স্বাদে ও গন্ধে অনন্য এক মিষ্টির নাম কাঁচাগোলস্না। বর্তমানে ভারতসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে কাঁচাগোলস্না রপ্তানি হচ্ছে। গত ২০২৩ সালের ৮ আগস্ট শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) থেকে দেশের ১৭তম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই স্বীকৃতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভেজাল কাঁচাগোলস্না উৎপাদন ও বিক্রয় রোধের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে। এতে করে বাড়বে কাঁচাগোলস্নার রপ্তানি, বড় হবে কাঁচাগোলস্নার বাজার, চাঙা হবে স্থানীয় অর্থনীতি এবং সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান।
'চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর, তেমন দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, এতদিন কোথায় ছিলেন? পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে চাওয়া নাটোরের বনলতা সেন।' কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার সেই বনলতার সেনের সঙ্গে দেখা করতে নাটোরে গিয়েছিলাম কিন্তু সময়ের অভাবে তার সঙ্গে দেখা হয়নি, দেখা হয়নি চক্ষু মিলিয়ে উত্তরা গণভবন- তবে জয়কালীবাড়ী মিষ্টির দোকানে গিয়ে কাঁচাগোলস্নার স্বাদ নিতে কিন্তু ভুলিনি।
সত্যি স্বাদে ও গন্ধে অনন্য এক মিষ্টির নাম কাঁচাগোলস্না। এই কাঁচাগোলস্নার ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে জানতে পারি ১৭৬০ সাল ছিল রানি ভবানীর শাসনামল। তিনি এই সময় নাটোর অঞ্চল শাসন করতেন। রানি ভবানী খুব মিষ্টি খেতে পছন্দ করতেন। নাটোর শহরের লালবাজারের মিষ্টি বিক্রেতা মধুসূদন পাল রানির রাজপ্রাসাদে নিয়মিত মিষ্টি সরবরাহ করতেন। একদিন মধুসূদনের দোকানের সব কর্মচারী অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন তার দোকানে মিষ্টি তৈরির জন্য দুই মণ কাঁচা ছানা রাখা ছিল। এই ছানা নষ্ট হয়ে যাবে ভেবে মধুসূদন ছানাগুলোকে চিনি সঙ্গে মিশিয়ে চুলায় জ্বাল করতে থাকেন।
জ্বাল দেয়ার একপর্যায়ে গরম ছানা থেকে এত সুন্দর ঘ্রাণ বের হতে থাকে। মধুসূদনের নাকে সেই ঘ্রাণ আসা মাত্রই তিনি চুলায় জ্বাল করা চিনি মিশ্রিত ছানাগুলো মুখে দিয়ে দেখেন ছানাগুলো অত্যন্ত সুস্বাদু হয়েছে। এমন সময় রানির লোক তার দোকানে মিষ্টি নিতে আসেন। তখন দোকানে অন্য কোনো মিষ্টি না থাকায় তিনি সেই চিনি মিশ্রিত ছানাগুলো রানির কাছে পাঠিয়ে দেন। রানি সেই মিষ্টিগুলো খেয়ে তাকে ডেকে পাঠান এবং নতুন এই মিষ্টির প্রশংসা করে মধুসূদনের কাছে মিষ্টির নাম জানতে চান। তখন পর্যন্ত মধুসূদন এই মিষ্টির কোনো নাম দেয়নি। যেহেতু মিষ্টিগুলো কাঁচা ছানা থেকে তৈরি করা হয়েছিল তাই অনেকটা নিরুপায় হয়ে তিনি তাৎক্ষণিক এই মিষ্টির নাম দেন কাঁচাগোলস্না। সেই থেকে মধুসূদনের দোকানের ছানাগুলোর নাম হয়ে যায় নাটোরের কাঁচাগোলস্না যা আজও স্বাদে অনন্য হয়ে নাটোরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহন করে চলছে। মূলত রানি ভবানীর সময়কাল থেকে নাটোরের কাঁচাগোলস্নার সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়, প্রায় ৬০০ বছরের পুরানো এই কাঁচাগোলস্নার আবিষ্কারক মধুসূদন পাল এক সময় নাটোর শহরের পালপাড়ায় বাস করতেন। লালবাজারের জয়কালীবাড়ী মন্দিরে কাছে জয়কালী মিষ্টান্ন ভান্ডার নামে তার একটি দোকান ছিল। সেই দোকানটি পরিচালনা করতেন প্রভাত পাল। এই প্রভাত পালের পিসি ছিলেন সুভদ্রা পাল। তিনি তার এই পিসির কাছ থেকে কাঁচাগোলস্না তৈরির হাতেখড়ি পান। ধারণা করা হয়, এই সুভদ্রা পাল ছিলেন মধুসূদন পালের বংশধর। আর এই সুভদ্রা পালের বংশধর ছিলেন আজকের লালবাজারের জয়কালী মন্দিরের পাশে অবস্থিত জয়কালীবাড়ী মিষ্টি দোকানের বংশধররা। সশরীরে এই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁচাগোলস্নার স্বাদ নিতে নিতে কথা হয়েছিল দোকানে অবস্থানরত প্রভাত কুমারের সঙ্গে। আলাপচারিতায় জানতে পারি তাদের দোকানটিই এই শহরের সবচাইতে পুরাতন কাঁচাগোলস্নার দোকান।
যে দোকানের মাধ্যমে বিগত পাঁচ প্রজন্ম ধরে তারা নাটোর শহরে কাঁচাগোলস্নার ব্যবসা করে আসছে। তার কাছ থেকে জানতে পারি বর্তমানে ১.০ কেজি কাঁচাগোলস্না তৈরি করতে তাদের প্রায় ১.০ কেজি ছানার প্রয়োজন হয়। বিদেশি গরুর দুধ হলে ১.০ কেজি ছানা তৈরি করতে তাদের বর্তমানে ৬-৭ লিটার দুধের প্রয়োজন হয় এবং দেশি গরুর দুধ হলে ৫-৬ লিটার দুধের প্রয়োজন হয়। এর সঙ্গে আরো প্রয়োজন হয়ে থাকে ৩০০-৪০০ গ্রাম চিনি ও প্রয়োজনমতো এলাচ। যদিও মৌসুমভেদে কাঁচাগোলস্নার উৎপাদন খরচ কিছুটা ওঠানামা করে- তবে সাধারণত ১.০ কেজি কাঁচাগোলস্না তৈরি করতে তাদের উৎপাদন খরচ পড়ে প্রায় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। সে হিসাবে ১.০ কেজি কাঁচাগোলস্না বিক্রি করে তাদের নিট লাভ থাকে ১০০ থেকে ১৫০ টাকার মতো। যদিও ব্যবসায়িক সিক্রেট হওয়ার কারণে প্রভাত কুমার তাদের দোকানের মাসিক কাঁচাগোলস্নার মোট বিক্রির পরিমাণ ও প্রকৃত লাভের পরিমাণ প্রকাশ করেনি।
প্রভাত কুমারের সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, তাদের দোকানের কাঁচাগোলস্নার মূল ক্রেতা হলো জয়কালীবাড়ী মন্দিরে আসা দর্শনার্থীরা। তারা সাধারণত মন্দিরে পুজো দেয়ার জন্য তাদের দোকান থেকে ১-২ পিস করে কাঁচাগোলস্না কিনে পুজোর কাজে ব্যবহার করে থাকে। তিনি বলেন খাঁটি কাঁচাগোলস্নার স্বাদ নিতে হলে অবশ্যই আপনাকে আসতে হবে আমাদের দোকানে। যদিও নাটোর শহরে অন্তত আরো ৪০-৪৫টি দোকানে কাঁচাগোলস্না বিক্রি হয়ে থাকে, তবে জয়কালীবাড়ী মিষ্টির দোকানসহ কুন্ডু মিষ্টান্ন ভান্ডার, অনুকূল দধি ও মিষ্টান্ন ভান্ডার ও মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডারের কাঁচাগোলস্নার মান সবচেয়ে ভালো। বর্তমানে নাটোর শহরে বিদ্যমান এই সব মিষ্টির দোকানে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১.০ কোটি টাকার ওপরে কাঁচাগোলস্না বিক্রি হয়ে থাকে। আর এই কাঁচাগোলস্না কিনতে হলে আপনাকে কেজি প্রতি ৬০০ টাকা গুনতে হবে।