শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

মাশরুমে বাড়বে পুষ্টি ও কর্মসংস্থান

আলতাব হোসেন
  ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
মাশরুমে বাড়বে পুষ্টি ও কর্মসংস্থান

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাশরুম চাষ হচ্ছে। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণ যুবকরা মাশরুম চাষ করছেন। গৃহিণীরাও এ চাষ থেকে পিছিয়ে নেই। অর্থাৎ আমাদের দেশে ঘরোয়াভাবে এবং বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে মাশরুম। মাশরুম চাষ আমাদের দেশের বেকার সমস্যা সমাধান এবং বাড়তি আয়ের উৎস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে মাশরুম বিশেষ অবদান রাখতে পারে। মাশরুমের উৎপাদন বৃদ্ধি ও রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। উদ্যোক্তা তৈরিতে হাজার কোটি টাকার বড় প্রকল্প নিতে যাচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়। মাশরুম খেতে সুস্বাদু হওয়ার পাশাপাশি এটি শরীরের জন্যও বেশ উপকারী। কম ক্যালোরি ছাড়াও এটি অনেক পুষ্টিতে সমৃদ্ধ। এতে বাড়বে পুষ্টি ও কর্মসংস্থান।

দেশে প্রতি বছর ৮০০ কোটি টাকার মাশরুম উৎপাদন হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মাশরুম একটি সম্ভাবনাময় ফসল। মাশরুম একটি পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও ঔষধিগুণসম্পন্ন খাবার। অন্যদিকে, তা চাষ করার জন্য কোনো আবাদি জমির প্রয়োজন হয় না। ঘনবসতিপূর্ণ ও দ্রম্নত বর্ধনশীল জনসংখ্যার বাংলাদেশে খাবারের চাহিদা বাড়ছে অথচ খাবার জোগান দেওয়ার জমি প্রতি বছর কমছে। এই অবস্থায়, অনুৎপাদনশীল ফেলনা জমির স্বল্প পরিমাণ ব্যবহার করেই বিপুল পরিমাণ মাশরুম উৎপাদন করা যায়। তাছাড়া, বাংলাদেশের আবহাওয়া সারা বছর মাশরুম চাষের জন্য উপযোগী।

মাশরুম খেতে সুস্বাদু হওয়ার পাশাপাশি এটি শরীরের জন্যও বেশ উপকারী। কম ক্যালোরি ছাড়াও এটি অনেক পুষ্টিতে সমৃদ্ধ। সালাদ, সু্যপ, সবজি এমনকি স্ন্যাকস হিসেবে এটি খাওয়া যায়। মাশরুম টিউমার নিরাময় করে, উচ্চ রক্তচাপ কমায় এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে। মাশরুম অত্যন্ত পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও ঔষধি গুণসম্পন্ন খাবার। এতে আছে প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল, অ্যামাইনো এসিড, অ্যান্টি-বায়োটিক ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। স্বাদ, পুষ্টি ও ঔষধিগুণের কারণে ইতোমধ্যেই এটি সারাদেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মাশরুম উৎপাদন বৃদ্ধির নিমিত্তে বিশ্বের জনপ্রিয় বিভিন্ন ধরনের মাশরুমের (যেমন বাটন, ইরিনজি, বস্ন্যাক, চেজনাট, বিপিও ইত্যাদি) ইতোমধ্যে ৮টি জার্মপস্নাজম সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব জার্মপস্নাজমের বাংলাদেশে চাষ উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে ইতোমধ্যে অনেকে চাষ শুরু করেছে, যেমন গাজীপুরে ভূঁইয়া মাশরুম ও রাঙ্গামাটিতে সুমেধ চাকমা। দারিদ্র্যবিমোচনে এবং নারী, শিশু, অক্ষম ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর পুষ্টিচাহিদা পূরণেও মাশরুম বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। মাশরুম চাষ শুরু করার জন্য অধিক পুঁজির প্রয়োজন হয় না বিধায় হতদরিদ্র ভূমিহীন মানুষও মাশরুম চাষ করতে পারেন। মাশরুম চাষে অল্প দিনেই ফলন পাওয়া যায় এবং লাভসহ পুঁজি ঘরে আসে। মাশরুম চাষের মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থানও হতে পারে।

মাশরুম এক ধরনের উপকারী ছত্রাকজাতীয় উদ্ভিদ। উদ্ভিদ হলেও অন্যান্য উদ্ভিদের মতো মাশরুমের সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাদ্য তৈরির জন্য সূর্য থেকে আলোর প্রয়োজন পড়ে না। আমাদের দেশে মাশরুম ব্যাঙের ছাতা নামে বেশি পরিচিত। একে আমরা সবজি হিসেবে খেয়ে থাকি। প্রাচীন গ্রিক, রোম ও ভারতীয় সাহিত্যে রাজাদের একটি লোভনীয় খাদ্য হিসেবে মাশরুমের কথা বর্ণিত হয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে প্রতিদিনের স্বাভাবিক খাবার হিসেবে মাশরুম ব্যবহার করা হয়। বিশ শতকের শুরুতে ইউরোপে প্রথম মাশরুমের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হলেও বাংলাদেশে এর চাষ শুরু হয়েছে আশির দশকের শেষ দিকে। সে সময় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের উদ্যোগে মাশরুমের চাষ শুরু হয়।

ঘরে বসে মাশরুম চাষ করা যায় খুব সহজেই। মাশরুম অনেক পুষ্টিকর খবার। এ সময়ে চিকিৎসকরা পরামর্শ দিচ্ছেন হাই প্রোটিনযুক্ত ডায়েটের। মাশরুম হাই প্রোটিনযুক্ত। হজম হয় তাড়াতাড়ি। প্রোটিন ছাড়াও এতে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজপদার্থ। বিশ্বজুড়ে চাষ করা হয় নানা জাতের মাশরুম। তবে আমাদের দেশের আবহাওয়ায় এবং তুলনামূলক সহজ পদ্ধতিতে ঘরে ফলানোর জন্য উপযুক্ত অয়েস্টার, মিল্কি, প্যাডি জাতীয় মাশরুম। অয়েস্টার মাশরুম ফলানোর পক্ষে আবার শীতকাল উপযুক্ত। শীতে মাশরুম খেলে উপকার পাওয়া যায়। নিরামিষভোজীদের কাছে মাশরুম মাংস হিসেবে বেশ পছন্দের। অতিবেগুনি রশ্মির প্রতিফলনে এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ডি তৈরি হয়। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। শীতে খেতে পারেন মাশরুম সু্যপ। মাশরুমে রয়েছে ভিটামিন বি এবং প্রচুর খনিজ- যা শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং এতে থাকা ক্যালসিয়াম হাড় মজবুত করে। আর মাশরুম মানেই প্রচুর আয়রন।

নিয়মিত মাশরুম খেলে শরীর থাকবে সুস্থ। মাশরুমে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, প্রোটিন, ভিটামিন বি, ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি, মিনারেল, অ্যামাইনো অ্যাসিড, অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে। মাশরুমে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকায় তা রক্তশূন্যতাজনিত সমস্যা দূর করতে পারে। মাশরুম রক্তে চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখে। তাই এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুবই উপকারী। মাশরুমে রয়েছে পটাসিয়াম- যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। কোলেস্টেরল কমানোর অন্যতম উপাদান এরিটাডেনিন, লোভাস্ট্যাটিন, এনটাডেনিন, কাইটি রয়েছে মাশরুমে। তাই মাশরুমকে খাদ্য তালিকায় রাখলে শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। মানুষের শরীরের দুটি প্রয়োজনীয় অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট পলিফেনল ও সেলেনিয়াম রয়েছে মাশরুমে। এগুলো স্ট্রোক, নার্ভের রোগ এবং ক্যানসার থেকে শরীরকে রক্ষা করতে সহায়তা করে। মূলত স্তন ক্যানসার এবং প্রস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধ করতে মাশরুমের কোনো তুলনা নেই। ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকায় হাড়ের শক্তি বৃদ্ধিতে ও গাঁটের ব্যথা কমাতে মাশরুমের উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। বয়সজনিত কারণে যে স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ার রোগ প্রতিরোধ করে মাশরুম। নিয়মিত মাশরুম খেলে হেপাটাইটিস বি ও জন্ডিস প্রতিরোধ করাও সম্ভব। মাশরুমে সোডিয়ামের পরিমাণ খুব কম, এটি কিডনি-সংক্রান্ত রোগ হওয়া থেকেও বাঁচাতে পারে।

পৃথিবীতে প্রায় ১৪ হাজার প্রজাতির মাশরুমের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে বাংলাদেশে শনাক্তকৃত প্রায় ২০ প্রজাতির মাশরুমের মধ্যে পাঁচ-ছয় প্রজাতির মাশরুমকে বিষাক্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। ইউরোপে মাশরুমের চাষ শুরু হলেও চীন বর্তমানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ খাবার উপযোগী মাশরুম উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বিশ্বের মোট মাশরুম উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক হয় চীনে। বাংলাদেশে ঝিনুক মাশরুমের চাষই বেশি প্রচলিত। মাশরুম আমাদের দেহের জন্য খুব উপকারী। মানবদেহের অত্যাবশ্যকীয় ৯টি অ্যামাইনো এসিডের সবই এতে আছে। প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলের পরিমাণ এতে খুব বেশি। প্রাণিজ আমিষ যেমন- মাংস ও ডিমের আমিষ উন্নত ও সম্পূর্ণ হলেও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত চর্বি থাকায় দেহে কোলেস্টেরল সমস্যা দেখা দেয়। যার ফলে, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, মেদভুঁড়ি ইত্যাদি জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পক্ষান্তরে মাশরুমের প্রোটিন নির্দোষ। চর্বি ও কার্বোহাইড্রেটের কম উপস্থিতি এবং কোলেস্টেরল ভাঙার উপাদান লোভাস্টাটিন, অ্যান্টাডেনিন, ইরিটাডেনিন ও নায়াসিন থাকায় শরীরে কোলেস্টেরল জমার ভয় থাকে না। এ ছাড়া মাশরুম হাড় ও দাঁত শক্ত করে এবং চুল পাকা ও চুল পড়া রোধে সাহায্য করে।

বাংলাদেশে মাশরুম অমিত সম্ভাবনাময় একটি ফসল। জনসংখ্যার আধিক্যপূর্ণ এ দেশের উর্বর জমি ব্যবহার না করে শুধু ফেলনা কৃষিজ বা বনজ বর্জ্য যেমন ধানের খড়, কাঠের গুঁড়া, গমের ভুসি ইত্যাদি ব্যবহার করে উৎপাদন করা যায় পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও ঔষধিগুণসম্পন্ন একটি সবজি, মাশরুম। এ ফসলটি চাষ করার জন্য কোনো বালাইনাশক, এমনকি কোনো রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না; তাই মাশরুম চাষ একটি পবিবেশবান্ধব কাজ। তাছাড়াও মাশরুম চাষ অল্প জায়গায় অধিক সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ করা যায় এবং মৌলিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ফেলনা বর্জ্যকে মূল্যবান খাবারে পরিবর্তন করা যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই অল্প সময়ের ব্যবধানে দেশে মাশরুমের চাষ বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বৃদ্ধির হার আরও বেগবান করার জন্য মাশরুমের উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়ানো প্রয়োজন। এ দেশে ১৭ কোটি মানুষ প্রতিদিন মাত্র ২৫ গ্রাম করে মাশরুম খেলেও বছরে প্রায় ১৫ হাজার টন মাশরুমের প্রয়োজন হবে। শুধু মাশরুম উৎপাদন ও বিপণন করলেই হবে না। মাশরুমকে ভ্যালু এডেড প্রডাক্টে রূপ্রান্তর করতে হবে।

মাশরুমের তৈরি জ্যাম, আচার, বিস্কুট, কাটলেট, চপ, ফ্রাই ইত্যাদি খুবই সুস্বাদু খাবার। এগুলো তৈরি করে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। বিকল্প খাবার পাওয়াতে পণ্যের কাটতিও বেড়ে যাবে। এ সবজিটির কোনো অপকার নেই বরং রয়েছে অনন্য পুষ্টি ঔষধিগুণ। তাই এ সবজির উৎপাদন ও বিপণন অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে এবং মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ নিয়মিত প্রাতঃভ্রমণ করেন। তাছাড়া দেশের একটি বিরাট সংখ্যক মানুষ ডায়াবেটিস আক্রান্ত; তারাও প্রাতঃভ্রমণ করেন। এ মানুষের কাছে মাশরুম পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করলে মাশরুম বিক্রি বেড়ে যাবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে