খাত হচ্ছে কৃষি। জনসংখ্যার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ কৃষি ক্ষেত্রে নিয়োজিত। মোট কৃষি উৎপাদনের জিডিপিতে অবদান ১৭ শতাংশ ও মোট শ্রম শক্তির ৪২ শতাংশ এতে নিয়োজিত। মোট কৃষি উৎপাদনের ৭২ শতাংশ শস্য, ১৭ শতাংশ গবাদি পশু ও ১০ শতাংশ বনজ উৎপাদন। কৃষি খাত দেশের দারিদ্র বিমোচন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্ম সংস্থানে উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা রাখে। কৃষি তথ্য সার্ভিস থেকে পরিচালিত 'কৃষিক সেন্টার' থেকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ১৬১২৩ নম্বরে ফোন করে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে যে কেউ কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক সমস্যার সমাধান পেতে পারেন। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহের অন্যান্য দিন সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত এই সেবা পাওয়া যায়। অন্যদিকে, তৃণমূল পর্যায়ে তথ্য বিস্তারের জন্য সরকারিভাবে কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এখান থেকে কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তথ্যসেবা গ্রহণ করতে পারেন। বর্তমানে বাংলাদেশের সব কৃষি বিষয়ক সরকারি প্রতিষ্ঠানের বাংলায় ওয়েবসাইট রয়েছে। এসব ওয়েবসাইট থেকে সংশ্লিষ্ট কৃষির বিভিন্ন বিষয়ে প্রযুক্তিগত তথ্য সারাদেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে যে কেউ বিনামূল্যে সংগ্রহ করতে পারেন। যেমন, বিএডিসি'র ওয়েবসাইট থেকে আমরা বীজ, সার ও সেচ সংক্রান্ত নানাবিদ তথ্য ও সেবা পেতে পারি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষি পণ্যের প্রতিদিনের বাজারদরের তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়াও কৃষির নানাবিদ বিষয়ভিত্তিক অ্যাপস রয়েছে, যেগুলো থেকে কৃষকরা তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য ও সেবা পেতে পারেন। বর্তমানে ইউনিয়ন পর্যায়ে ই-কৃষি সেবা কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়েছে। সরকারি ই-কৃষি সেবাগুলোর মধ্যে রয়েছে কৃষি তথ্য যোগাযোগ কেন্দ্র, কৃষি আলাপনি, কমিউনিটি রেডিও, প্রমোশনাল টিভি ও রেডিও অনুষ্ঠান, ভিডিও কনফারেন্সিং প্রভৃতি।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৪ কোটি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন। আর ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন ৪ কোটি ২৭ লাখ মানুষ। এর মধ্যে ৪ কোটি ১৩ লাখ মানুষ মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া স্মার্ট ফোন ব্যবহারের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। তাই মোবাইল ফোন ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি তথ্যপ্রযুক্তি সম্প্রসারণের এর বিশাল দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। যেহেতু কৃষি এ দেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি এবং প্রায় ৫০ ভাগ মানুষের জীবন-জীবিকা এর সঙ্গে জড়িত, তাই গ্রামীণ অর্থনীতিকে বেগবান ও গতিশীল করার জন্য কৃষিতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। যে কোন নম্বর থেকে ৬৭৬৭ নম্বরে কৃষকরা ফোন দিলে তার সবচেয়ে কাছের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে পাওয়া যাবে। কৃষকদের সমস্যা সম্পর্কে তিনিই সব তথ্য দেবেন। ওই বিষয়ের জন্য প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে কৃষককে জানাবেন। কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নিজে গিয়ে কৃষকদের কৃষি বিষয়ক সমস্যার সমাধান করবেন। ওই কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগে ব্যর্থ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কৃষক পার্শ্ববর্তী উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন।

কৃষি কর্মকর্তা ফোন রিসিভ না করলে চতুর্থবারের বেলায় কৃষি বিভাগের স্থানীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মোবাইলে একটি এসএমএস চলে যাবে। যাতে ওই উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা কাজে গাফলতি করার সুযোগ না পান। তবে এ কাজের জন্য কৃষি কর্মকর্তা সুবিধা পাবেন। দেশের ১৪ হাজার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে বাংলা লিংক সিম প্রদান করা হবে। ইতোমধ্যে কয়েকটি জেলায় এ সেবা চালু হয়েছে। দেশের সবগ্রামেই এ সেবা পৌঁছে যাবে। এ বিষয়ে কৃষি বিভাগের সঙ্গে বাংলা লিংকের একটি চুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের রয়েছে রাইজ নলেজ ব্যাংক নামে ইন্টারনেটভিত্তিক একটি তথ্য সেবা। এর মাধ্যমে কৃষকরা ধানের সঠিক জাত, বপন/রোপণের কৌশল, সার ব্যবস্থাপনাসহ সব তথ্য জানতে পারছেন। ভ্রাম্যমাণ চলচ্চিত্র প্রদর্শন ও আনন্দদানের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে খুব সহজেই কৃষকদের মাঝে প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করা যায়। ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে কৃষকরা প্রযুক্তিসেবা পেতে পারেন। ওয়েবসাইটটিতে কৃষির সব তথ্য যেমন, বিভিন্ন ফসলের চাষ পদ্ধতি, কৃষিকথা, কৃষি সম্প্রসারণ বার্তা, ভিডিও চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে তথ্য বিনিময় ও কৃষি বিষয়ক সমস্যার সমাধান করা যায়। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট কৃষকের জন্য বিনামূল্যে অনলাইন সার সুপারিশ সেবা চালু করেছে। ফসলের প্রয়োজন অনুযায়ী সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগের লক্ষ্যে একটি অনলাইন ফার্টিলাইজার রিকমেন্ডেশন সিস্টেম উদ্ভাবন করে এই প্রতিষ্ঠানটি। এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে মাটির পুষ্টিমানের তথ্য, ফসলের পুষ্টি চাহিদা ও সারে পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ বিশ্লেষণ করে সার প্রয়োগের নির্দেশনা পাবে কৃষক। এর ফলে, ফসলভেদে ২০ থেকে ৩০ ভাগ ফলন বাড়বে। মাটি ও গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হবে এবং উৎপাদন খরচ হ্রাস পাবে।

তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষক কীভাবে লাভবান হতে পারেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো- আলুর নাবীধসা রোগে আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদান। নাবীধসা আলুর একটি মারাত্মক রোগ- যার কারণে প্রতি বছর আলু ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। শীতকালে ঘনকুয়াশা পড়লে বা আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে এই রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং দু'এক দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ ফসল বিনষ্ট হয়ে যায়। প্রতিষেধক ব্যবস্থা হিসেবে বিভিন্ন ছত্রাকনাশক স্প্রে করে এই রোগ থেকে আলুকে রক্ষা করা যায়। এ রোগ দমনের জন্য আলু চাষিদের মোবাইল ফোনে ক্ষুদে বার্তা প্রেরণের মাধ্যমে এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদান করে ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যায়। ঠিক একইভাবে আমরা আম, লিচু, কলা ও তরমুজসহ বিভিন্ন ফল, শাকসবজি ও দানা ফসল, মাছ, ডিম, মাংস ও দুধ উৎপাদন বৃদ্ধিতে ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, স্মার্টফোন, ট্যাব, রেডিও এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ব্যবহার করে কৃষির টেকসই উন্নয়নে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি। নানাবিদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব প্রভৃতির মাধ্যমে আমরা কৃষি বিষয়ক তথ্য তরুণ সমাজের কাছে ছড়িয়ে দিতে পারি। এজন্য এসব ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি কৃষকের নিকট সহজলভ্য হতে হবে এবং এগুলোর ব্যবহার সম্পর্কে কৃষক ভাইদের যথেষ্ট জ্ঞান ও দক্ষতা থাকতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে