ঔষধি গুণে ভরপুর হলেও হারিয়ে যাচ্ছে বেল গাছ

প্রকাশ | ১১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন
গ্রীষ্মকালীন ফলের মধ্যে বেল একটি উলেস্নখযোগ্য ফল। বেল আমাদের দেশের বেশ পরিচিত একটি ফল। এ ফলটি অত্যন্ত উপকারী ও ভেষজ গুণাগুণ সম্পন্ন। পরিপাকতন্ত্রের পীড়ায় বেল খুবই উপকারী। বিশেষ করে আমাশয় নিবারণে, রক্ত আমাশয়ে, পেটের গোলযোগ উপশমে, গায়ের দুর্গন্ধ দূরীকরণে, শুক্রতারল্য স্বাভাবিক করণে বেল একটি সেরা ঔষধি ফল। বেলগাছ বহু ঔষধি গুনের অধিকারী হলেও আমাদের দেশে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে এই বেল গাছ। অথচ রোগ প্রতিরোধে বেলের মূলের ছাল, পাতা, ফুল ও কচি ফলের শ্বাস ভেষজ ও ঔষধি গুণ সমৃদ্ধ। দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই এ ফল পাওয়া যায়। তবে এর চাষ আমাদের দেশে এখনো বাণিজ্যিকভাবে খুব একটা হচ্ছে না। বেল একটি পুষ্টিকর আর উপকারী ফল। কাঁচা-পাকা দুটিই সমান উপকারী। কাঁচা বেল ডায়রিয়া ও আমাশয় রোগের জন্য ভীষণ উপকারী। পাকা বেলের শরবত সুস্বাদু। বেলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, এ এবং ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও পটাশিয়ামের মতো দরকারি পুষ্টি উপাদান। বলের আদি নিবাস ভারত উপমহাদেশে। বেল গাছে মার্চ-এপ্রিল মাসে ফুল আসে। পরের বছর মার্চ এপ্রিল মাসে বেল পাকা শেষ হয়। মিষ্টি গন্ধযুক্ত হালকা সবুজে ফুল ছোট ছোট থোকায় থোকায় ধরে। ফুলের পাপড়ি তাড়াতাড়ি খসে পড়ে। ফল ধরতে ও পাকতে প্রায় ১ বছর লেগে যায়। প্রতি বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসে সারাদেশে প্রচুর পরিমাণে বেল পাওয়া যায়। বেল কাঁচা ও পাকা অবস্থায় খাওয়া যায়। হেকিমি মতে, বেল পাকার চেয়ে কাঁচা অবস্থায় বেশি উপকারী। বেল চাষ করার জন্য আলাদা কোনো কিছু করার দরকার পড়ে না। অন্য ফলদ গাছ যেমন, আম, জাম, লিচু আর কাঁঠালের মতো সাধারণ পরিচর্যাতেই এগুলো বড় হয়ে থাকে। শীতকালে বেল গাছের সব পাতা ঝরে যায়, আবার বসন্তে নতুন পাতা গজায়। বেল ফল দেখতে সাধারণত গোলাকার শক্ত খোসাবিশিষ্ট। কাঁচা ফলের রং সবুজ, পাকলে বেল হলদে হয়ে যায়। ভেতরের শাঁসের রং হয়ে যায় কমলা বা হলুদ। পাকা বেল থেকে সুগন্ধ বের হয়। বীজ থেকে একটি বেল গাছ হতে এবং তা থেকে ফলন পেতে সময় লাগে প্রায় ১৫ বছর- যা এ দেশে চাষাবাদযোগ্য যে কোনো ফলের তুলনায় বেশি। ফল পাওয়ার জন্য এত দীর্ঘ সময় কেউ অপেক্ষা করতে চায় না ফলে বেলের চাষাবাদ দিনের পর দিন কমছে। বেলের যত ঔষধি গুণাগুণ-যাদের গায়ে ঘাম বেশি হয় এবং ঘামে খুব দুর্গন্ধ হয় তারা বেল পাতার রস পানিতে মিশিয়ে সেই পানি দিয়ে শরীর মুছে নেবেন। কিছুক্ষণ পর গোসল করে নেবেন। এতে গন্ধ থাকবে না। কচি বেল কেটে টুকরো টুকরো করে নিয়ে তা পানিতে ভিজিয়ে সারা রাত রেখে দিন। পরদিন সকালে ছেঁকে নিয়ে পানি পান করুন। এতে আমাশয় ও ডায়রিয়া ভালো হবে। যাদের পেটে গ্যাস হয় বা পায়খানা পরিষ্কার হয় না। তারা নিয়মিত বেলের শাঁস খান। সমস্যা কমে আসবে। অনেক ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে মনে রাখতে পারে না। তাদের জন্য ২ থেকে ৫টি বেল পাতা গাওয়া ঘিতে ভালো করে ভেজিয়ে মুড়মুড় করে অল্প মিসরির গুঁড়ো মিশিয়ে প্রতিদিন একবার করে খেতে দিন। কিছু দিন খাওয়ালে স্মৃতিশক্তি বাড়বে এবং মেধাশক্তিও বেড়ে ওঠবে। যারা পাকস্থলীর আলসারে ভুগছেন তারা কচি বেলের টুকরো বা বেলশুটি পরিমাণ মতো বার্লির সঙ্গে একত্রে রান্না করে পরে ছেকে নিয়ে বার্লিগুলো খেয়ে নিলে অল্প দিনেই আলসারের সমস্যা কমে আসবে। যেসব পুরুষের শুক্র বেশি পাতলা বা প্রসাবের রাস্তায় পিচ্ছিল আকারে ঝরে গেলে তারা বেল গাছের ছালের টাটকা রস ২০ মিলিমিটার গরুর দুধ ১৫০ মিলিমিটার, জিরার গুঁড়া ১ গ্রাম এ তিনটি এক সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে দিনে একবার করে খেলে সমস্যা কমে যাবে। যাদের হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক ও পাকস্থলী দুর্বল তারা ৩০-৩৫ গ্রাম পাকা বেলের শাঁস শরবত করে সকাল বিকাল দুবার খান বেশি উপকার পাবেন। বেল পাতার সঙ্গে ৩/৪টি গোলমরিচ পিষে ফোঁড়ার উপর লাগিয়ে দিলে ফোঁড়া বসে যায়। বেল গাছের মূলের ছালের রস খেলে রক্তের সুগার বা চিনি কমে যায় এবং হৃৎপিন্ডের ও পেটের ব্যথা সরে যায়। কাঁচা বেল শাঁস চাকা চাকা করে কেটে নিয়ে রৌদে শুকিয়ে বেল শুটি তৈরি করা হয়। পেটের যে কোনো সমস্যায় ব্যথা, আমাশয়, পেট ফাপা, ডায়রিয়া, গ্যাস্ট্রিকের জন্য এই বেলশুটি সিদ্ধ করে পানিসহ পান করুন। সমস্যা কমে আসবে। বেল গাছের ফুল মসুর ডাল ধোয়া পানির সঙ্গে ভালো করে পেষণ করে মিশ্রণটি মুখমন্ডল হাতে ব্যবহার করুন। অল্প দিনের মধ্যে চেহারা নমনীয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠবে। পিপাসা, বমি ও অতিসার নিরাময়ে বেলের ফুলের ব্যবহার। শিশুদের বমি ও অতিসার বন্ধ করতে বেলের ছালের ব্যবহার। চোখের জ্বালা পোড়া ও এলার্জি নির্মূলে। পাকস্থলীর আলসার নির্মূলে বেল খেতে পারেন। বেল পাকস্থলীর আলসারসহ নানা সমস্যা দূর করে। বেলের উপাদান মিউকাস মেমব্রেনের গঠনে সহায়তা করে এবং চামড়ার সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে। বেলের ভিটামিন বি-১ ও বি-২ হৃৎপিন্ডের এবং লিভার ভালো রাখতে সাহায্য করে। নিয়মিত বেল খেলে স্তন ক্যানসার, ইউটেরাম ও কোলন ক্যানসার হওয়ার প্রবণতা কমিয়ে দেয়। বেল প্রজেস্টেরণ হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে, নারীদের বন্ধ্যত্বের হার দূর করে। বেলের পুষ্টি উপাদান চোখের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অঞ্চলসমূহের পুষ্টি জোগায়। ফলে চোখ যাবতীয় রোগ থেকে রক্ষা করে। কোষ্ঠকাঠিন্য হলে পেট পরিষ্কার করার জন্য বেল খেতে হয়। এটি কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবেও সত্য। বেল সুন্দরভাবে মল পরিষ্কার হতে সাহায্য করে। নিয়মিত রোজ টানা ৩ মাস যদি আপনি বেলের শরবৎ খেতে পারেন তাহলে আপনার মল আর কঠিন থাকবে না। কোষ্ঠকাঠিন্য আর হবে না। পাকা বেলের শাঁস বের করে চিনি দিয়ে মিশিয়ে আর পানি বা দুধে ঘেঁটে শরবৎ করে খান এটাই হলো খুব তাড়াতাড়ি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার ঘরোয়া উপায়। আপনার আলসার যদি দীর্ঘ দিনের হয় তাহলে তো ডাক্তার দেখাতেই হবে, ওষুধ খেতেই হবে। আলসার রোগীর খাবার বলতে আমাদের অনেক ভেবে চিনতে খাবার খেতে হয়। অনেক কিছু বারনও আছে কিন্তু তার সঙ্গে বেল খাওয়াও কিন্তু খুব দরকার। পাকা বেলের শাঁসে সেই ফাইবার আছে- যা আলসার উপশমে সাহায্য করে। সপ্তাহে তিন দিন বেলের শরবৎ করে খান আলসার কমাতে। এছাড়া বেলের পাতা সারা রাত পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন সেই পানি খেলেও কিন্তু অনেক কমে যায় আলসার। লিভার সমস্যার প্রতিকারের ব্যাপারে বলতে গেলে একমাত্র সবার আগে যেটা মনে পড়ে সেটা হলো বেল। বেল বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধের উৎস। আর বিটা ক্যারোটিন হলো লিভার ভালো রাখার অন্যতম মূল চাবিকাঠি। বেলে আছে থিয়ামিন আর রাইবোফ্লেভিন। এই দুই উপাদানই লিভারের শক্তি বাড়ায় খুব ভালোভাবে। তাই লিভার ভালো রাখতে রোজ বেল খাওয়ার অভ্যেস করুন। তবে থাইরয়েড রোগী এবং গর্ভবতী মহিলাদের বেল না খাওয়াই ভালো। কাঁচা বেল পাতার রস বেশি পরিমাণ খাওয়া নিষেধ। এতে যৌন শক্তি কমে যায়। তাই পাতার রস খাওয়ার ব্যাপারে সর্তক থাকুন।