কৃষিতেই চাঙা গ্রামীণ অর্থনীতি 'ধানই বাংলাদেশের প্রাণ'
প্রকাশ | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
আলতাব হোসেন
কৃষিজাত শস্যের মধ্যে ধান এখনকার মতো অতীতেও ছিল বাঙালির প্রধান খাদ্যশস্য। রূপশালী, বাঁশীরাজ, অঞ্জনা, কৃষ্ণচূড়া, পদ্মশাল, রাজাশাইল, দুধকলম, সুন্দরমুখী, তুলসি মালাই, কালো জিরা, বালাম, চামাড়া, আন্ধারমানিক কত শত নামের কত শত ধান যে সুঘ্রাণ ছড়াত প্রাচীন বাংলার বুকে, তার কোনো হিসাব নেই। বলা হয়ে থাকে, এই অঞ্চলে এক লাখের বেশি প্রজাতির ধান ছিল এক সময়। ধানই ছিল বাংলাদেশের প্রাণ। ১০ হাজার বছর আগের মানুষ ধানের ব্যবহার জানত। ভারতের উত্তর প্রদেশের লহুরাদেওয়ার নিকটবর্তী জলাশয়ের তলদেশে মিলেছে সাত হাজার বছরের পুরনো বুনো ধানের খোঁজ। চীন দেশ থেকেই হোক আর ভারত থেকেই হোক, ধান ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে।
মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং অব্যবহিত পরে প্রায় ৭ কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন করতেই হিমশিম খেতে হয়েছে দেশকে। তখন আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হতো। তখন দেশের খাদ্য সংকটকে ইঙ্গিত করে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ একটি 'তলাবিহীন ঝুড়ি' বলে মন্তব্য করেছিলেন। বাংলাদেশ এখন আর খাদ্য সংকটের দেশ নয়। বাংলাদেশ এখন চাল, মাছ, মাংস, ফল, সবজিসহ খাদ্যপণ্য রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে।
এখন দেশের লোকসংখ্যা ১৭ কোটির বেশি, পাশাপাশি প্রতিদিন আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে ২০ শতাংশ করে। এরপরও আমন, আউশ ও বোরো ধানসহ একাধিক ফসলের বাম্পার ফলনে বছরে প্রায় সাড়ে চার কোটি টনের বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। এখনো দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশ কৃষি খাতেই নিযুক্ত। ভবিষ্যতেও এ খাতে শ্রমশক্তির একটি উলেস্নখযোগ্য অংশ যুক্ত থাকবে তা বোঝা যায়। নিঃসন্দেহে দিনবদলের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের কৃষিও বদলে গেছে। শিক্ষিত তরুণারও আজকাল নতুন করে কৃষির দিকে ঝুঁকছেন।
স্বাধীনতার পরপরই বাংলা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে জীবনমানের যে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে, তার পেছনে কাজ করেছে কৃষির আধুনিকায়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, কৃষি উপখাতের বিস্তার, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসার এবং প্রবাসী আয় বৃদ্ধি। দেশে কৃষি উৎপাদন বহুগুণে বেড়েছে, কৃষি শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে পাঁচ থেকে দশগুণ, বিদু্যৎ সংযোগ, সেলফোনের সহজলভ্যতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ বৃদ্ধির ফলে গ্রামীণ জীবনমান বেড়েছে ঈর্ষণীয় মাত্রায়। সর্বোপরি কৃষি ও কৃষির উপখাতে গ্রামাঞ্চলেও নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। গ্রামীণ আয়ের বড় অংশটিই এখন আসছে কৃষি খাত থেকে। দেশের গ্রামাঞ্চল একদিকে বর্ধিষ্ণু শিল্প ও সেবা খাতের কাঁচামাল ও মূল্য সংযোজিত পণ্য ও সেবা সরবরাহ করছে, অন্যদিকে, গ্রামাঞ্চলে মানুষের আয় বৃদ্ধির ফলে নতুন ভোক্তা হিসেবে তারা অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বৃদ্ধিতেও রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এতে খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়।
কৃষিই হচ্ছে বাংলার আদি পেশা। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। দেশের অর্থনৈতিক উত্তরণের ভিত্তি হচ্ছে কৃষি। কৃষি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হওয়ায় দেশের বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রধান পেশা কৃষি এবং বেশিরভাগ মানুষ তাদের জীবিকা ও কর্মসংস্থানের জন্য কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষির বহুমুখীকরণ মৎস্য চাষ, পোল্ট্রি খামার, গরুর খামার, বছরব্যাপী সবজি ও ফলের চাষে দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান হচ্ছে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে জীবনমানের যে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে, তার পেছনে কাজ করেছে কৃষি খাত।
মৌসুমি ফসল ভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতি এখন চাঙা। প্রচলিত কৃষি কাজের বাইরে অর্থাৎ ধান-পাট এসব চাষের বাইরে কৃষির বিভিন্ন উপখাত যেমন, মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগির খামার, পশুপালন, দুগ্ধ খামার, বছরব্যাপী সবজি ও ফলের চাষে ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। এতে যেমন বহু বেকারের কর্ম সংস্থান হয়েছে তেমনি গ্রামীণ অর্থনীতিও বেশ চাঙা হয়ে ওঠেছে। হাওড় অঞ্চলসহ দেশের অন্যান্য এলাকায় কৃষকের গোলায় সোনা রঙা বোরো ধান গড়াগড়ি খাচ্ছে। কৃষকের মুখে হাসি-খুশি। এই ধান বেচে স্ত্রীর জন্য শাড়ি আর সন্তানদের জন্য নতুন জামা কাপড় ওঠবে গায়ে। ধান বেচার টাকায় টিনের ঘরের জায়গায় পাকা ঘর উঠবে। মিলবে ভালো খাবার। আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে বেড়ানোও হবে এই সময়ে। নিজের খুরাকি রেখে ধান বিক্রি করে মহাজনের ঋণ পরিশোধ করবেন অনেকে। কেউ কেউ বছরব্যাপী মুদি দোকানের দেনা মিঠাবেন। আবার কেউবা এনজিও ঋণের টাকা শোধ করবেন। ধানের মৌসুমে ছেলেমেয়েদের বিয়ের ধুম পড়বে এখন। হাটে বাড়বে বেচাকেনা। কেউ ছেলের জন্য মোটর সাইকেল, বাসার জন্য ফ্রিজ, টিভিসহ ঘরের আসবাবপত্র কিনবেন। ধান হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। এক সময়ের 'তলাবিহীন ঝুড়ি' থেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের রোলমডেল হয়ে ওঠাটা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, গত এক দশকে গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে তা সত্যিই অতুলনীয়।
ধান উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় বাংলাদেশ। এ ছাড়াও পাট রপ্তানিতে বিশ্বে প্রথম বাংলাদেশ। ইলিশ মাছ উৎপাদনে প্রথম বাংলাদেশ। সবজিতে তৃতীয়, মিঠাপানির মাছে তৃতীয়, আম উৎপাদনে বিশ্বে নবম বাংলাদেশ। আলু উৎপাদনে শীর্ষ দশে বাংলাদেশ। বস্ন্যাক বেঙ্গল ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ। আর ছাগলের দুধ উৎপাদনে দ্বিতীয়, পেয়ারা উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম, কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয় এবং জলবায়ু সহিষ্ণুু ফসলের জাত উদ্ভাবনে শীর্ষে বাংলাদেশ। কেবল উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়, হেক্টরপ্রতি উৎপাদনের দিক থেকেও অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্ব উদাহারণ।
কেবল উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়, হেক্টর প্রতি ধান উৎপাদনের দিক থেকেও অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। বাংলার কৃষকরা এখানেই থেমে যাননি। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের জন্য উদাহরণ। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের যেসব দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়তে পারে, তারমধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সফলতাও বাড়ছে। ১৯৭২ সাল থেকে দেশি জাতকে উন্নত করে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা উচ্চফলনশীল (উফশী) জাত উদ্ভাবনের পথে যাত্রা করেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ১১৭টি উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এরমধ্যে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা ১০২টি উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা সংস্থা-বিনার বিজ্ঞানীরা লবণসহিষ্ণুু খরাসহিষ্ণু ও বন্যাসহিষুষ্ণ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা।
জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। এক সময় দেশের মধ্য ও উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোরেই কেবল সবজির চাষ হতো। এখন দেশের প্রায় সব এলাকায় সারা বছরই সবজির চাষ হচ্ছে। দেশে সবজির উৎপাদন যেমন বেড়েছে, ভোগও তেমনি বেড়েছে। দেশে মাথাপিছু সবজির ভোগ বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। পাশাপাশি সবজি রপ্তানি করেও মিলছে বৈদেশিক মুদ্রা।
এক সময় 'মাছে-ভাতে বাঙালি' কথাটি বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা বাস্তব। মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। এফএও পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৫ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্বে মোট আম উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়। ফলটির উৎপাদনে শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। প্রায় সাড়ে নয় লাখ টন আম উৎপাদনের মাধ্যমে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ মূল্যায়নে বলা হয়েছে। আলু উৎপাদন সাফল্যের এক বিস্ময়। এক দশক আগেও উৎপাদন ছিল অর্ধলাখ টনের নিচে। বর্তমানে দেশে দেড় কোটি টন আলু উৎপাদন হচ্ছে। আলু বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকায় বিশ্বে কৃষিতে ১১ খাতে সেরা বাংলাদেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) স্বীকৃতি দিয়েছে। যা বাংলাদেশের জন্য বিশাল এক অর্জন এবং খাদ্য নিরাপত্তায় মাইলফলক বলে উলেস্নখ করেছেন বিশিষ্টজনরা। কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধরে রাখা, চালসহ কৃষিপণ্য, প্রক্রিয়াজাত মাছ-মাংস রপ্তানিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একের পর এক স্বীকৃতি পাচ্ছে বাংলাদেশ।
গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য নীতিনির্ধারকরা বিশেষ মনোযোগ দিয়েছেন কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ও আধুনিকায়নে। শিক্ষিত তরুণারও তাই আজকাল নতুন করে কৃষির দিকে ঝুঁকছেন। কৃষি গবেষণায় বেশি বেশি নীতি সমর্থন থাকায় নতুন নতুন জাতের ধান, গম, ভুট্টা ও সবজির উৎপাদন বেড়েছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য প্রতিকূলসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এ ছাড়াও বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিংকসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেন আমাদের কৃষি গবেষকরা। এর বাইরে পাটের কয়েকটি নতুন জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি পাটের জীবনরহস্যও উন্মোচন করেছে বাংলাদেশ পাট গবেষণা প্রতিষ্ঠান। কৃষিতে এমন বিপস্নবের ফল হিসেবেই ১৯৭২-এর তুলনায় আজ আমাদের উৎপাদন ২৫ গুণেরও বেশি। সরকারের যুগোপযোগী পরিকল্পনা, পরিশ্রমী কৃষক, মেধাবী কৃষিবিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণ কর্মীদের পাশাপাশি ব্যক্তি খাত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ প্রয়াসেই এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে।
ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশের কথা আসলে প্রথমেই আসে খাদ্য নিরাপত্তার কথা। আর খাদ্যশস্য বলতে আমরা ধানকেই বুঝে থাকি। ধান এ দেশের মানুষের জীবনাচরণ, খাদ্যাভ্যাস ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। খাদ্য নিরাপত্তা বলতে চাল বা ভাতের নিরাপত্তাকে বুঝায়। মানুষের ক্যালরির চাহিদার সিংহভাগ আসে ভাত থেকে। দেশে বছরে মাথাপিছু চালের চাহিদা ১৩৪ কেজি। এছাড়া চাল থেকে তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাবার রয়েছে- যা বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণের দৈনিক ক্যালরির চাহিদা পূরণ করে। তাই বিনা দ্বিধায় বলা যায় ধানই বাংলাদেশের প্রাণ। উত্তরাঞ্চলের বিশেষ সময়ের খাদ্যাভাব বা মঙ্গা নিরসনে ব্রি ধান-৩৩, আগাম আলু-মুগ-ব্রি ধান-৪৮ অধিক লাভজনক ধানভিত্তিক চাষাবাদ প্রযুক্তি- যা অনুসরণ করে ওই এলাকার কৃষকরা মঙ্গা চিরতরে দূর করতে সক্ষম হয়েছেন কৃষকরা। গত দুই দশকের তথ্য বিশেষণ করে দেখা যায়, ধানের ফলন ও উৎপাদন ক্রমাগত বাড়ছে- যা যথাক্রমে হেক্টরে বার্ষিক ৭ টন থেকে এখন হেক্টরে ৯ টন উৎপাদন হচ্ছে।
বর্ষা মৌসুমে গ্রামের মাঠঘাট ছিল ধান ও পাটের সমারোহ। সে সময় পাটের চাহিদাও উৎপাদন ছিল ব্যাপক। অনুকূল পরিবেশ, বিশেষ করে স্বচ্ছ ও অথৈই পানি এবং সস্তা শ্রমিকের কারণে পাট উৎপাদন, কর্তন, জাগ দেওয়া, পাটখড়ি থেকে পাটকে পৃথককরণ, পাট ধোয়া এবং বাঁশের ওপর পাট শুকানো ছিল গ্রামীণ বর্ষার অন্যতম চিত্র। সে সময়ে ধান ও পাট পৃথক জমিতে উৎপাদন করা হলেও কোনো কোনো কৃষক আউশ ধানের সঙ্গে পাট একত্রে ফলাতেন। খরিপ মৌসুমে আউশ ও আমন ধান ছিল কৃষকের প্রধান ফসল। অগ্রহায়ণ মাস ছিল ধান কাটার মৌসুম। ধান কাটার সময় ধানের খড় ও নাড়ার নিচে যে ধান ঝরে যেত তা গ্রামের হতদরিদ্র মানুষ ঝাড়ু দিয়ে সে ধান সংগ্রহ করত। এ ছাড়া ধানী জমিতে প্রচুর ইঁদুরের গর্ত থাকত। ইঁদুর সাধারণত ধান কেটে গর্তে নিয়ে রাখত। গ্রামের গরিব মানুষ বিশেষ করে শিশু ও মহিলারা গর্ত থেকে সেই ধান সংগ্রহ করে বছরের খাদ্য চাহিদার কিছুটা পূরণ করত। শীতকালে গ্রামের পরিবেশ ছিল উৎসব মুখরও কর্মচঞ্চলে ভরপুর। একদিকে নতুন ধানের আগমন; অপরদিকে, বিভিন্ন শস্যের জন্য জমি তৈরির প্রস্তুতি। নবান্নের বিশেষত্ব এই জন্য যে নতুন ধানের আগমনে কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের সদস্যের জন্য পর্যাপ্ত আহারের ব্যবস্থা সেই সঙ্গে নতুন চালের গুঁড়া দিয়ে হরেক রকম পিঠা ও মিষ্টান্ন তৈরির ধুম। নবান্ন হলে হরেক রকম পিঠাপুলি, মিষ্টান্ন, জালার জাউ তৈরি হতো। এক বা দুই সিদ্ধ ঢেঁকিছাটা পুষ্টিসমৃদ্ধ লাল চালই ছিল মানুষের প্রাত্যহিক খাবার।