গত এক দশকে দেশে সবজি চাষে রীতিমতো বিপস্নব ঘটে গেছে। এ সময়ে সবজির উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৮ লাখ ৫ হাজার হেক্টর জমিতে সবজি উৎপাদন হয় ১ কোটি ৪৪ লাখ টন। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৯৭ লাখ ১৯ হাজার টনে। কৃষিতে এখন শুধুই জয়জয়কারের ধ্বনি। ফলে কৃষকের ঘটেছে ভাগ্যের পরিবর্তন। সাবলম্বী হয়ে উঠেছেন তারা। দেশের অর্থনীতির চাকা নিত্য সচল আছে কৃষির সিংহভাগ অবদানের জন্য। নিরাপদ সবজি উৎপাদনে সমদ্ধ হচ্ছে দেশের অর্থনীতি।
বাংলাদেশে সবজি উৎপাদনে বিপুল সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বর্তমানে সবজি উৎপাদনে চীন ও ভারতের পরে বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। যশোর, কুমিলস্না, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, জামালপুর, রংপুর, জয়পুরহাট, নাটোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরসহ কয়েকটি জেলায় সবজি উৎপাদনের বিপস্নব ঘটেছে- যা মাত্র ৪ দশক আগেও ছিল অভাবনীয়। এর ফলে, শিক্ষিত যুবসমাজ নতুন নতুন প্রযুক্তি ও ইনোভেটিভ ধ্যান-ধারণা নিয়ে সবজি উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে। পাহাড় ও উপকূলীয় অঞ্চলে সবজি চাষ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় বাড়ির আঙিনা, বাঁধ, ঘেরের পাড়ে এমনকি মাছ চাষের জলাশয়গুলোর উপর চাউনি দিয়ে লতানো সবজি উৎপাদন করা হচ্ছে। পাহাড়ে জুম পদ্ধতিতে এবং বসতভিটায় সবজি চাষের ঐতিহ্য রয়েছে।
গত এক যুগে দেশে রীতিমতো সবজি বিপস্নব ঘটে গেছে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। কৃষি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক খাত। এ খাত থেকে জিডিপির ১৩ দশমিক ২৯ শতাংশ আসে। বর্তমানে ১ কোটি ৯৭ লাখ টন সবজি উৎপাদন করে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলো সারা বছর চাষের উপযোগী হাইব্রিড বা উচ্চফলনশীল (উফশী) সবজি বীজ উদ্ভাবন এবং তা বাজারজাত করার ফলে সবজি চাষে সাফল্য ও বৈচিত্র্য এসেছে। দেশে বর্তমানে দেশি-বিদেশি প্রায় ২০০ ধরনের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। দেশে প্রচুর চাহিদা থাকায় নিজ তাগিদে বিদেশি সবজি চাষ করছেন কৃষকরা। এসব চাষে কোনো প্রশিক্ষণ নেই তাদের। নিজেরাই বীজ সংগ্রহ করে নেমে পড়েছেন চাষে। বিদেশি এসব সবজি সাধারণ মানুষ যেমন কেনে পাশাপাশি রেস্টুরেন্টগুলোতেও চাহিদা রয়েছে। ফলে কৃষকরা চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। সরবরাহ করছেন সারাদেশে। লেটুসপাতা, চায়নিজ পাতা, ক্যাপসিকাম, বিট রুট, ব্রম্নকলি, রেড ক্যাবেজ, স্কোয়াশ, ফ্রেঞ্চ বিন, সুইট কর্ন, বেবি কর্ন, থাই আদা, থাই তুলসী, লেমনগ্র্যাস, স্যালারি পাতা, শিমলা মরিচ, চায়নিজ ক্যাবেজ- ক্ষেতের পর ক্ষেতজুড়ে চলছে এসব বাহারি বিদেশি সবজির চাষ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, যদিও দেশে মোট আবাদির মাত্র নয় ভাগ জমিতে সবজি চাষ হচ্ছে এবং এক কোটি ৮২ লাখ কৃষক পরিবার এই সবজি উৎপাদন করছে। বছরে প্রায় দুই কোটি টন সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত শাকসবজির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বিশ্বজোড়া। বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ প্রায় ৫০টি দেশে সবজি রপ্তানি হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য, ভারত ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশের মতো ইউরোপের বাজারেও রপ্তানি বাড়ছে। রপ্তানি খাতে যোগ হচ্ছে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য। প্রতিনিয়ত রপ্তানি খাতে যোগ হচ্ছে সবজি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য। চাহিদা মেটাতে দেশের শতাধিক প্রতিষ্ঠানে তৈরি হচ্ছে বিস্কুট, জ্যাম-জেলি, সরিষার তেল'সহ প্রায় ৮০০ ধরনের পণ্য। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে ১৪৪ দেশে রপ্তানি হচ্ছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার খাদ্যপণ্য। অথচ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি বলছে, শুধু প্রতিবেশী দেশগুলোতে ১২ হাজার কোটি টাকার কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি করতে পারে বাংলাদেশ। রপ্তানি অবকাঠামো তৈরিতে পিছিয়ে থাকায় সম্ভাবনার সবটুকু কাজে লাগানো যাচ্ছে না বলে মনে করেন খাত সংশিষ্টরা। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। অথচ এডিবি বলছে, সম্ভাবনা রয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকার। সম্ভাবনা কাজে লাগাতে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেয়া উচিত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। দেশের প্রক্রিয়াজাত কৃষি খাদ্যপণ্য রপ্তানি খাত দিন দিন বড় হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, নেপাল ও আফ্রিকার দেশগুলোর পর ইউরোপের বাজারেও রপ্তানি শুরু হয়েছে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের। এখন ইউরোপের মধ্যে তিন দেশ যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস ও ইতালিতে বেশি যাচ্ছে এসব পণ্য। ইউরোপের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াতেও প্রক্রিয়াজাত কৃষি খাদ্যপণ্য রপ্তানি হচ্ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে বাংলাদেশের ৫০ জাতের সবজি ও ফলমূল রপ্তানি হয়। তবে যেসব দেশে বাংলা ভাষাভাষীরা বসবাস করছে সেসব দেশে বাংলাদেশের সবজি রপ্তানির চাহিদা বেশি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, প্রবৃদ্ধির এ হার বজায় থাকলে আগামীতে সবজি রপ্তানি খাতে আয় ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। দেশের রপ্তানিকৃত সবজির প্রায় ৬০ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যে এবং বাকি ৪০ শতাংশ ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে যায়।
কৃষি সম্প্রসারণের অধিদপ্তরের সূত্র মতে, এ বছর বাংলাদেশে ৯ লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হচ্ছে। উৎপাদন টার্গেট ২ কোটি ১৯ লাখ টন। শীত, গ্রীষ্ম, সারাবছর চাষ হয় এবং কিছু বিদেশি জাত মিলে বাংলাদেশে সবজি চাষ হয়। সবচেয়ে বেশি যেসব সবজি বাংলাদেশে চাষ হয়, তার মধ্যে টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, চাল কুমড়া, পটল, ঝিঙা, করলা, লাউ, চিচিঙ্গা, কাঁকরোল, কাঁচা মরিচ, ধুন্দুল, মিষ্টি কুমড়া, ঢঁ্যাড়স, শসা, ক্ষীরা, মুলা, শিম, গাঁজর, পুইশাক, লালশাক, বরবটি, সজনে, শিম, ধনেপাতা, মটরশুঁটি ও কাঁচা পেঁপে ইত্যাদি।
কৃষি হচ্ছে আমাদের অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক খাত, এ খাত থেকে জিডিপির আনুমানিক ১৪ শতাংশ আসে। মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৬৩ শতাংশ এর সঙ্গে জড়িত। মোট সবজির ৩০ শতাংশই উৎপাদন হয় গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে, যার পরিমাণ প্রায় ৫০ লাখ টন এবং বাজারমূল্য প্রায় ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
শীতকালে বিভিন্ন শাকসবজি চাষের জন্য বেশ উপযোগী। এ সময় নানা ধরনের শাকসবজির চাষ হয়। আর এর উৎপাদন অনেক বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু গ্রীষ্মকালীন সময়ে শাকসবজির চাষ করা একটু কষ্টসাধ্য। কারণ এ সময় রোদ, বৃষ্টি, খরা, শিলাবৃষ্টিসহ নানান ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। সেজন্য একটু সতর্কতার সঙ্গে এ সময় বিভিন্ন সবজির চাষ করতে হয়। এ সময় গ্রীষ্মকালীন ফুলকপি, গ্রীষ্মকালীন টমেটো, বরবটি, পটল, শসা, ঝিঙা, করলা, কাঁকরোল, চিচিঙ্গা, গিমা কলমি, পুঁইশাক, মুখিকচু, মানকচু, মৌলভীকচু, পানিকচু, সজনে, মিষ্টিকুমড়া ও চালকুমড়ার চাষ করা যায়।
দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে বাংলাদেশের ৫০ জাতের সবজি রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর তথ্য মতে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৬৫০ কোটি ৪১ লাখ ২০ হাজার টাকার সবজি রপ্তানি হয়েছে এবং রপ্তানির পরিমাণ প্রতি বছর বাড়ছে। দেশের রপ্তানিকৃত সবজির প্রায় ৬০ শতাংশ মধ্যপ্রাচ্যে এবং বাকি ৪০ শতাংশ ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে যাচ্ছে। বিদেশে বাংলাদেশের সবজির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু উদ্যোক্তারা চাহিদার মাত্র ২ থেকে ৫ শতাংশ রপ্তানি করতে পারছে। কৃষিতে আশাতীত সাফল্যের দেশ বাংলাদেশ। দেশে লোকসংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়লেও সে তুলনায় বাড়েনি কৃষিজমি বরং প্রতি বছর এক শতাংশ হারে কমেছে। এর পরও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। একই সঙ্গে বেড়েছে পুষ্টির নিরাপত্তাও। তাতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছে। বাংলাদেশের কৃষিকে মডেল হিসেবে অনুসরণ করছে বিশ্ব। খাদ্যশস্য, সবজি, ফলসহ বিভিন্ন শস্যে বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। কয়েক দশক আগেও হাতেগোনা কিছু সবজির বাণিজ্যিক উৎপাদন হতো। পাশাপাশি সবজি রপ্তানি করেও মিলছে বৈদেশিক মুদ্রা।
কৃষিবিদ আফাজ উদ্দিন বলেন, গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি ফাল্গুন-চৈত্র মাস থেকে শুরু করে আশ্বিন মাস পর্যন্ত চাষ করা যায়। তবে আগাম চাষ করতে পারলে বাজারমূল্য বেশি পাওয়া যায়। শাকসবজি চাষে প্রধান কাজটি হলো জমি নির্বাচন ও জমি তৈরি, আলো-বাতাস চলাচলের সুবিধা, সেচের সুবিধা, অতি বৃষ্টির সময় জমি থেকে পানি বের করার সুবিধা আছে এরকম উর্বর দোআঁশ মাটি সবজি চাষের জন্য অত্যন্ত ভালো। সবজির জমি খুব মিহি ও ঝুরঝুরেভাবে তৈরি করতে হয়। জমি সমতলভাবে তৈরি করতে হয়। এজন্য প্রতিটা চাষের পরপরই ভালোভাবে মই দিলে জমিতে বড় কোনো ঢেলা থাকবে না শাকসবজি চাষের এমন ব্যবস্থা নিলে সেচ ও পরিচর্যার সুবিধা থাকলে ফলনও বেশি হয়। জমি তৈরির সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব বা আবর্জনা পচা সার দিতে হবে। জমিতে রসের অভাব থাকলে সেচ দিয়ে তৈরি করে বীজ বুনতে হয়। আবার অনেক রকমের সবজি মাদাতে লাগাতে হয়, যেমন- শসা, ঝিঙা, চিচিঙ্গা, কাঁকরোল, মিষ্টিকুমড়া ও চালকুমড়া। এগুলোর প্যাকেটে চারা তৈরি করে নির্দিষ্ট দূরত্বে মাচা তৈরি করে চারা লাগাতে হয়। চারা লাগানোর পর গাছগুলো বড় হতে থাকলে চাউনি বা মাচা তৈরি করে দিতে হয়। মাচাতে চারা লাগানোর আগে পরিমাণমতো সুষম হারে রাসায়নিক সারও দিতে হবে। শাকসবজি চাষে সারের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। পরিমাণমতো গোবর, টিএসপি, এমপি সার শেষ চাষের সময় ভালোভাবে জমিতে মিশিয়ে দিতে হয়।
বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিতে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। দেশের মোট ফসলি জমির প্রায় ৫ শতাংশ অর্থাৎ আবাদযোগ্য জমির প্রায় ১০ শতাংশ সবজি উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে।