পুষ্টিকর দানাদার খাদ্য ভুট্টা চাষে এগিয়ে বাংলাদেশ

ভুট্টার বীজ বপনের উপযুক্ত সময় অক্টোবর থেকে নভেম্বর

প্রকাশ | ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন
ধান ও গমের পরে অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার ভুট্টা। এটি কর্ন নামেও পরিচিত। নানারকম খাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ভুট্টার চাষাবাদ শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রে। সেখান থেকেই পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভুট্টার চাষ হচ্ছে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চীন, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন উলেস্নখযোগ্য। বাংলাদেশে কমবেশি প্রায় সব জেলাতেই ভুট্টার চাষ হয়। সবচেয়ে বেশি চাষ হয় বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, দিনাজপুর ও রাজশাহী অঞ্চলে। ভুট্টার পুষ্টিমান অনেক বেশি। এতে প্রায় ১১ শতাংশ আমিষ রয়েছে। হলদে রঙের ভুট্টাদানায় প্রতি ১০০ গ্রামে থাকে প্রায় ৯০ মিলিগ্রাম ক্যারোটিন বা ভিটামিন এ। বাংলাদেশে রবি মৌসুমে মধ্য-আশ্বিন থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ (অক্টোবর-নভেম্বর) এবং খরিফ মৌসুমে ফাল্গুন থেকে মধ্য- চৈত্র (মধ্য ফেব্রম্নয়ারি-মার্চ) পর্যন্ত সময় বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। পবলে দোআঁশ ও দোআঁশ মাটি ভুট্টাচাষের জন্য উপযোগী। জুমচাষেও ভুট্টার আবাদ হয়। যে মাটিতে ওই মাত্রা ৫.৫ থেকে ৮.৫ সেখানে ভুট্টা ভালো জন্মে। ভুট্টাচাষের জন্য জমি এমন হতে হয়, যেন পানি জমে না থাকে। বাংলাদেশে উন্নত জাতের ভুট্টা হচ্ছে- জেসি, ডিএমআর, বর্ণালি, শুভ্রা, মোহর, খইভুট্টা ও সোয়ান-২ আবাদ করা হয়। এ ছাড়া কয়েকটি সংকরজাতের ভুট্টা কিছু কিছু এলাকায় চাষ হয়। ভুট্টাগাছের মোচা ৭৫-৮০ শতাংশ পরিপক্ব হলে ভুট্টা সংগ্রহ করা যায়। এ ক্ষেত্রে ভুট্টার মোচা চকচকে খড়ের রং ধারণ করে এবং পাতা কিছুটা হলদে হয়। বীজ হিসেবে মোচার মাঝামাঝি অংশ থেকে বড় ও পুষ্ট দানা সংগ্রহ করতে হয়। ধান ও গমের তুলনায় ভুট্টার পুষ্টিমান বেশি। এতে প্রায় ১১ শতাংশ আমিষ জাতীয় উপাদান রয়েছে। আমিষে প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড, ট্রিপটোফ্যান ও লাইসিন অধিক পরিমাণে আছে। এছাড়া হলদে রংয়ের ভুট্টা দানায় প্রতি ১০০ গ্রামে প্রায় ৯০ মিলিগ্রাম ক্যারোটিন বা ভিটামিন এ থাকে। ভুট্টার দানা মানুষের খাদ্য হিসেবে এবং ভুট্টার গাছ ও সবুজ পাতা উন্নতমানের গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য হিসেবেও এর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছ। ভুট্টা চাষে কম সময়েই সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালে ৪৭ লাখ টন ভুট্টা উৎপাদন হয়। ২০২৪ সালের টাগের্ট প্রায় ৬০ লাখ টন। অন্যান্য খাদ্যশস্যের চেয়ে কম পরিচর্যা ও কম সেচ খরচে ভালো ফলন হয় এবং দামও ভালো পাওয়া যায় বলে ভুট্টাচাষে কৃষকরা আগ্রহী হয়ে উঠছেন। ফলে, ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন বাড়ছে। মাত্র পাঁচ বছরে দেশে ভুট্টার উৎপাদন বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। হেক্টরপ্রতি ফলনেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর কাতারে রয়েছে। দেশে বছরে ৫৪ লাখ টন ভুট্টা উৎপাদন হচ্ছে। দেশেভুট্টাচাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। উন্নতজাত উদ্ভাবন হয়েছে, অনুকূল কৃষি জলবায়ু রয়েছে ও কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে- যার ফলে ভুট্টার উৎপাদন বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব। অন্যদিকে, দেশে-বিদেশে ভুট্টার প্রচুর চাহিদা রয়েছে। দেশে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের খাদ্য হিসেবে ভুট্টা ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। সে জন্য ভুট্টার উৎপাদন আরও বাড়াতে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী ৫ বছরের মধ্যে ভুট্টার উৎপাদন বছরে এক কোটি টনে উন্নীত করতে কাজ চলছে। আর এটি করতে পারলে ভুট্টা উৎপাদনে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন নয়, বিদেশে রপ্তানি করেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাব অনুযায়ী দেশে ভুট্টার উৎপাদন ২০০৯ সালে ছিল সাত লাখ ৫০ হাজার টন, ২০২০ সালে যা বেড়ে হয়েছে ৫৪ লাখ টন। অন্যদিকে, ভুট্টার চাহিদা বছরে ৬৫ থেকে ৭০ লাখ টন। টাঙ্গাইলের চাষিরা জানান, এ ফসল চাষে খরচ যেমন কম, অন্যদিকে ফলন এবং লাভও বেশি। এ কারণে চাষিদের মাঝে ভুট্টাচাষে আগ্রহ দেখা দিয়েছে। তাছাড়া বাণিজ্যিকভাবে মৎস্যচাষ, পলয়ার ও ব্রয়লার মুরগির ফার্ম এবং গরু মোটা-তাজাকরণ প্রকল্পের জন্য ভুট্টার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। মীর্জাপুরের কৃষক আবুল হাসিম জানান, এ বছর তিনি ৮ বিঘা জমিতে ভুট্টাচাষ করেছেন। ধানের আবাদের চেয়ে ভুট্টার আবাদ অনেক লাভজনক হওয়ায় তার দেখাদেখি অনেকেই এ ফসল চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। বিঘাপ্রতি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ হলেও ৩৫ থেকে ৪০ মণ পর্যন্ত ভুট্টা উৎপাদন সম্ভব। ভুট্টার শুকনো গাছ ও ভুট্টা মাড়াইয়ের পর তা জ্বালানি হিসেবে বাজারে বিক্রি করে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করা যায় বলে জানান তিনি। ভুট্টা এখন আর শুধু মুরগির খাদ্য নয়, মানুষের অন্যতম প্রয়োজনীয় দানাদার শস্য। উন্নত পুষ্টিমান ও বহুবিধ ব্যবহারের কারণে ভুট্টার জনপ্রিয়তা বাড়ছে। চরাঞ্চলে ভুট্টার ভালো ফলন হয়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। ভালো দাম পেয়ে গাইবান্ধা ও বগুড়ার চরাঞ্চলের কৃষকরা বেশ খুশি। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, প্রতি বছরই বাড়ছে ভুট্টাচাষ। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এ বছর ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে। করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে দামও বেড়েছে দ্বিগুণ। ফলে, কৃষকের মধ্যে ভুট্টাচাষের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। পানি জমে না এমন বন্যামুক্ত উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিতে ভুট্টাচাষ করা যায়। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় হাইব্রিড ও দেশি উভয় ভুট্টাচাষ করা যায়। হাইব্রিড জাতে ফলন বেশি হওয়ায় দেশে আবাদকৃত মোট জমির ৯৫ ভাগেই হাইব্রিড জাতের চাষ হয়ে থাকে। বীজ বপনের আগে বীজের গজানোর হার ৯০ ভাগের ওপর হলেই ওই বীজ কেনা উচিত। বীজবপনের অন্তত এক সপ্তাহ আগে বীজ গজানোর ক্ষমতা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। চাষের আগে জমিতে জৈব সার সমানভাবে প্রয়োগ করা উচিত। মাটিতে জোঁ থাকা অবস্থায় ৩ থেকে ৪টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে ঝুরঝুরে করে মাটি তৈরি করতে হবে। জমি সমান করার পর সেচ প্রয়োগ ও পানি নিষ্কাশনের জন্য জমির চার পাশে নালা করতে হবে। জমির দু'পাশে রশি বেঁধে কোদাল বা ছোট হাত লাঙলের সাহায্যে এক থেকে দুই ইঞ্চি পরিমাণ মাটি গভীর করে এই লাইন বীজবপন করতে হয়। লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব হবে ৩০ ইঞ্চি বা পৌনে দু'হাত। ওই লাইনের মধ্যে ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি বা আধা হাত পরপর একটি করে বীজ দিয়ে লাইনটি ভালভাবে ভরাট করতে হবে। জমিতে পরিমিত রস না থাকলে বীজ বোনার পর হালকা সেচ দিতে হবে। চারাগাছের পাতা ৩ থেকে ৫টি হলে প্রথম সেচ দিতে হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে, সেচ কিংবা বৃষ্টির পানি গাছের গোড়ায় যেন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা জমে না থাকে। ভুট্টা গাছের পাতা ৮ থেকে ১০টি হলে প্রথম দফায় একরপ্রতি ৭৫ কেজি বা শতাংশে তিন পোয়া ইউরিয়া সার দু'সারির মাঝখানে ছিটিয়ে দিতে হবে। গাছের মাথায় ফুল আসার আগে সমপরিমাণ সার গাছের গোড়ায় লাইন বরাবর ছিটিয়ে দিতে হয়। ভুট্টার ফুল ফোটা ও দানা বাঁধার সময় কোনো ক্রমেই জমিতে যাতে জলবদ্ধতা সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। জমিতে আগাছা দেখা দিলে নিড়ানি দিয়ে দমন করতে হবে। ভুট্টার চারা অবস্থায় কাটুই পোকার আক্রমণ হলে হাত দিয়ে তা মেরে ফেলতে হবে। বীজের গুণাগুণ ও খাদ্যমান কমিয়ে দেয়। বিভিন্ন প্রকার ছত্রাক যথা ডিপেস্নাডিয়া মেডিস, ফিউজেরিয়াম মনিলিফরমি প্রভৃতি এ রোগ ঘটায়। আক্রান্ত মোচার খোসা ও দানা বিবর্ণ হয়ে যায়। দানা পুষ্ট হয় না, কুঁচকে অথবা ফেটে যায়। অনেক সময় মোচাতে বিভিন্ন দানার মাঝে বা উপরে ছত্রাকের উপস্থিতি খালি চোখেই দেখা যায়। ভুট্টা গাছে মোচা আসা থেকে পাকা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত বেশি থাকলে এ রোগের আক্রমণ বাড়ে। পোকা বা পাখির আক্রমণে বা কান্ডপচা রোগে গাছ মাটিতে পড়ে গেলে এ রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এ রোগের জীবাণু আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশে বেঁচে থাকে। একই জমিতে বারবার ভুট্টার চাষ করলে এ রোগ দ্রম্নত বিস্তার লাভ করে।