'মাছে-ভাতে বাঙালি' কথাটি প্রকৃত অর্থেই সঠিক, মাছ ও ভাতের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক বহুকালের। প্রাচীনকাল থেকেই মাছ খেতো বাঙালি। আরেকটি প্রধান কারণ হলো বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ, ধান ও মাছ দুই-ই সহজলভ্য। এ জন্যই বাঙালিকে বলা হয় 'মাছে-ভাতে বাঙালি'। সেই নদীর দেশ আর পুকুরভরা মাছের দেশ বাংলাদেশ। এখন প্রায় খাল-বিল-নদী-নালা শূন্য। খাল-বিল ভরাট করে চলছে নানা স্থাপনা তৈরির মহোৎসব। সুতরাং, খাল-বিল না থাকলে মাছ থাকবে কোত্থেকে?।
আন্তর্জাতিক প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএনের গবেষণায় দেখা গেছে, এক সময় দেশের নদনদী ও জলাশয়গুলোতে ২৬৬ প্রজাতির মিঠা ও ঈষৎ লোনা পানির মাছ পাওয়া যেত। এর মধ্যে ৬৬ প্রজাতির কোনো সন্ধান নেই এখন। অবশিষ্ট ২০০ প্রজাতির মধ্যে ৫৪টি বিপন্ন প্রায়। ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের মধ্যে চারটির অবস্থা নাজুক। প্রাকৃতিক ও মানুষের সৃষ্ট কারণে দেশি ছোট মাছ হারিয়ে যাচ্ছে।
নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় এ দেশের সাগর, নদী, খাল-বিলে প্রচুর পরিমাণে মাছে জন্মাত। এর মধ্যে রয়েছে রূপচাঁদা, কোরাল, লাক্ষ্যা, লইট্যা, ছুরি, ফাইস্যা, রুই, কাতল, মৃগেল, ভেটকি, চিতল, বোয়াল, শোল, কৈ, শিং, মাগুরসহ আরও নানা জাতের মাছ। কাজেই তারা ধান চাষ করে ও মাছ ধরে জীবিকা উপার্জনের পথ বেছে নেয়। এ সহজলভ্য মাছ আর ভাত আমাদের প্রিয় খাবার, স্বল্প শ্রম ও ব্যয়ে অতি সহজে এগুলো পাওয়া যায় বলে জীবন ও জীবিকার জন্য এর ওপর নিভর্রশীলতা আমাদের অনেক বেশি। আর ভাতের সঙ্গে যদি ইলিশ মাছ ভাজা হয়, তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই। আর তাই আমাদের মাছে-ভাতে বাঙালি বলা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্প জাতীয় মাছের চাষ ও পোনা অনেক দিন ধরেই উৎপাদন হচ্ছে। দেশের স্বাদু পানির মাছের মধ্যে শিং, মাগুর এবং কই মাছের চাষ অনেক দিনের। উৎপাদনও প্রচুর। আগে শুধু 'থাই কই' চাষ হতো। কয়েক বছর ধরে ভিয়েতনামের কই চাষ হচ্ছে। এগুলো দেখতে আকারে ও রঙে দেশি কইয়ের মতো। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাটা, সরপুঁটি, টেংরা, পাবদা, গুলশা, শোল, মহাশোল, টাকি মাছের চাষ ও পোনা উৎপাদন হচ্ছে। খলশে ও রয়না বা ভেদা মাছেরও স্বল্প পরিসরে পরীক্ষামূলক চাষ শুরু হয়েছে। আরো কিছু নতুন মাছের চাষ চলছে।
আর যেসব নদী অবশিষ্ট রয়েছে, সেগুলোতে দূষণের মাত্রা এত বেশি যে, মাছের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন। আরও কিছু কারণ এই মিঠাপানির মাছ বিলুপ্তির পেছনে কাজ করে। যেমন: জলবায়ুর প্রভাব, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কারেন্ট জালের অবৈধ ব্যবহার, ফসলের জমিতে অপরিকল্পিত কীটনাশক ব্যবহার, জলাশয় দূষণ, নদীর নব্য হ্রাস, উজানে বাঁধ নির্মাণ, নদী সংশ্লিষ্ট খাল ও বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, ডোবা ও জলাশয় ভরাট হওয়া, মা মাছের আবাসস্থলের অভাব, মা মাছের ডিম ছাড়ার আগেই ধরে ফেলা, ডোবা-নালা পুকুর ছেঁকে মাছ ধরা, বিদেশি রাক্ষুসে মাছের চাষ, মাছের প্রজননে ব্যাঘাত ঘটানো এবং খালে, বিলে ও পুকুরে নদীতে বিষাক্ত বর্জ্য ফেলা। কৃষিজমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে এই কীটনাশক বৃষ্টির পানি বা সেচের মাধ্যমে বিল, জলাশয়গুলোতে গিয়ে পড়ে এবং মাছের বেঁচে থাকার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট নানা কারণে আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় মাছগুলো।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ষাটের দশকে আসা তেলাপিয়া দিয়ে তা শুরু হয় মাছ চাষের বিপস্নব। পরে থাই পাঙাশ, ভিয়েতনামের কই, থাই কই, আফ্রিকান মাগুর। এখন বাজারে পাওয়া ৯০ শতাংশ মাছই চাষের মাছ। দেশে বর্তমানে ৪৭৫টি সামুদ্রিক প্রজাতি, ৩৬০টি স্বাদু পানির প্রজাতি, ৩৬টি চিংড়ি প্রজাতির মাছ রয়েছে। বিপন্ন হয়ে যাওয়া ২০ প্রজাতির মাছ কৃত্রিম প্রজননে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখতে মৎস্য খাত ভূমিকা রাখছে। চাষের মাছে উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ও গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখতে মৎস্য খাত ভূমিকা অব্যাহত রেখে চলেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে। বিশ্বের যে তিনটি দেশ মাছ উৎপাদনে সাফল্য দেখিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) 'দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকোয়াকালচার-২০২২' শীর্ষক বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থান অর্জন করেছে। বাংলাদেশের আগে রয়েছে কেবল ভারত ও চীন। ছয় বছর ধরে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে পঞ্চম অবস্থানে ছিল। এ অর্জন অত্যন্ত গৌরব ও সম্মানের। এ ছাড়া এফএওর প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মাছ আহরণে বাংলাদেশ তৃতীয়, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় ক্রাস্টাশিয়ান্স ও ফিনফিশ উৎপাদনে যথাক্রমে ৮ম ও ১১তম স্থান অধিকার করেছে। এ ছাড়া বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম, তেলাপিয়া উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ এবং এশিয়ার তৃতীয় স্থানে রয়েছে।
'মৎস্য মারিব খাইব সুখে' মধ্যযুগের এ শ্লোক আবার ফিরে এসেছে। 'মাছে-ভাতে বাঙালি' চাষের মাধ্যমে মাছের সেই হারানো গৌরব ফিরিয়ে এনেছে। গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখতে মৎস্য খাত ভূমিকা রাখছে। উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ও গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখতে মৎস্য খাত ভূমিকা অব্যাহত রেখে চলেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে। বিশ্বের যে তিনটি দেশ মাছ উৎপাদনে সাফল্য দেখিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ।
বিশ্বের ৫২টি দেশে বাংলাদেশের মাছ রপ্তানি হয়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ৪৭ দশমিক ৫৯ লাখ টন মাছ উৎপাদিত হয়। ২০৪১ সালে মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৫ লাখ টন- যা বর্তমান উৎপাদনের চেয়ে ১ দশমিক ৮ গুণ বেশি। উৎপাদিত মাছ যাতে মানব স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে। মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, বর্তমানে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৪ লাখ নারীসহ এক কোটি ৯৫ লাখ বা ১২ শতাংশের বেশি মানুষ মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। মাছ ও চিংড়িসহ অন্যান্য জলজ সম্পদের স্থায়িত্বশীল উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের পুষ্টিচাহিদা পূরণ এবং রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে উন্মুক্ত জলাশয়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ ক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত সুফলের মাধ্যমে দরিদ্র্য মৎস্যজীবী ও চাষি তথা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের চারটি উৎস রয়েছে। এগুলো হলো- অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়, বদ্ধ জলাশয়, আধালোনা পানির জলাশয় ও সামুদ্রিক জলাশয়।
মুক্ত এলাকার সঙ্গে যুক্ত জলাশয়কে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় বলে। এর মধ্যে রয়েছে নদী ও খাড়ি অঞ্চল, হাওড়, বিল, হ্রদ ও পস্নাবনভূমি। পস্নাবনভূমি বর্ষাকালে পানিতে ভরে নদীর সঙ্গে একাকার হয়ে যায় এবং শুকনো মৌসুমে জমিতে পরিণত হয় এবং তখন সেখানে ফসলের চাষাবাদ করা হয়। বর্তমানে দেশে মোট মুক্ত জলাশয়ের পরিমাণ ৪০ লাখ ৪৭ হাজার ৩১৬ হেক্টর। অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়ের যেসব জলাশয় নদী, হাওড় বা বিলের সঙ্গে যুক্ত নয়, এদের অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয় বলে। অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়ের মধ্যে রয়েছে পুকুর, দীঘি, বাঁওড় ইত্যাদি। বর্তমানে দেশে মোট বদ্ধ জলাশয়ের পরিমাণ ১ লাখ ৫২ হাজার ৩৭৮ হেক্টর। সামুদ্রিক জলাশয়ের একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা ২০০ নটিক্যাল মাইল এবং মহিসোপান ৮৫ হাজার ১৫৩ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।
দেশের দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এটি সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের উৎস। সামুদ্রিক জলাশয়ে আর্টিশনাল ফিশারি ও ট্রলি ফিশারি দিয়ে মাছ ধরা হয়।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে প্রায় ২৬০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ আছে। এ ছাড়া এসব জলাশয়ে আরও ১২ প্রজাতির বিদেশি মাছ ও ২৪ প্রজাতির চিংড়ি মাছ আছে। মাছের প্রজাতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে প্রায় ২৬০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ আছে। এ ছাড়া এসব জলাশয়ে আরও ১২ প্রজাতির বিদেশি মাছ ও ২৪ প্রজাতির চিংড়ি মাছ আছে। সামুদ্রিক এলাকায় রয়েছে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ এবং ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি মাছ। মাছের শ্রেণিবিন্যাস বিভিন্ন রকম হতে পারে।
বর্তমানে দেশের রপ্তানি আয়ের ১ দশমিক ২৪ শতাংশ আসে মৎস্য খাত থেকে। বিশ্বের ৫০টির অধিক দেশে মাছ রপ্তানি হয়। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৮ হাজার ৪২ টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে আয় হয়েছে ৫ হাজার ১৯১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা- যা আগের বছরের তুলনায় ২৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাছ রপ্তানি করে ৪ হাজার ৭৯০ কোটি টাকার বেশি আয় হয়েছে, এই অর্থবছরে প্রায় ৭০ হাজার টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।
এফএও পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম দেশটি হবে বাংলাদেশ। এরপর থাইল্যান্ড, ভারত ও চীনের অস্থান থাকবে।
বর্তমানে বিশ্বে মাছ উৎপাদনে প্রথম দেশ চীন, দ্বিতীয় ভারত আর তৃতীয় দেশ হচ্ছে মিয়ানমার। মৎস্য গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রতিবেশ ব্যবস্থা মিঠাপানির মাছ চাষের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। এখানকার সোয়া দুই লাখ হেক্টর উন্মুক্ত জলাশয় আর গ্রামীণ এলাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা লাখ লাখ পুকুরে মাছ চাষের যে সম্ভাবনা রয়েছে, তা এখনো পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়নি। সরকার যদি মাছ চাষে আরও মনোযোগী হয়, চাষিদের সহায়তা করে, তাহলে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ মাছ উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হতে পারবে।