এক সময় এ দেশের খাল-বিল, পুকুর-জলাশয় ও নদী থেকে বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর দেশি মাছ পাওয়া যেত। তাই এ দেশের মানুষকে বলা হতো মাছে-ভাতে বাঙালি। বাজারগুলোও ভরে যেত দেশি মাছে। ওই সময়ে চাহিদার তুলনায় মাছ বেশি আমদানি হওয়ায় দূরদূরান্ত থেকে লোকজন নদীপাড়ের হাটবাজারগুলোতে দেশি মাছ কেনার জন্য বছরজুড়েই ভিড় করত। চাহিদা সত্ত্বেও ক্রেতারা এখন দেশীয় প্রজাতির মাছের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। দূষণের বিপদ বাড়ায় উন্মুক্ত জলাশয় হুমকিতে পড়েছে। বিশেষত কৃষিজমিতে ব্যাপকহারে কীটনাশক ও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে নদী-নালা, খাল-বিলসহ উন্মুক্ত জলাশয়ের মিঠা পানি প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে। আর বিষাক্ত পানির কারণে দেশীয় মাছ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে।
বর্ষার শুরুতে বেড়জাল ও কারেন্টজাল দিয়ে মা মাছ নিধনের ফলেও বিলুপ্ত হচ্ছে দেশীয় মাছ। একটি অসাধু চক্র মাছের ডিম ও পোনা মাছ ধরেও দেশীয় মাছের সংকট সৃষ্টি করছে। বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির হাইব্রিড মাছ চাষের ফলে দেশীয় অর্ধশতাধিক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে। দেশীয় প্রজাতির মাছ বিশেষ করে মাগুর, চাপিলা, শিং, পাবদা, টাকি, রুই, কাতল, মৃগেল, চিতল, রিটা, গুঁজি আইড়, কৈ, বোয়াল, খৈলসার মতো সুস্বাদু মাছগুলো এখন আর তেমনটা চোখে পড়ে না। দেশি সরপুঁটি, গজার, বামাশ, টাটকিনি, তিতপুঁটি, বাঘা আইড়, গুলশা, কাজলি, গাং মাগুর, চেলা, বাতাসি, বউরাণী, টেংরা, কানি পাবদা, পুঁটি, মলা, কালোবাউশ, শোল, মহাশোল, রিটা, তারাবাইম, বেলেসহ ৪০ থেকে ৬৪টি জাতের মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। এর মধ্যে ২৯ প্রজাতির বিলুপ্ত প্রায় মাছ ফিরিয়ে এনেছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উভয় কারণেই অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়েছে। বিলুপ্তির পথে রয়েছে বহু মাছ। প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- জলাভূমির সঙ্গে বিশেষ করে নদী, হাওড়-বাঁওড় ও বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, পস্নাবন ভূমির সঙ্গে সংযোগ খাল ভরাট, জলাশয়ে বছরের অধিকাংশ সময় পানি না থাকা এবং প্রজনন মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে যাওয়া। মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- জমিতে রাসায়নিক সার ও অপরিকল্পিত মৎস্য আহরণ, প্রজনন মৌসুমে প্রজনন সক্ষম মাছ ও পোনা ধরা, কলকারখানার বর্জ্য নিকটস্থ জলাশয়ে ফেলা, কারেন্ট জালের ব্যবহার, মাছের আবাসস্থল ধ্বংস করা এবং ক্ষতিকর মৎস্য আহরণ সরঞ্জামের ব্যবহার।
মৎস্যবিদ ড. শরীফ কবীর জানান, খাদ্যভাস্যের তালিকায় মাছ একটি নিত্য খাবার- যা আমিশের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কথায় আছে মাছের পোনা, দেশের সোনা। আর দেশি মাছ পুষ্টির আধার। নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড় শুকিয়ে মুক্ত জলাশয়ের মাছ বিলুপ্ত হতে চলেছে এবং ফসলি জমিতে অতি মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগের কারণে মাছের জীবনচক্র হুমকির মুখে। কৃত্রিম উপায়ে ঘের-পুকুরে মাছের চাষ বৃদ্ধি পেলেও এর প্রকৃত স্বাদ বিনষ্ট হচ্ছে। গ্রাম-গঞ্জের খাল-বিলে কিছু দেশীয় মাছ মিললেও চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল। বাজারে দেশি মাছের চাহিদা থাকলেও পুঁটি, মায়া, ট্যাংরা, খলিসা, শিং, রয়না, কাকিলা, বাইম, পাকাল, গচি, গরগতে, চিংড়ি, চ্যাং, দেশি মাগুর, পাবদাসহ এ জাতীয় মিঠা পানির মাছ নেই বলেস্নই চলে। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মোট ২৬০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছের মধ্যে ১২টি প্রজাতি চরম বিপন্ন এবং ১৪টি প্রজাতি সংকটাপন্ন। যদিও চিংড়িসহ মিঠাপানির ২৯৬টি প্রজাতির মাছ এবং ৫১১টি সামুদ্রিক প্রজাতির মাছ রয়েছে। এসব বিষয় বিশ্লেষণ করলে মাছের যে প্রাকৃতিক জলাশয় ও মুক্ত জলাশয় রয়েছে তা আমাদের অযাচিত ও অনৈতিক কীটনাশক ব্যবহারের কারণে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ও বংশবিস্তারকে হুমকির সম্মুখীন করেছে। মাছের জাটকা সংরক্ষণে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং মৎস্য অধিদপ্তর বেশ প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে কিন্তু সে বিষয়টি এখনো সাড়া জাগানো সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করা সম্ভব হয়নি। দেশীয় মাছ অবশ্যই সংরক্ষণ করে মুক্ত জলাশয়ে তার অবাধ বিচরণের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশি মাছ সংরক্ষণ ও চাষের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও আমিশের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। সেজন্য প্রয়োজন মৎস্যবান্ধব পরিবেশনীতি ও অবকাঠামোর সফল বাস্তবায়ন।
এ বিষয়ে মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, দেশীয় মাছগুলোকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের আওতায় আনতে হবে। বদ্ধ জলাশয়ে দেশি প্রজাতির মাছ যাতে বেশি পাওয়া যায় সেজন্য বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। ধান খেতে ছোট প্রজাতির মাছ চাষের ব্যবস্থা করা এবং এ ধরনের মাছ সারা বছর পাওয়ার জন্য ধান খেতে মিনি পুকুর তৈরি, মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ না ধরা, ফাঁস জাল ব্যবহার না করা, রাক্ষুসে মাছ কমানোর জন্য বিষ প্রয়োগ না করা, রুই জাতীয় মাছের সঙ্গে ছোট প্রজাতির মাছের মিশ্র চাষ, জলাশয় এবং পুকুরে দেশি মাছ চাষাবাদের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। যদিও বর্তমানে মাছের স্বাভাবিক প্রজননক্ষেত্র, চলাচল অনেকখানি হুমকির মুখে। অনেকে না জেনে, না বুঝে জাটকা নিধন করেন। তাছাড়া জমিতে অতি মাত্রায় বালাইনাশক প্রয়োগ, অপরিকল্পিত বাঁধ দেয়া, পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধন এবং মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা থেকে বিরত না থাকার কারণে এখন আর পরিচিত অনেক দেশি মাছের সন্ধান মেলে না। অভিজ্ঞ মহলের মতে দেশি মাছ সংরক্ষণের জন্য কারেন্ট জালের ব্যবহার বন্ধ করা, মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তোলা, পুরাতন জলাশয়গুলো সংস্কার করা, ছোট দেশি জাতের মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ও অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় সংরক্ষণ করে মাছের বংশবৃদ্ধির জন্য উপযোগী করে দেশীয় মাছের সংরক্ষণ করা অতিব প্রয়োজন। জলাশয়, খাল, পুকুর ভরাটের কারণে মাছের আবাসস্থল থাকছে না- যার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির সুস্বাদু মাছ।
সুস্বাদু দেশীয় মাছ এখন আর তেমন পাওয়া যায় না। বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা দেশি মাছের অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নাম রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- চ্যাপিলা, বৈচা, চাটুয়া, চাঁদা, নামা চাঁদা, গোল চাঁদা, আইড়, গুলশা, পাবদা, দেশি পুঁটি, সরপুঁটি, তিত পুঁটি, মেনি, ভেদা, শিং, কই, টাকি, শোল, গজার, ফলি, চিতল, মলা, ঢেলা, কানপোনা, দারকিনা, খয়রা, বাচা, বাটা, রিটা, পিয়ালি, জয়া, খৈলশা, ছোট টেংরা, বড় টেংরা, চান্দা, কাজলি, চ্যাং, কালবাউশ, বাঘাইর, ভাঙ্গন, ছোট চিংড়ি, বাতাশি, বড় বাইম, তারা বাইম, শাল বাইম, চিকরা বাইম, কাকিয়া, কুইচ্চা, তারা, রখাকসা, খরকুটি, বাশপাতারি, পটকা, বেলেসহ নাম না জানা অনেক প্রজাতির দেশি মাছ। গত দুই দশকে কৃত্রিম প্রজনন ও চাষের মাধ্যমে মাছের সরবরাহ ও চাহিদা অনেকাংশে বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর সাড়ে ৪২ লাখ টনেরও বেশি মাছ উৎপন্ন হচ্ছে। এর মধ্যে নদী, বিল ও হাওড়সহ উন্মুক্ত জলাশয় থেকে ২৫ শতাংশ; পুকুর, ডোবার মতো বদ্ধ জলাশয় থেকে ৫৭ শতাংশ এবং বাকি অংশ সমুদ্র থেকে উৎপাদিত হচ্ছে।
মাছের উৎপাদন বাড়ানোর আরো সুযোগ রয়েছে দেশের। কিন্তু দিনের পর দিন দেশের অভ্যন্তরে কমে যাচ্ছে মুক্ত জলাশয়ের মৎস্যসম্পদ। গত এক দশকে বিভিন্ন ধরনের ৫৪ প্রজাতির মাছের নাম এসেছে বিলুপ্তির তালিকায়। মুক্ত জলাশয়ের মধ্যে আছে পস্নাবন ভূমি, নদী, খাল, বিল, হাওড়, কাপ্তাই হ্রদ ও সুন্দরবন। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগৃহীত মাছের শতকরা ৪১.৩৬ ভাগ সরবরাহ আসে মুক্ত জলাশয় থেকে। দেশে উন্মুক্ত জলাশয়ের আয়তন ৪০.৪৭ লাখ হেক্টর, যা মোট অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের শতকরা ৮৮.৪৬ ভাগ।
মৎস্যবিদ আফিুর রেজা বলেন, বাংলাদেশের জলাশয়ে ২৬০ প্রজাতির দেশীয় মাছ, ১২ প্রজাতির বিদেশি মাছ এবং ২৪ প্রজাতির চিংড়ি রয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্যখাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। স্থুল জাতীয় উৎপাদনে এ খাতের অবদান শতকরা প্রায় ৪ ভাগ এবং কৃষির উৎপাদনে শতকরা ২১ ভাগ। জাতীয় রপ্তানি আয়ে মৎস্যখাতের শরিকানা শতকরা প্রায় ৪ ভাগ। আমাদের নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৫৮ ভাগ সরবরাহ আসে মাছ থেকে। এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকান্ডে প্রায় ১৩ লাখ শ্রমিক সার্বক্ষণিকভাবে এবং ১ কোটি ২৫ লাখ শ্রমিক খন্ডকালীনভাবে নিয়োজিত আছে। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, কর্মসংস্থানে, দারিদ্র্যমোচনে এবং প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি দূরীকরণে মৎস্য খাতের উন্নয়ন অপরিহার্য।
কারেন্ট জাল না ব্যবহারে আইন করেছে সরকার, তবে সে আইন মানা হয় না তেমন। শুধু কারেন্ট জাল নয়, নির্ধারিত ফাঁসজাল যদি ছাড়া যায়, তাহলে মাছের বিলুপ্তি রোধ করা অনেকটাই সম্ভব এবং সেই সঙ্গে মাছের উৎপাদনও বেড়ে যাবে। গবেষণায় দেখা গেছে, বছরে যে পরিমাণ জাটকা ধরা পড়ে, তার মাত্র শতকরা ২৫ ভাগ যদি রক্ষা করা যায়, তাহলে বছরে দেড় লাখ টন ইলিশ উৎপাদন সম্ভব, যার বাজারমূল্য ৬০০ কোটি টাকা। শুধু ইলিশ নয়, বর্ষা মৌসুমে এসব জালের অবাধ ব্যবহারে ডিমওয়ালা মাছসহ ধরা পড়ছে অবাধে। ফলে বংশবৃদ্ধি হচ্ছে না অধিকাংশ মাছের।