রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

গুড়মাখা লালচে সুস্বাদু কটকটি হারিয়ে যাচ্ছে

মজুন সরকার
  ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
গুড়মাখা লালচে সুস্বাদু কটকটি হারিয়ে যাচ্ছে

চারকোনা বিস্কুট আকৃতির শুকনো মিষ্টিজাতীয় গুড়মাখা লালচে সুস্বাদু এক খাবারের নাম কটকটি। যার উৎপাদক উনিশ শতকের দিকে বগুড়া জেলার সদর উপজেলা পগাকুল ইউনিয়নের পলাশবাড়ী উত্তরপাড়া গ্রামের জয়নাল আলী মন্ডল, ভোলা মন্ডল ও গেদা মন্ডলের হাতে বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। তারা জীবিকার তাগিদে নিজ বাড়িতে খুব সাধারণভাবে গমের আটা দিয়ে কটকটি বানিয়ে পাশের মহাস্থান, শিবগঞ্জ, মোকামতলার বিভিন্ন হাটে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন। সারাদেশের মেলা ও অনুষ্ঠানে কটকটি ছিল গ্রামীণ শিশুদের খুব প্রিয় খাবার। এখন সেই সুস্বাদু কটকটি হারিয়ে যাচ্ছে। এতে দিন দিন কমছে গুড় উৎপাদনের আখ চাষও।

জনশ্রম্নতি রয়েছে, হযরত শাহ্‌ সুলতান বলখী (রহ.) মাহী সওয়ারের মাজারের তবারক হিসেবে প্রথম আটার তৈরি এই কটকটি ব্যবহার করা হয়। এরপর থেকে মাজার জিয়ারতে আসা দর্শনার্থীদের মাধ্যমে এ খাবারের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে- যা আজ মহাস্থানগড়ের একটি ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠেছে। প্রায় ২০০ বছরের পুরনো এই কটকটিকে ঘিরে মহাস্থানগড়ের চারপাশে বর্তমানে গড়ে উঠেছে কটকটির এক বিশাল বাজার। বর্তমানে মহাস্থানগড়ে প্রায় ২৫টি ছোট-বড় দোকানে প্রতিদিন প্রায় ১০০ মণের মতো কটকটি বিক্রি হয়ে থাকে, তবে পর্যটন মৌসুমে এসব দোকান থেকে গড়ে প্রতিদিন ১৫০-২০০ মণ কটকটি বিক্রি হয়। এছাড়া এসব দোকান ছাড়াও শুক্রবার দর্শনার্থীর ভিড়ের কারণে মহাস্থানগড়ের উপরে ও নিচে প্রায় ১০০টির মতো অস্থায়ী কটকটির দোকান বসে। বর্তমানে তিন ধরনের কটকটি বিক্রি হয়ে থাকে। স্বাদ ও মানভেদে প্রতি কেজি কটকটির দাম গড়ে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রতি মণ কটকটির দাম গড়ে ৪,০০০-১২,০০০ টাকা পড়ে থাকে। প্রতিদিন মহাস্থানগড়ে গড়ে ৪-৬ লাখ টাকার কটকটি বেচাবিক্রি হয়ে থাকে। তবে বছরের সবচেয়ে বেশি কটকটি বিক্রি হয়ে থাকে বৈশাখ মাসের শেষ বৃহস্পতিবার মহাস্থানগড়ে দিনব্যাপী আয়োজিত মেলার দিনে।

বিখ্যাত সেই কটকটির খোঁজে গত ২১ আগস্ট ২০২৪ গিয়েছিলাম বাংলার প্রাচীন রাজধানী মহাস্থানগড়ে। কথা হয় মহাস্থানগড়ে অবস্থিত কটকটির সবচেয়ে পুরনো দোকান লাল মিয়া কটকটি ঘরের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ লাল মিয়া প্রামাণিকের ছাট্ট ছেলে শাহ আলম প্রামাণিকের সঙ্গে এবং দোকানে বসে স্বাদ নেয়া হয় মচমচে সুস্বাদু এই খাবারটির। তার কাছ থেকে জানা যায়, তার বাবা মাত্র ১২ বছর বয়সে তার দাদার হাত ধরে মহাস্থানগড়ে কটকটি ব্যবসায় আসেন। শুরুতে গড় এলাকায় তিনি ফেরি করে কটকটি বিক্রি করতেন। পরবর্তী সময়ে এই গড়ের নিচেই স্থায়ী দোকান করে কটকটি বিক্রি শুরু করেন। বর্তমানে হযরত শাহ্‌ সুলতান বলখী (রহ.) মাহী সওয়ারের মাজারের ঢোকার মুখেই তাদের বিশাল শো রুম রয়েছে; যেখান থেকে স্থানীয়ভাবে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কটকটি সরবরাহ করে থাকেন। কটকটির ইতিহাস জানাতে গিয়ে শাহ আলম প্রামাণিক বলেন, তার বাবা লালমিয়ার দাদা জোহর মাহমুদ এবং বাবা মোহাম্মদ আলী প্রামাণিক প্রায় ১০০ বছর ধরে এই মহাস্থানে কটকটির ব্যবসা করেছেন। প্রায় ৭০ বছর ধরে তার বাবা এ ব্যবসার সঙ্গে রয়েছে। সেই হিসাবে মহাস্থানগড়ের কটকটির ইতিহাস কমপক্ষে ১৭০ বছরের পুরনো। বর্তমানে মহাস্থানগড়ের কটকটির বড় দোকানগুলোর মধ্যে লাল মিয়া কটকটি ঘর, নাসির কটকটি প্যালেস, হামু মামা কটকটি প্যালেস, সুলতান কটকটি প্যালেস, চায়না কটকটি ঘর, আলাউদ্দিন কটকটি ভান্ডার, জিন্নাহ কটকটি ভান্ডার, ফাতেমা কটকটি প্যালেস, আল আমিন কটকটি প্যালেস, লায়েব কটকটি ভান্ডার, শাহাদত কটকটি ভান্ডার ইত্যাদি প্রমুখ।

বর্তমানে দেশব্যাপী কটকটির বেশ চাহিদা রয়েছে। যথাযথ নজরদারি ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বগুড়ার দইয়ের মতো মহাস্থানগড়ের কটকটিরও সুনামও দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে। দেশের বাহিরে রপ্তানি করতে এবং এর গুণাগুণ ও সুনাম ধরে রাখার জন্য এই পণ্যটিও বিএসটিআই সনদ প্রাপ্তি এবং ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বর্তমানে এই পণ্যটির ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে এখনি সময় কটকটিকে একটি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) বরাবর আবেদন করার।

এ ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। পাশাপাশি শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) কে তরিৎকর্মা হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। এই পণ্যটি জিআই স্বীকৃতি পেলে একদিকে যেমন এই পণ্যটির বিক্রি বাড়বে, পণ্য ভেজাল রোধে ও নিজস্ব ব্র্যান্ডিং তৈরিতে গুরুত্ব রাখবে; অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাবে। যা এই পণ্যটি দেশের বাজারে এবং বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

লেখক: মজুন সরকার, ব্যবস্থাপক, পিকেএসএফ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে