আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহারে কৃষিতে এসেছে বৈপস্নবিক পরিবর্তন
প্রকাশ | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
আলতাব হোসেন
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন হালের বলদ, লাঙল-জোয়ালই ছিল কৃষকের মূল ভরসা। সারাদিন কায়িক শ্রমের বিনিময়ে মাঠে ফলতো স্বপ্নের ফসল। আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় সেদিন আর নেই। নতুন নতুন যন্ত্রপাতির ব্যবহারে দেশের কৃষি খাতে এসেছে বৈপস্নবিক পরিবর্তন। এসব যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে কৃষকের কমেছে শ্রম ও খরচ, অপরদিকে, কয়েকগুণ বেড়েছে উৎপাদন। আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহারে কৃষিতে এসেছে বৈপস্নবিক পরিবর্তন। বর্তমানে অত্যধিক জনসংখ্যার বিপরীতে সীমিত কৃষিজমিতে চাহিদা অনুযায়ী ব্যয় কমিয়ে উৎপাদন বাড়াতে হলে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের কোনো বিকল্প নেই।
কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহারে খুশি চাষিরা। চারা রোপণ থেকে শুরু করে ফসল কাটার ক্ষেত্রেও ব্যবহার হচ্ছে আধুনিক যন্ত্রের। পুরনো ধারণা থেকে বেরিয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারে বদলে যাচ্ছে কৃষকের জীবনমান। ফলে কমে আসছে খরচ, সেইসঙ্গে শ্রমিক সংকট যেমন দূর হচ্ছে তেমনি বাড়ছে ফসলের উৎপাদনও। কৃষিতে আধুনিকায়নে আশাবাদী কৃষকরা। কৃষি ক্ষেত্রের স্থায়ী উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো কৃষিতে ব্যবহৃত সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি। এর সাহায্যে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, ফসলের ক্ষতির পরিমাণ কমে এবং কৃষিক্ষেত্রে খরচ হ্রাস পায়। কৃষিতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম প্রাকৃতিক সম্পদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে এবং কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ক্ষেত্রের ব্যয় হ্রাস করে। ফসলের মৌসুমে যেমন সম্পূর্ণ যান্ত্রিকীকরণের ব্যবস্থা থাকতে হবে তেমনি প্রয়োজন শস্য সংগ্রহোত্তর পরবর্তী ব্যবস্থাপনা ও বাজার ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠু তদারকি। বীজের স্বাস্থ্য রক্ষা থেকে শুরু করে ভোক্তার হাতে শস্য পৌঁছার আগ পর্যন্ত থাকতে হবে কৃষি যন্ত্রাংশের পর্যাপ্ত জোগান ও সুনির্দিষ্ট ব্যবহার। একমাত্র কৃষিক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণ নিশ্চিত করতে পারে কম সময়ে, কম খরচে, কম লোকবলের মাধ্যমে সঠিক সময়ে সঠিক শস্যের যথার্থ জোগান মিলে।
বাংলাদেশের আয়তন ১৪.৮৬ মিলিয়ন হেক্টর- যার প্রায় ৮.৫২ মিলিয়ন হেক্টর জমি চাষাবাদে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ১৩ শতাংশ আসে কৃষি খাত থেকে। ধান, গম ও ভুট্টা এ দেশের উলেস্নখযোগ্য খাদ্যশস্য। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৮ সালের তথ্য অনুসারে প্রধান খাদ্যশস্য ধানের উৎপাদন প্রায় ৫৩.৬ মিলিয়ন টন। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর কৃষি যন্ত্রপাতির ওপর আরোপিত শর্তগুলো শিথিল করলে দেশে পাওয়ার টিলার আমদানি বেড়ে যায়। এভাবে দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সূত্রপাত হয়। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে জমি চাষের পর বীজবপন, গুটি ইউরিয়া সার প্রয়োগ, শস্য কর্তন, শস্য মাড়াই, শস্য ঝাড়াইসহ অন্যান্য কার্যাবলিতেও কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাই যান্ত্রিকীকরণের বহুবিধ সুবিধাদির ফলে কৃষক দিন দিন কৃষিযন্ত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে কৃষকদের ফসল উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা ফসল থেকে আরেকটা ফসল লাগানোর মধ্যবর্তী সময় কমে যাওয়ায় কৃষকরা বছরে বর্তমানে দুটি ফসলের স্থলে তিনটি ফসল পর্যন্ত অনায়াসে চাষ করতে পারছে। এমনকি সুনির্দিষ্ট শস্য বিন্যাস ও স্বল্পকালীন ফসল নির্বাচন করে যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে কোনো কোনো এলাকায় বছরে চারটি ফসল পর্যন্ত করা সম্ভব হচ্ছে। বর্তমানে দেশে জমি তৈরির ৯৫ শতাংশ কাজ পাওয়ার টিলার বা ট্রাক্টর দিয়ে করা হচ্ছে। সার প্রয়োগ ও আগাছা দমনের কাজে যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছে এবং দ্রম্নত সম্প্রসারিত হচ্ছে। এরই মধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিপর্যায়ে ভাড়ার ভিত্তিতে ফসল কাটার যন্ত্র রিপার/কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার শুরু হয়েছে। এছাড়া মাড়াই কাজে বিশেষ করে ধান, গম, ভুট্টাসহ সব দানাদার ফসল মাড়াইয়ের কাজে প্রায় ৯৫ শতাংশ যন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রধান ফসল ধান- যা সম্পূর্ণভাবেই পানি ও ইউরিয়া সারের ওপর নিভর্রশীল। আগাছা ফসলের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর- যা ফসলে প্রয়োগকৃত সারের অনেকাংশই শুষে নেয়। ফলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। তাই, সার প্রয়োগের পূর্বে আগাছা দমনও জরুরি, কিন্তু আলাদাভাবে আগাছা দমন এবং সার প্রয়োগে সময় ও শ্রম দুটোই অপচয় হয়। সাধারণ ইউরিয়ার পরিবর্তে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করলে ১৫-২০ শতাংশ বেশি ফসল পাওয়া যায়। গুটি ইউরিয়া পরিমাণে শতকরা ৩০ শতাংশ কম লাগে। মৌসুমে একবার গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করলেই হয়। তাই এর জন্য এমন যন্ত্র প্রয়োজন যা একই সঙ্গে দুটো কাজই সহজে, স্বল্প সময়ে ও অল্প খরচে করতে সক্ষম। তাই অদূরভবিষ্যতে সারের অপচয় কমাতে উইডার-কাম-গুটি-ইউরিয়া এপিকেটর ব্যবহারের বিকল্প নেই।
পাট বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। বাংলাদেশের জলবায়ু পাট চাষের জন্য এতই উপযোগী যে, পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানের পাট বাংলাদেশে উৎপন্ন হয়। তবে পাট চাষের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখনো সনাতন পদ্ধতি প্রচলিত। প্রাচীনকাল থেকেই সাধারণত পাটবীজ ছিটিয়ে বপন করা হয়। ফলে একদিকে যেমন চারার ঘনত্ব বেড়ে যায়, তেমনি বীজের পরিমাণও বেশি লাগে। তাই কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সারিতে বীজবপন করি তবে শ্রম ও ব্যয় দুটোই কমে যাবে। এতে জমির সর্বত্র গাছের বিস্তৃতি সমভাবে থাকে এবং পরিচর্যার সুবিধা হয়। সারিতে বপন করা হলে বীজের পরিমাণ কম লাগে এবং গজায়ও ভালো। সারিতে বীজবপন করার জন্য বীজবপন যন্ত্র বা সিডার ব্যবহার অতন্ত লাভজনক।
বিশ্বের অনেক উন্নত রাষ্ট্রে এখন আধুনিক কৃষি ও খামার ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃষি যন্ত্রপাতিতে এখন সংযোজিত হচ্ছে মনিটরিং ও পর্যবেক্ষণের বিভিন্ন ধরনের সেন্সর প্রযুক্তি। পাশাপাশি মাটির পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ জানা, জমিতে প্রয়োজনীয় পানির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, পোকামাকড় ও বালাই ব্যবস্থাপনা, সার ও কীটনাশকের প্রয়োজনীয় ও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের সেন্সর প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে জিপিএস ও জিআইএস ট্র্যাকিং পদ্ধতির বদৌলতে। কৃষক এখন ঘরে বসেই জানতে পারছে কখন মাঠের কোন অংশে সেচ দরকার, কোন উদ্ভিদে পোকার আক্রমণ ঘটেছে, কোন ফলটি উত্তোলন উপযোগী, কোন গাভী কতটুকু দুধ দিচ্ছে, কখন দিতে হবে মাছকে খাবার ইত্যাদিসহ নানা তথ্য। মোবাইল ফোনে অ্যাপের ব্যবহার সহজলভ্য হওয়ায় কৃষকের কাজ হয়েছে আরো সহজ। যন্ত্রে সঠিক নির্দেশনা দিয়ে দিলে যন্ত্র নিজেই ভূমি কর্ষণ করে দিচ্ছে পর্যাপ্ত গভীরতায়, গাছ লাগানো হচ্ছে নির্দিষ্ট দূরত্বে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে যন্ত্র গাছ থেকে ছিঁড়ে আনছে ফল, রেখে দিচ্ছে সঠিক জায়গায়, আক্রান্ত ফসল তুলে ফেলে দিচ্ছে বাইরে। বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও কৃষি বিপণনের জন্য এসব প্রযুক্তির ব্যবহার দরকার।
এছাড়া উৎপাদিত খাদ্যের গুণগত মান নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বর্তমানে অধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন খাদ্য ও ফলের পুষ্টিমান, উপাদান, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অবস্থা, উৎপাদিত ফসল ও ফলের আকার, আকৃতি, রঙের তারতম্য ও বাহ্যিক আঘাত বা ক্ষত নির্ণয় করা যায়। বর্ণালিবীক্ষণ যন্ত্র, ধ্বনিতরঙ্গ, তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের সঠিক ব্যবহার দ্বারা অতি অল্প সময়েই ফলের মিষ্টতা, পানি ও চিনির পরিমাণ, খুঁত, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ আকৃতি ইত্যাদি নির্ণয়ের মাধ্যমে গুণগত ও পরিমাণগত বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়। প্রয়োজনীয় ও সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা, বিপণন ও রপ্তানির ক্ষেত্রে গুণগত মান নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আইওটি ও অধ্বংসাত্মক পদ্ধতির যথোপযোগী ও কার্যকর ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া উন্নত বিশ্বে কৃষিতে ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে। কীটনাশক ছিটানো থেকে শুরু করে খামার বা জমির ম্যাপিং, অবস্থা, গোটা দেশের ফসলের অবস্থা নিরূপণ ও খামার পরিচালনা পর্যবেক্ষণের জন্য ড্রোনের ব্যবহার অভাবনীয়ভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে ড্রোনের ব্যবহার এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।
রাইস ট্রান্সপস্নান্টার (জরপব ঞৎধহংঢ়ষধহঃবৎ) একটি ইংরেজি শব্দ। এই শব্দটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা শব্দের সঙ্গে মিশে এখন অনেকটাই বাংলার কৃষকের কাছে পরিচিত। এই যন্ত্রটি ধানের চারা রোপণ পদ্ধতিতে এনেছে আমুল পরিবর্তন। ধানের চারা রোপণ মৌসুমে শ্রমিক সংকট বৃদ্ধি, ফসলের মধ্যবর্তী সময় হ্রাস, দ্রম্নত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন এবং কৃষকের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয় হচ্ছে এই যন্ত্রটি।
তাছাড়া একজন কৃষক প্রথাগত পদ্ধতিতে যেখানে ঘণ্টায় প্রায় এক শতক জমিতে চারা রোপণ করতে পারে সেখানে একটি চার সারি বিশিষ্ট রাইস ট্রান্সপস্নান্টার যন্ত্র দিয়ে ঘণ্টায় প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতক এবং ৬ সারি বিশিষ্ট যন্ত্র দিয়ে ঘণ্টায় প্রায় ৪৫-৫০ শতক জমিতে চারা রোপণ করতে পারে। ফলে, কৃষকের খরচ আর সময় দুটোই বাঁচায় চারা রোপণের আধুনিক এই যন্ত্রটি। রাইস ট্রান্সপস্নান্টারে রোপণে চারা থেকে চারা ও সারি থেকে সারির দূরত্ব ঠিক রাখা যায় এবং অল্প বয়সের চারা রোপণ করা যায়- যা ফলন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া সারিতে লাগানো ধানের জমিতে পরিচর্যা করা সহজ হয়। কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতিতে বীজতলায় উৎপাদিত ধানের চারা এই যন্ত্রের মাধ্যমে রোপণ করা যায় না। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে কার্যকর রোপণের পূর্বশর্ত হলো সঠিকভাবে মেশিনের উপযোগী ধানের চারা উৎপাদন।
এই যন্ত্রের মাধ্যমে ধানের চারা রোপণের জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে ট্রে বা পলিথিনে চারা উৎপাদন করতে হয়। পলিথিন বা ট্রেতে উৎপাদিত এই চারা 'ম্যাট টাইপ' চারা হিসেবে পরিচিত। এই চারা সংগ্রহ এবং রোপণের সময় চারার শিকড়ের ক্ষতি হয় না। ট্রে ব্যবহার করে চারা উৎপাদনের জন্য চাষের জমির প্রয়োজন পড়ে না। বাড়ির আঙিনা, উঠুন বা মাচায় চারা উৎপাদন করা যায়। এমনকি ট্রেতে উৎপাদিত চারা সহজেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়া যায়। তাই বন্যা কিংবা অন্য যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগেও চারা উৎপাদনে কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। ট্রে অথবা পলিথিনের ওপর উৎপাদিত চারা আমন মৌসুমে ১৫-১৮ দিন এবং বোরো মৌসুমে ২৫-৩০ দিন বয়সে রোপণ করা যায়। যে কারণে ধানের জীবনকাল মাঠে বেশি দিন দীর্ঘায়িত হয়। ফলে ধানের গোছায় বেশিসংখ্যক কার্যকরী কুশি উৎপন্ন হয়। চারার উচ্চতা, ঘনত্ব এবং ট্রে বা পলিথিনের উপর মাটির পুরুত্ব ম্যাট টাইপ চারা উৎপাদনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পস্নাষ্টিকের রিজিড, ফ্লেক্সিবল ট্রে অথবা পলিথিনের উপর ম্যাট টাইপ চারা তৈরি করতে হয়। ঝুরঝুরে দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি ম্যাট টাইপ চারা তৈরির জন্য উপযোগী। প্রয়োজনমতো জৈব সার মাটির সঙ্গে মিশ্রণ করা যেতে পারে। ট্রে অথবা পলিথিনের উপর পৌনে এক ইঞ্চি (০.৭৫ ইঞ্চি) গভীরতায় ঝুরঝুরে মাটি ছড়িয়ে দিতে হবে। ছড়িয়ে দেয়া মাটির উপর ধানের জাত এবং অঙ্কুরোদগমের হার অনুযায়ী ১২০ থেকে ১৪০ গ্রাম পরিমাণ বীজ প্রতি ট্রেতে সমঘনত্বে ছিটিয়ে দিতে হবে। চিকন ও লম্বা ধানের ক্ষেত্রে ১২০, মাঝারি ধানের ক্ষেত্রে ১৩০ এবং মোটা ও খাটো ধানের ক্ষেত্রে ১৪০ গ্রাম বীজবপন করতে হবে। একটি ট্রের ক্ষেত্রফল পৌনে দুই বর্গ ফুট (১.৭৫ বর্গফুট)। পলিথিনে বীজ বপনের ক্ষেত্রে ১.০ বর্গফুট জায়গায় চিকন ও লম্বা ধানের ক্ষেত্রে ৭০, মাঝারি ধানের ক্ষেত্রে ৭৫ এবং মোটা ও খাটো ধানের ক্ষেত্রে ৮০ গ্রাম হিসেবে বীজবপন করতে হবে। চারা তৈরির জন্য ব্যবহৃত বীজ ধানের অঙ্কুরোদগমের হার ৯০ ভাগ বা আরো বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয়।
বোরো মৌসুমে ম্যাট টাইপ চারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে কিছু ধাপ অনুসরণ করলে ভালো এবং সুস্থ মানের চারা উৎপাদন করা সম্ভব। ধাপসমূহ হলো- রোপণের পরিকল্পনা অনুযায়ী পলিথিনে অথবা রিজিড, ফ্লেক্সিবল পস্নাস্টিক ট্রে'তে চারা তৈরি করতে হবে, বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা ৯০ ভাগের কম হলে প্রয়োজনমতো অতিরিক্ত বীজ ট্রেতে বপন করতে হবে, পানি দিয়ে বীজ ভিজানোর সময় পানির উপর ভাসমান চিটা ধান আলাদা করে নিতে হবে। বীজ শোধন করার জন্য অ্যাজোক্সিট্রবিন অথবা পাইরাক্লোস্ট্রবিন গ্রম্নপের ছত্রাকনাশক যেমন: এমিস্টারটপ অথবা সেলটিমা (প্রতি কেজি বীজের জন্য ২-৩ মিলি লিটার) দিয়ে ১৮-২০ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে।
এরপর পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে জাগ দিতে হবে। বীজ শোধন করলে ফসলে বীজবাহিত ছত্রাক রোগ, যেমন বাকানি, লিফস্পট, ব্রাউন স্পট, ফল্সম্মাট ইত্যাদি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ট্রের চারায় রোগবালাই দেখা দিলে অ্যাজোক্সিট্রবিন অথবা পাইরাক্লোস্ট্রবিন গ্রম্নপের ছত্রাকনাশক ২-৩ মিলিলিটার পানিতে মিশিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। স্প্রে করার পর আনুমানিক ছয় ঘণ্টা ট্রেতে সেচ দেয়া যাবে না। স্প্রে করার আনুমানিক ১২ ঘণ্টা পূর্বে ট্রের পানি সম্পূর্ণভাবে নিস্কাশন করতে হবে, বাড়ির আঙ্গিনায় অথবা উঁচু জায়গায় ট্রে স্থাপন করলে প্রতিদিন ঝর্ণার মাধ্যমে সম্পূর্ণ সিক্ত করে পানি দিতে হবে। তবে মূল জমিতে ট্রে স্থাপন করলে চারার গোড়া পর্যন্ত সেচ দিয়ে পানি ধরে রাখতে হবে, যদি তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি বা তার কম থাকে সেক্ষেত্রে বিকালে পানি দিয়ে সকালে তা ছেড়ে দিতে হবে।
শীতের কবল থেকে চারা রক্ষা করার জন্য পলিথিনের শেড ব্যবহার করা উত্তম। পলিথিনের শেড অবশ্যই মাটি হতে ২-৩ ফুট উচুঁ অর্ধগোলাকৃতির হতে হবে এবং দিনের বেলায় পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। তবে প্রচন্ড এবং অত্যধিক কুয়াশাচ্ছন্ন অবস্থায়, যদি শৈত্যপ্রবাহ থাকে, সেক্ষেত্রে পলিথিন দিয়ে চারা রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা ঢেকে রাখাই উত্তম, (৭) মাটি কম উর্বর হলে বা চারার বাড়বাড়তি কম হলে ১০০-১৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ৬০ গ্রাম এমওপি, ৪০ গ্রাম থিওভিট, ৩০ গ্রাম দস্তা সার ১০ লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে চারার উপর এমনভাবে স্প্রে করতে হবে যাতে সম্পূর্ণ চারা এবং মাটি ভিজে যায়। এটি মূলত চারা গজানোর ৫-৭ দিন পর করলেই উত্তম। তারপরও চারার বাড়বাড়তির ঘাটতি দেখা দিলে উলিস্নখিত মাত্রায় আবারও স্প্রে করতে হবে। সব ট্রে একই সঙ্গে এবং একই মাত্রায় স্প্রে করতে হবে। দিনের বেলায় স্প্রে করতে হবে যাতে চারার পাতায় লেগে থাকা শিশির পানি সূর্য ডুবার পূর্বেই শুকিয়ে যায়। বাংলাদেশের কৃষিতে বর্তমান শ্রম সংকট বিবেচনা করে রাইস ট্রান্সপস্নান্টার একটি প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ প্রযুক্তি।