অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সৃষ্ট বন্যায় দেশের ১২টি জেলায় কৃষির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গত কয়েক দিনে এসব জেলায় দুই লাখ ৩০ হাজার হেক্টর আবাদি জমি আক্রান্ত হয়েছে, যা মোট আবাদি জমির ৩০ শতাংশ। ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষি মন্ত্রণালয় নানা উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। পানি সরে গেলেই ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত হিসাব করে কৃষকদের প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ ও কৃষি উপকরণ সহায়তা দেওয়া হবে। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মাঠে থাকা সদ্য রোপণকৃত আমন ধানের। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে কৃষক ভাইদের করণীয় বিষয়ে কিছু জরুরি পরামর্শ তুলে ধরা হলো।
১) বন্যা উপদ্রম্নত সব এলাকায় ব্রি উদ্ভাবিত আলোক সংবেদনশীল উফশী জাত যেমন- বিআর-৫, বিআর-২২, বিআর-২৩, ব্রি ধান-৩৪, ব্রি ধান-৪১, ব্রি ধান-৪৬, ব্রি ধান-৫৪ এবং আলোক সংবেদনশীল স্থানীয় জাত যেমন-নাইজারশাইল, রাজাশাইল, কাজলশাইল ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরাসরি বপন এবং ১৫ সেপ্টেম্বর এর মধ্যে রোপণ করতে হবে। এক্ষেত্রে গোছাপ্রতি ৪-৫টি চারা ঘন করে ২০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে রোপণ করতে হবে।
২) বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ব্রি ও বিনা উদ্ভাবিত স্বল্প জীবনকালীন জাত যেমন- ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান-৬২, ব্রি ধান-৭১, ব্রি ধান৭৫, বিনা ধান-৭ এবং বিনা ধান-১৭ সরাসরি বপন পদ্ধতিতে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত শুধু নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্ণীপুর ও বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন্যা আক্রান্ত এলাকায় চাষ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কাদাময় জমিতে অংকুরিত বীজ বপন করা ভালো। রোপণ পদ্ধতিতে ধান চাষের ক্ষেত্রে ১২-১৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হবে। লক্ষ্যণীয়, এসব জাতে উলিস্নখিত বপন সময়ের ক্ষেত্রে নভেম্বরের ১৫-৩০ তারিখ পর্যন্ত প্রজনন পর্যায়ে দিন ও রাতের গড় তাপমাত্রা একটানা ৩-৫ দিন ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে থাকলে ধানের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উলেস্নখ্য, বন্যা উপদ্রম্নত কুমিলস্না, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, চাঁদপুরসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে স্বল্প জীবনকালীন জাত এ মুহূর্তে চাষ করা যাবে না।
৩) যেসব এলাকায় বীজতলা করার উঁচু জমি নেই সেসব এলাকায় ভাসমান বা দাপোগ বীজতলা অথবা ট্রেতে চারা তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে। ভাসমান বীজতলার ক্ষেত্রে কচুরিপানা ও মাটি দিয়ে কলার ভেলায় ভাসমান বীজতলা করা যেতে পারে। দাপোগ বীজতলার ক্ষেত্রে বাড়ির উঠান বা যে কোনো শুকনো জায়গায় কিংবা কাদাময় সমতল জায়গায় পলিথিন, কাঠ বা কলাগাছের বাঁকল দিয়ে তৈরি চৌকোনা ঘরের মতো করে প্রতি বর্গমিটারে ২-৩ কেজি অংকুরিত বীজ ছড়িয়ে দিতে হবে। এভাবে তৈরীকৃত ১২-১৫ দিন বয়সের চারা মূল জমিতে প্রচলিত পদ্ধতিতে রোপণ করতে হবে।
৪) বন্যা-উপদ্রম্নত এলাকার উঁচু জমিতে অথবা নিকটবর্তী যেসব এলাকায় বন্যা হয়নি সেসব এলাকায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে প্রয়োজনীয় পরিমাণ বীজতলা তৈরির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে বন্যা-উপদ্রম্নত এলাকায় বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে চারা বিতরণ কার্যক্রমের মাধ্যমে আমন ধানের আবাদ নিশ্চিত করা যায়।
৫) বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ার পর যেসব ক্ষেতের ধান গাছ বেঁচে আছে সেসব গাছের পাতায় কাদা বা পলিমাটি লেগে থাকলে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার ৭ দিন পর পরিষ্কার পানি স্প্রে করে পাতা ধুয়ে দিতে হবে।
৬) বন্যার পানি নেমে যাওয়ার ৮-১০ দিন পর ধান গাছে নতুন কুশি দেখা দিলে বিঘাপ্রতি ৭-৮ কেজি ইউরিয়া এবং ৫-৬ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করুন। এ ছাড়া গাছের বৃদ্ধি পর্যায় বিবেচনা করে অনুমোদিত মাত্রার ইউরিয়া ও পটাশ সার প্রয়োজন অনুযায়ী উপরি প্রয়োগ করতে হবে। সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে অর্থাৎ অতিরিক্ত সার ব্যবহার করা যাবে না।
৭) বন্যায় আক্রান্ত হয়নি এমন বাড়ন্ত আমন ধানের গাছ (রোপণের ৩০-৪০ দিন পর্যন্ত) থেকে ২-৩টি কুশি শিকড়সহ তুলে নিয়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ধান ক্ষেতে রোপণ করা যেতে পারে।
৮) বন্যামুক্ত বা বন্যা উপদ্রম্নত এলাকায় যেখানে আমন ধানের বেশি বয়সের চারা (সর্বোচ্চ ৬০ দিন বয়স্ক) পাওয়া যাবে তা বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর গোছাপ্রতি ৪-৫টি চারা ঘন করে ২০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে রোপণ করতে হবে। উলেস্নখ্য, শেষ চাষের সময় প্রয়োজনীয় টিএসপি (বিঘাপ্রতি ১০ কেজি) ও এমওপি (বিঘাপ্রতি ১৪ কেজি) সার প্রয়োগ করতে হবে এবং রোপণের ৭-১০ দিন পর বিঘাপ্রতি ২০-২৫ কেজি ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
৯) নাবীতে বপন অথবা রোপণের ক্ষেত্রে ধানের স্বাভাবিক ফলন নিশ্চিত করার জন্য খরায় আক্রান্ত হলে প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।
১০) বন্যা পরবর্তীতে ধান গাছে খোলপোড়া এবং পাতাপোড়া রোগ হতে পারে। সুষম মাত্রায় সার ব্যবহারসহ খোলপোড়া রোগ দমনে প্রোপিকোনাজল/নেটিভো/এমিস্টার টপ বিকাল বেলা অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। পাতাপোড়া রোগ দমনে বিঘাপ্রতি অতিরিক্ত ৫ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
১১) বন্যা পরবর্তী সময়ে ধান ক্ষেতে পাতা মোড়ানো এবং বাদামি গাছফড়িংয়ের আক্রমণ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনাসহ নিয়মিত মাঠ পর্যবেক্ষণ করে ব্যাপক আক্রমণ হওয়ার পূর্বেই উপযুক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
লেখক: ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।