মহামূল্যবান জাফরান চাষে হতে পারেন কোটিপতি
মসলা জাফরানের কেজি ৬ থেকে ১০ লাখ টাকা
প্রকাশ | ১১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
ইমরান ছিদ্দিকি
দামি মসলা জাফরান উৎপাদন করলে দেশের চাহিদা মিটিয়েও বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। বিশ্বের সবচাইতে দামি মসলা বাংলাদেশে বিএডিসির ৯টি উদ্যানে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করে সফলতা পাওয়া গেছে। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, গাজীপুরের কাশিমপুর, পাবনা, রংপুর, বান্দরবান, জামালপুর, লামা এবং খুলনার দৌলতপুরে চাষ করে এ সফলতা পাওয়া গেছে। সম্প্রতি শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেশে জাফরান উৎপাদন সফলতা পাওয়া গেছে। গবেষক দলের প্রধান শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ফ ম জামাল উদ্দিন জানান, দেশের মাটিতে সফলভাবে জাফরান উৎপাদন করা হয়েছে। সহজেই আমাদের দেশে এই গাছটির চাষাবাদ সম্ভব। অতি মূল্যবান এই গাছটি আপনার বাড়ির আঙিনায়, ক্ষেত্রের আইলে এবং অল্প জমিতে চাষ করে সহজেই হতে পারেন কোটিপতি।
জাফরান প্রতি কেজি'র মূল্য প্রায় ৬ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা প্রর্যন্ত হয়ে থাকে। স্পেনের 'লা মাঞ্চা' অঞ্চলের জাফরানের সুবাস সবচেয়ে ভালো। এদের জাফরান দুইটি ক্যাটাগরিতে পাওয়া যায় 'মাঞ্চা' আর 'কু্যপে'। জাফরান চাষ করলে আপনাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই লাল সোনার চাষ আপনাকে বানিয়ে দিতে পারে কোটিপতি।
পরিবারিক প্রয়োজন মেটাতে সাধারণত বাগানের বর্ডার এলাকাতে এ ফসল চাষ প্রচলন আছে। অনেকে ছাদে, পটে বা ছোট 'বেড' তৈরি করে নিয়েও সেখানে সীমিত আকারে জাফরান চাষ করে পরিবারের চাহিদা পূরণ করে থাকে। অনেকে এক মিটার চওড়া ও তিন মিটার লম্বা এবং ১৫ সে. মিটার উঁচু বীজতলা তৈরি করে নিয়ে তাতে জাফরান চাষ করে থাকে। এ ব্যবস্থায় পরিচর্যা গ্রহণ ও ফুল থেকে স্টিগমা (গর্ভদন্ড) সংগ্রহ করা সুবিধা হয়।
প্রায় সব ধরনের জমিতে জাফরান ফলানো যায়। তবে বেলে-দোআঁশ মাটি এ ফসল চাষে বেশি উপযোগী। পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত উঁচু বা মাঝারি উঁচু জমি এ ফসল চাষের জন্য নির্বাচনে প্রাধান্য দেয়া প্রয়োজন। পর্যাপ্ত রোদ ও আলো-বাতাস প্রাপ্তি সুবিধা আছে এমন স্থানে এ ফসল আবাদে ব্যবস্থা নিতে হবে। তৈরি বীজতলার জন্য প্রায় ১৫০টা জাফরানের মোথার প্রয়োজন হয়। বর্ষা শেষ হওয়ার পূর্বক্ষণে জুলাই-আগস্ট মাসে এ ফসলের মোথা রোপণ করা হয়। শুরুতে বেশি গভীরভাবে জমি চাষ করে তৈরি কারে প্রতি শতক জমিতে পচা গোবর/আবর্জনা পচা সার ৩০০ কেজি, টিএসপি ৩ কেজি এবং এমওপি ৪ কেজি প্রয়োগ করে ভালোভাবে মাটির সঙ্গে সমস্ত সার মিশিয়ে হালকা সেচ দিয়ে রেখে দিয়ে দু'সপ্তাহ পর জাফরান মোথা রোপণ উপযোগী হবে। বসতবাড়ি এলাকায় এ ফসল চাষের জন্য বেশি উপযোগী।
আপনি যদি সমভূমি অঞ্চলে থাকেন তবে জাফরান মশলাটির বীজ রোপণ করার জন্য উপযুক্ত সময় হলো ফেব্রম্নয়ারি এবং মার্চ মাস। আবার পাহাড়ি এলাকায় এই সময়কাল জুলাই থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে হওয়া প্রয়োজন, তবেই আপনি উপযুক্ত ফল পাবেন। এক্ষেত্রে, আপনাকে শুধু মাথায় রাখতে হবে যে, এটির চাষ প্রক্রিয়া যেন সঠিকভাবে হয়; কারণ উপযুক্ত পরিবেশে চাষ এবং পরবর্তী সময়ে ভালোভাবে প্যাকিং করে বিক্রির মাধ্যমে যদি আপনি এর চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবেন। শুরুতে বেশি গভীরভাবে জমি চাষ করে বা কোদাল দিয়ে কুপিয়ে জমি আগাছা মুক্ত ও লেবেল করে নেয়া প্রয়োজন। জমি তৈরির সময় প্রতি শতক জমিতে পচা গোবর/আবর্জনা পচা সার ৩০০ কেজি, টিএসপি ৩ কেজি এবং এমওপি ৪ কেজি প্রয়োগ করে ভালোভাবে মাটির সঙ্গে সমস্ত সার মিশিয়ে হালকা সেচ দিয়ে রেখে দিয়ে দু'সপ্তাহ পর জাফরান বালব রোপণ উপযোগী হবে। বসতবাড়ি এলাকায় এ ফসল চাষের জন্য বেশি উপযোগী। এ ফসল একবার রোপণ করা হলে ৩-৪ বছর পর্যন্ত ফুল দেয়া অব্যাহত থাকে। বর্ষার শেষে আগস্ট মাসে মাটি থেকে গাছ গজিয়ে ফেব্রম্নয়ারি মাস পর্যন্ত গাছের বৃদ্ধি ও ফুল দেয়া অব্যাহত থাকে। মে মাসের মধ্যে গাছের উপরিভাগ হলুদ হয়ে মরে যায়। মোথা মাটির নিচে তাজা অবস্থায় বর্ষাকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে ফুল ফোটে, ফুলের জন্য প্রয়োজন হয় প্রচুর রোদ, গরম আবহাওয়া আর পানি নিষ্কাশনের সঠিক ব্যবস্থা। ফুল তোলার পদ্ধতিটিও খুব সহজ নয়। মাটি থেকে মাত্র ছয় ইঞ্চি উচ্চতার হয় ফুলগুলো। এগুলো তোলার জন্য তাই শ্রমিককে ঝুঁকতে হয়। প্রায় ছয় ঘণ্টা বসে বা কুঁজো হয়ে ফুল তুলতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই এত দীর্ঘ সময় এই কাজ করা যে কারও পক্ষেই কষ্টদায়ক। ইতালি, ইরান আর স্পেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ জাফরান উৎপাদনকারী দেশ হলেও ইরান একাই বিশ্বজুড়ে জাফরানের ৯০ শতাংশের জোগান দেয়। ইরানে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ জাফরান উৎপাদনের কারণ হচ্ছে সেখানে অল্প বেতনে অধিকসংখ্যক কর্মী পাওয়া যায়।
এ ফসল আবাদ করতে হলে সব সময় জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। মাঝে মাঝে নিড়ানি দিয়ে হালকাভাবে মাটি আলগা করে দেয়া হলে মাটিতে বাতাস চলাচলের সুবিধা হবে এবং গাছ ভালোভাবে বাড়বে। শুকনো মৌসুমে হালকা সেচ দেয়া যাবে। তবে অন্য ফসলের তুলনায় সেচের প্রয়োজনীয়তা অনেক কম। বর্ষায় পানি যেন কোনো মতে জমিতে না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ইঁদুর, চিকা ও খরগোস জাফরানের পাতা, ফুল এমনকি গাছের মোথা খেতে পছন্দ করে, মোথা যত খায় নষ্ট করে তার দ্বিগুণ। এ জন্য এ ধরনের উপদ্রব দেখা গেলে প্রয়োজনীয় ফাঁদ ব্যবহার করে অথবা মারার জন্য ওষুধ ব্যবহার করে তা দমনে ব্যবস্থা নিতে হবে।
রোপণের প্রথম বছর সাধারণত ফুল আসে না। তবে জাফরানের রোপিত বালব আকারে বেশ বড় হলে সে বছরই জাফরান গাছ থেকে মাত্র একটা ফুল ফুটতে পারে। পরের বছর প্রতি গাছে পর্যায়ক্রমে ২-৩টা ফুল আসবে। দু'বছরের গাছে ৪-৫টা এবং তিন বছরের গাছে ৭-৮টা ফুল দেবে। জাফরানের স্ত্রী অঙ্গ ৩টা থাকে এবং পুরুষ অঙ্গও ৩টা থাকে। গাছে অক্টোবর মাস থেকে ফুল দেয়া আরম্ভ করে এবং নভেম্বর মাস পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে।
এ ফসলের আদিস্থান গ্রিস। এই উদ্ভিদ বেশি জন্মে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে। সবচেয়ে বেশি চাষ হয় স্পেনে বাণিজ্যিকভাবে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি জাফরান উৎপাদন হয় স্পেনে। দেশটি বিশ্বের মোট চাহিদার প্রায় ৮০ ভাগ জাফরান রপ্তানি করে থাকে। এ ছাড়াও আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তুরস্ক, মিশর, ইরান ও চীনে জাফরান চাষ হয়। জাফরানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় তা ধীরে ধীরে কান্দাহার, খোরাসান, কাশ্মীরের বনেদী মহলে ব্যবহারের প্রয়োজনে ভারত উপমহাদেশে এর বিস্তার ঘটে।
জাফরান পৃথিবীর অন্যতম দামি মসলা, ইহা 'রেড গোল্ড' নামেও পরিচিত। প্রাচীন যুগে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে জাফরানের সুগন্ধ ও উজ্জ্বল রঙের গুরুত্ব অনুধাবন করে এ জাফরান ব্যবহার সম্ভ্রান্ত পরিবারের মধ্যে ব্যাপক প্রচলন ছিল। এ ফসলের আদিস্থান গ্রিস। জাফরানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় তা ধীরে ধীরে কান্দাহার, খোরাসান, কাশ্মীরের বনেদী মহলে ব্যবহারের প্রয়োজনে ভারত উপমহাদেশে এর বিস্তার ঘটে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অনেক দেশেই জাফরান চাষ প্রচলন আছে। আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক, গ্রিস, মিশর ও চীন এসব দেশে কম বেশি জাফরানের চাষ হয়ে থাকে। স্পেন ও ভারতের কোনো কোনো অংশে বিশেষ করে কাশ্মীরে এ ফসলের চাষ অনেক বেশি। তবে অন্য দেশের তুলনায় স্পেনে জাফরান উৎপাদন পরিমাণ অত্যাধিক।
আকারে ছোট হলেও সবচেয়ে মূল্যবান এ সুগন্ধী বিশ্বব্যাপী রান্নার উপকরণ হিসেবে খ্যাত। এর বাইরে জাফরানের কিছু ঔষধি গুণও রয়েছে। শরীরের মেদ কমানো, কামোদ্দীপক, পেট ফাঁপা নিরাময়, নারীদের মাসিক নিয়মিত করার কাজে ব্যবহার হয় জাফরান। ক্যানসার থেকে রক্ষা, জ্ঞান আহরণ ও স্মৃতিশক্তির স্থায়িত্ব বাড়ানো, বিলম্বিত বয়ঃসন্ধি, যৌনশক্তি বাড়ানো, টাক মাথায় চুল গজানো, ঠান্ডা থেকে রক্ষা, খাবার মুখরোচক করে। খাবারকে সুগন্ধী ও মুখরোচক করতে জাফরানের জুড়ি মেলা ভার। এ ছাড়া খাবার আকর্ষণীয় ও রঙিন করার কাজটিও করে জাফরান। জাফরানের ঝলমলে রং মানুষকে খাবারের প্রতি আকৃষ্ট করে। বিভিন্ন ধরনের কেক ও বিস্কুট তৈরি, মাছ মেরিনেট করতে, পোলাও ও বিরিয়ানি রান্না করতে জাফরান ব্যবহার করা হয়।
আমাদের দেশে জাফরান ব্যবহার হয় জর্দা নামের মিষ্টান্ন ও পায়েস তৈরিতে। বিরিয়ানির সুন্দর রঙ আনার জন্যও জাফরান ব্যবহার করা হয়। জাফরান যেমন অর্থকরী একটি মসলা তেমনি এটি স্বাস্থ্যের জন্যও অনেক উপকারী। এটি গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা ও অন্য অনেক শারীরিক সমস্যা নির্মূলে ঔষধি হিসেবে কাজ করে থাকে। এক সময় দেহসৌষ্ঠব বাড়ানোর জন্য গায়ে মাখা হতো জাফরান। ত্বকের লাবণ্য বাড়াতে জাফরানের জুড়ি নেই। এটি ত্বককে উজ্জ্বল করে এবং অবসাদের চিহ্ন দূর করে ত্বককে সতেজ ও সজীব করে তোলে। এর ভেষজ গুণ এতই সমৃদ্ধ যে, এটি মানবদেহে অন্তত ১৫টি সমস্যা দূর করতে সক্ষম। জাফরানে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদপিন্ডের সমস্যা দূর হয়। হজমজনিত সমস্যা নিরাময়ে জাফরান প্রয়োগের নজির আছে। পরিমাণমত জাফরান নিয়মিত খেলে ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ দূর হয়ে যায়। অনিদ্রা দূর করে জাফরান। যে কোনো ধরনের ব্যথা নিরাময়ে জাফরান অত্যন্ত কার্যকরী। স্মৃতিশক্তি ও চিন্তাশক্তি বৃদ্ধিতেও এটি বেশ সহায়ক। প্রসাধন সামগ্রীতে জাফরানের বহুল ব্যবহার রয়েছে।
সতর্কতা : অনেক গুণসম্পন্ন এ জাফরান অতিমাত্রায় খাওয়া যাবে না। নারীদের ক্ষেত্রে অন্তঃসত্ত্ব্বা অবস্থায় এটি কোনো খাবারে ব্যবহার করা যাবে না। এ ছাড়া এক বা দুই চামচের বেশি খেলে যে কোনো মানুষ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে।