কৃষি খাতে সাফল্য বাড়বে সরকারি বিনিয়োগে

প্রকাশ | ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

ইমরান ছিদ্দিকি
দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি খাতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিপ্রধানে। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের শতকরা ২৯ ভাগ আসে কৃষি ও সংশ্লিষ্ট খাত থেকে। সমতল ভূমির মোট জমির শতকরা ৯২ ভাগ ব্যবহার করা হয় কৃষিকাজে আর কৃষিকে অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করে শতকরা ৬৪ ভাগ মানুষ। কৃষি খাতে দেশের বেশিরভাগ ভূমি ব্যবহৃত হয় এবং এ খাতই কর্মসংস্থানের অন্যতম উৎস। খাদ্যঘাটতির দেশে দানাদার খাদ্যে এসেছে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। কৃষিপণ্যের রপ্তানি ছুঁয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক। তবে এ সাফল্য কৃষি খাতের প্রারম্ভিক সাফল্য। কৃষি ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ, উচ্চ ফলনশীল শস্যের উৎপাদনে সহায়তাকারী বীজ, উপকরণ, সার সরবরাহ, কৃষককে সহজ শর্তে মূলধন জোগান ইত্যাদি তার উৎপাদিত পণ্য ন্যায্যমূল্যে বিপণন ব্যবস্থা তদারক করে কৃষি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা এবং কৃষি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরদার করার মাধ্যমে কৃষিকেই দেশের জিডিপির অন্যতম জোগানদাতা হিসেবে পাওয়া গেছে। কৃষিতে অর্থায়ন ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সরকারের নীতিসহায়তা বৃদ্ধি ও কিছু প্রতিবন্ধকতা দূর করা গেলে কৃষি খাত আরও এগিয়ে যাবে। বিশ্ব কৃষির বাজারে প্রথম সারির দেশগুলোর সঙ্গে প্রতযোগিতা করবে বাংলাদেশ। এখন বড় চ্যালেঞ্জ উৎপাদিত কৃষিপণ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা। সে জন্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পকে আরও এগিয়ে নেওয়ার বিকল্প নেই। দেশে কৃষিশিল্প গড়তে এক থেকে দুই শতাংশ সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা দরকার। পাশাপাশি শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় আরও কিছু বিশেষ কর্মসূচি নিতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করতে হবে। দেশে-বিদেশে কৃষিপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত পণ্যের মার্কেট বড় না হলে কোনোভাবে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কৃষিতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে; অতএব, কৃষিকে রূপান্তর করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে কিছু আইন বদলাতে হতে পারে। রপ্তানিমুখী অর্থনীতি তৈরির জন্য কৃষি খাতকে এগিয়ে নেওয়ার বিকল্প নেই। শিল্পনীতি, কৃষিনীতিতে নানা সুযোগ-সুবিধা কীভাবে বাড়ানোর প্রস্তাবে সহায়তা আবশ্যক হবে। এটি উপলব্ধিতে আসতে হবে যে, কৃষির উন্নয়ন ছাড়া স্থিতিশীল উন্নয়ন সম্ভব নয়। কৃষি খাতে, বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষের প্রয়োজনে যেসব সুবিধা, যেমন- স্বল্প সুদে ঋণ এবং দরিদ্র ও অতিদরিদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ এবং প্রণোদনা সহায়তা বাড়ানো। ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্রদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর আগ্রহ কম। তারা তাদের নির্ধারিত ঋণের বড় অংশ বড় খাতগুলোকে দিচ্ছে। কৃষিতে কম দিচ্ছে। কৃষি খাতকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় সবাইকে তারা সহায়তা করুক। সে তাগিদ আগেও ছিল, এখনো থাকবে। বাংলাদেশের কৃষক, ভালো কৃষক। তারা উৎপাদনশীলতায় নেদারল্যান্ডসের মতো উন্নত কৃষি উৎপাদনকারীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম। এরই মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি রপ্তানিতে ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। এ সাফল্য শেষ নয়, শুরু। সরকারের নীতি সহায়তা বৃদ্ধি ও কিছু প্রতিবন্ধকতা দূর করা গেলে এ কৃষি খাত আরও এগিয়ে যাবে। বিশ্ব কৃষির বাজারে প্রথম সারির দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। ধান-সবজিসহ বিভিন্ন ফসল উপযোগী উর্বর মাটির দেশ। তা সত্ত্বে প্রাচীন প্রদ্ধতিতে চাষাবাদের কারণে সব সময় খাদ্য ঘাটতি ছিল। এখন ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে ওঠে এসেছে। এর মধ্যে পাট রপ্তানিতে বিশ্বে প্রথম বাংলাদেশ। সবজিতে তৃতীয়, মিঠাপানির মাছে তৃতীয়, আম উৎপাদনে বিশ্বে নবম বাংলাদেশ। আলু উৎপাদনে শীর্ষ দশে বাংলাদেশ। ইলিশ উৎপাদনে প্রথম বাংলাদেশ। বস্ন্যাক বেঙ্গল ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ। আর ছাগলের দুধ উৎপাদনে দ্বিতীয়, পেয়ারা উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম, কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয় এবং জলবায়ু সহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবনে শীর্ষে বাংলাদেশ। কেবল উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়, হেক্টরপ্রতি উৎপাদনের দিক থেকেও অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। জিডিপিতে এখন কৃষির অবদান ৪ শতাংশ। কৃষিতে দেশের ৪০ শতাংশ শ্রমিক রয়েছে। মৌসুমে কৃষি শ্রমিকের সংকট ও মজুরি বৃদ্ধি পায়। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ফসলচাষে যান্ত্রিকীকরণ শুরু হয়েছে। এ জন্য কৃষকদের ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। যান্ত্রিকীকরণ বাড়াতে তিন হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। জলবায়ু সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে ব্রি এবং বিনা। উপকূলের প্রায় ২৫ শতাংশ এলাকা লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। বর্তমানে ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বাংলাদেশের স্থান হলো সবার উপরে। তা ছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চাষকৃত মৎস্য উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম ও আলু উৎপাদনে অষ্টম বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ, গম দুই গুণ, ভুট্টা ১০ গুণ ও সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। খাদ্যশস্য, মৎস্য, ডিম ও মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ম্ভর। চিরকালের দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে। বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণের ফলেই এই উন্নতি সম্ভব হয়েছে। কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। কৃষিজমি কমতে থাকা, জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর চাল ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগ সহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন খাতে দেশের যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান খাতটি হলো কৃষি খাত। অতীতে বাংলাদেশ ছিল একটি খাদ্য ঘাটতির দেশ। ঘাটতি মেটাতে হয়েছে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানির মাধ্যমে। প্রতি বছর এদেশে মানুষ বাড়ছে ২০ লাখ। কৃষি জমি কমছে ৮ লাখ হেক্টর। তার পরও জনপ্রতি সরবরাহ কমছে না কৃষিপণ্যের বরং বাড়ছে নিরন্তর। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জনপ্রতি আমাদের খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা ছিল ৪৫৬ গ্রাম, ২০০০ সালে তা ৫২২ গ্রাম এবং ২০২০ সালে তা ৬৮৭ গ্রামে বৃদ্ধি পায়। এর কারণ দ্রম্নত অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি। আগের খোরপোশ পর্যায়ের কৃষি এখন পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক কৃষিতে। এক নীরববিপস্নব সূচিত হয়েছে কৃষির প্রতিটি উপ-খাতে। খাদ্য বলতে শুধু ধান, চাল, আটা, ময়দা আর ভুট্টাকে বুঝায় না, বরং মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাকসবজি এসবকে বুঝায়। বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা যখন ঝুঁকিতে, তখনো সর্বোচ্চ খাদ্য উৎপাদন ও মজুত নিয়ে স্বস্তিতে বাংলাদেশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। ধান, গম, ভুট্টা আলু, আম বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগসহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম।