সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশে কৃষি ও কৃষক জন্ম থেকেই একে অপরের পরিপূরক। বাংলাদেশের ৭০-৮০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষির সঙ্গে খাদ্য জড়িত, আর খাদ্যের সঙ্গে জীবন। এই জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সর্বপ্রথম সনাতন চাষ পদ্ধতি থেকে বের হয়ে প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে খাদ্যশস্য উৎপাদনেও উলেস্নখযোগ্য অগ্রগতি রয়েছে। প্রতি বছর দেশে শূন্য এক শতাংশ হারে কৃষিজমি কমলেও স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেড়েছে চালের উৎপাদন। দেশের কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের বিকাশ মূলত ধান চাষকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। তবে ধানকেন্দ্রিক যান্ত্রিকতা থেকে বের হয়ে আমাদের কৃষি খাতকেই যান্ত্রিকতার আওতায় নিয়ে আসা উচিত।
ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত সব প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কার্যকারিতা ও উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ভূমিকা অপরিসীম। কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ বলতে কেবল কৃষি যন্ত্রপাতি বিকাশের অগ্রগতিকেই বোঝায় না; বরং এটি কৃষির পরিবেশ, কৃষির মান, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার মতো অনেক বিষয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। এটি গতিশীল- যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি যন্ত্রপাতির বিকাশ, উদ্ভাবন ও ব্যবহারের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সঙ্গে প্রধানত ট্রাক্টর ও মেশিনারি সম্পৃক্ত থাকলেও অন্যান্য ইনপুট যেমন উৎপাদন, নির্বাচন, বিতরণ, ব্যবহার, মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও কৃষি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং তাদের পরিচালনায় বীজ, সার, পানি, কৃষি শ্রমিক। জমি প্রস্ততকরণ থেকে শুরু করে ফসল মাড়াই পর্যন্ত সমস্ত প্রক্রিয়াটি যান্ত্রিকীকরণ হলে কৃষকরা আরো বেশি লাভবান হবেন। এর ফলে, সময় ও খরচেরও সাশ্রয় হবে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ফলে ফসলের উৎপাদন খরচ যেমন অনেকাংশে কমে যায় ঠিক তেমনিভাবে ফসলের নিবিড়তাও ৫-২২ ভাগ বেড়ে যায়। বীজ বোনার সময় বীজবপন যন্ত্র ব্যবহার করলে প্রায় ২০ ভাগ বীজ সাশ্রয় হয়। অন্যদিকে, ফসলের উৎপাদনও ১২-৩৪ ভাগ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া যন্ত্রের সাহায্যে ফসল কাটলে ফসলের অপচয় অনেক কম হয়, অথের্র সাশ্রয় হয়। ফলে কৃষকের আয় বৃদ্ধি পায়।
কৃষকদের শ্রম, কৃষি সম্প্রসারণবিদদের তদারকি, কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণা ও সরকারের সদিচ্ছায় কৃষিতে রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচগুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে দশগুণ। আর এভাবেই প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ। কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। মহামারি করোনাকালে ধান উৎপাদনে একধাপ এগিয়ে এখন বিশ্বে তৃতীয়। এ ছাড়াও পাট রপ্তানিতে বিশ্বে আবারো প্রথম বাংলাদেশ। ইলিশ মাছ উৎপাদনে প্রথম, সবজিতে তৃতীয়, মিঠাপানির মাছে তৃতীয়, আম উৎপাদনে বিশ্বে নবম, আলু উৎপাদনে শীর্ষ দশে বাংলাদেশ। বস্ন্যাক বেঙ্গল ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ। আর ছাগলের দুধ উৎপাদনে দ্বিতীয়, পেয়ারা উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম।
খাদ্য উৎপাদনে স্বংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। ধান, গম, ভুট্টা আলু, আম বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগসহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব উদাহরণ। দেশের খোরপোশ কৃষি এখন বাণিজ্যিক কৃষিতে উন্নীত হয়েছে।
বর্তমানে দেশে আমন উৎপাদন হয় দেড় লাখ টন, আউশ হয় ৭০ হাজার টন, বোরো থেকে আসে দুই কোটি ১০ লাখ টন, গম উৎপাদন হয় ১২ লাখ টনের বেশি। এ ছাড়া ভুটা উৎপাদন হয় ৫০ লাখ টনের বেশি। দেশে বছরে সাড়ে চার কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে জলবায়ু সহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবনে শীর্ষে বাংলাদেশ। কেবল উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়, হেক্টরপ্রতি উৎপাদনের দিক থেকেও অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্ব উদাহারণ।
কৃষি আবহমান বাংলার আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও ঐতিহ্যের মূল চালিকাশক্তি। কৃষিকে ঘিরেই মানুষের সভ্যতার জাগরণ শুরু। গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন তথা স্বনিভর্রতা অর্জনে আবহমানকাল ধরে কৃষি খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পুরোটাই জুড়ে ছিল কৃষি। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ১৯৭২-৭৩ সালে রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ৩৪৮.৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার- যার ৯০ ভাগ আসত পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে। পরবর্তী সময়ে শিল্প ও বাণিজসেবা খাতের উলেস্নখযোগ্য বিকাশ ঘটলেও দীর্ঘকাল পর্যন্ত এগুলোও ছিল কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ফলে, কৃষি হয়ে উঠেছে এ দেশের অর্থনীতির মূলভিত্তি। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বিনোদনের অধিকাংশ উপাদান আসে কৃষি থেকে। বিশেষ করে খাদ্য ছাড়া জীবন বাঁচানো যায় না। খাদ্যের একমাত্র উৎস কৃষি। কৃষি উৎপাদনে ও খাদ্য নিরাপত্তায় বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করছে। শুধু তাই নয়, কোভিড-১৯ উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও খাদ্য উৎপাদন অব্যাহত রেখে বিশ্বে বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। মোট দেশজ উৎপাদনের হিসাবে জিডিপিতে এখন কৃষি খাতের অবদান শতকরা ১৩ শতাংশ এবং কর্মসংস্থানে ৪১ শতাংশ। স্বাধীনতার ঠিক পরে ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি ১০ লাখ টন- যা সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। কিন্তু বর্তমানে ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ হিসেবে স্বীকৃত। বর্তমানে প্রতি বছর ধান, গম, ভুট্টা মিলিয়ে তিন কোটি ৮৮ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে আয় হয়েছিল ১১৬ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৬২ কোটি ৩১ লাখ ৮০ হাজার ডলারের। জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান কমলেও অন্যান্য খাতের বিকাশে কৃষি সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। প্রায় সব শিল্পই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এক গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মীপিছু কৃষি জিডিপি এক শতাংশ বাড়লে দারিদ্র্যের প্রকোপ কমে দশমিক ৩৯ শতাংশ। অর্থনীতিতে কৃষিসহ অন্যান্য খাতের প্রবৃদ্ধির গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে- যার ফলশ্রম্নতিতে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা মেয়াদকালে বিদ্যমান ৮২.১ শতাংশ দারিদ্র্যের হার ৮ম পঞ্চবার্ষিকী মেয়াদকালে ২০.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনার এ সফলতায় কৃষির অবদান সবচেয়ে বেশি। জাতিসংঘসহ আর্ন্তজাতিক সংস্থাগুলো কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় সফল অভিযোজনের ফলে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে।